বঙ্গবন্ধুর ভাষণ - একত্রে

জয় আমাদের হবেই

জয়দেবপুরে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়ে প্রায় ৪০ জন বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে বলতে চাই, সরকার যদি মনে করে জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করতে পারবেন তবে তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। দেশ বর্তমানে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন তার সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারে। কিন্তু ধৈর্য ও সহিঞ্চুতারও একটা সীমা আছে। জয়দেবপুরের নৃশংস ঘটনা ঘটবার ঠিক পর মূহুর্তেই কারফিউ জারী করে মৃত ও আহতদের সরিয়ে আনবার কাজে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন সামরিক প্রশাসকরা ঘোষণা করেছেন যে সৈন্যদের ব্যারাকে পাঠানো হয়েছে তখন সৈন্যরা কি করে বাজার ও অন্যান্য অঞ্চলে থাকতে পারে তা বোধের অগম্য। এই রকম পাশবিক শক্তির প্রয়োগ বাংলার জনগণের দাবিয়ে রাখার দিন ফুরিয়ে গেছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ আজ জীবন উৎসর্গ করতে শিখেছে। তারা তাদের অভিষ্ট সাধনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।

অসহযোগ চলবে
বাংলাদেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবন্ধভাবে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন। আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চাই। এদেশ আর কারো উপনিবেশ হতে রাজী নয়।
আমাদের আন্দোলন চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বাংলার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু তা যদি না হয় তবে সংগ্রামের মাধ্যমেই তারা লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছেবে।
আমরা নিশ্চয়ই জয় লাভ করবো। বন্দুক, কামান, মেসিনগান কিছুই জনসাধারনের মুক্তি রোধ করতে পারে না। মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সব রকম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি থাকতে হবে।
আর মার খেতে রাজী নই
সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন একবার ঐক্যবন্ধ হয়েছে তখন আমি অবশ্যই দাবী আদায় করে ছাড়বো। তেইশ বছর মার খেয়েছি, আর মার খেতে রাজী নই। এবার সুদে আসলে বাংলার দাবী আদায় করে আনব। সত্যের জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি; জয় আমাদের অবশ্যই হবে।

সংগ্রহ-মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা-১৩৯
 
মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম
 
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। যতদিন বাঙ্গালীর সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, যতদিন একজনও বাঙ্গালী বেঁচে থাকবে, এই সংগ্রাম চলতেই থাকবে। মনে রাখবেন, কম রক্তপাতের মধ্যে যিনি চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন তিনিই সেরা সিপাহ-সালার। তাই বাংলার গনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালিয়ে যান। শৃংখলা বজায় রাখুন, সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপর ছেড়ে দিন।
বাঙলার দাবীর প্রশ্নে কোন আপস নেই। বহু রক্ত দিয়েছি, আরো দেব, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছিবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না। আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চাই। কিন্তু তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলতেই থাকবে। শোষক ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যুদস্ত করতে হয় তা আমি জানি। অতুলনীয় ঐক্য, নজীরবিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রশংসনীয় শৃক্ষলাবোধের পরিচয় দিয়ে বাংলার মানুষ আবার প্রমান করে দিল যে শক্তির জোরে তাদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না।
একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে আবাল বৃন্ধ-বনিতা বাংলাদেশের দাবীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সারাবিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছে। তারা যে ঐক্যবদ্ধভাবে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে বিশ্বের সামনে, বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আওয়ামী লীগের নির্দেশ সমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্য যাঁরা অতন্ত্র প্রহরীর মতো কাজ করেছেন, সেইসব ছাত্র, শ্রমিক ও কর্মচারী সংগঠনগুলোর সদস্যদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ প্রমান করেছেন তাঁরা সুচারুভাবেই তাঁদের নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানো অব্যাহত রাখার স্বার্থেই অর্থনৈতিক তৎপরতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জনগণকে কঠোর শৃক্ষলা পালন করতে হবে।
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি বর্তমান যে মুক্তি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত তারা ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবেই। যে জাতি রক্ত দিতে জানে, তাদের কোন বাহিনীই দাবিয়ে রাখতে পারে না- সে সেনাবাহিনী যতই শক্তিশালী হোক না কেন।
আপনারা আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যান-আমি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকবই। আমাদের পেশ করা দাবী যদি গৃহিত না হয় তাহলে সংগ্রামের জন্য আপনাদের তৈরি থাকতে হবে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এক-জয় তাদের অনিবার্য।
 
সংগ্রহ-মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ পৃষ্ঠা-১৪৩
 
অপপ্রচারের জবাব
 
পাকিস্তানের জাগ্রত জনগণের মনে আজ আর কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নাই যে, ষড়যন্ত্রকারী কায়েমী স্বার্থবাদী আর তাদের ফর্মাবরদাররা আজ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যক্রম বানচাল করিবার জন্য শেষবারের মতো উম্মত্ত প্রয়াসে মাতিয়াছে।
বার কোটি মানুষের ভাগ্য এতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, ইহা লইয়া ছিনিমিনি খেলার অবকাশ নাই। গত এক সপ্তাহ ধরিয়া জাতিকে যে সন্যাসরোগীসুলভ ও রাজনৈতিক খ্যাপামি দেখিতে হইতেছে উহার অবসানে সময় আসিয়াছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র রচনা ও তাহাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে একটি কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করা হইতেছে।
জনগণের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব সস্পর্কে সচেতন মেজরিটি পার্টি আওয়ামী লীগ তীক্ত বিতর্কের দ্বারা পরিবেশ বিষাক্ত করিতে আগ্রহী না হওয়ার দরুণ এতদিন ইচ্ছাকৃতভাবেই নিরব থাকিয়াছি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী বলিয়াই আওয়ামী লীগ মনে করে যে একমাত্র জাতীয় পরিষদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের সুরাহা হইতে পারে এবং হওয়া উচিৎ। এই লক্ষ্য সামনে রাখিয়াই আওয়ামী লীগ অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের দাবী জানাইয়া আসিতেছিল। এই দল বরাবরই প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও নেতার সঙ্গে আলোচনায় সম্মত থাকিয়াছে।
দলীয় নেতৃবৃন্দকে লইয়া আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হই এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচনী রায়প্রাপ্ত ছয় দফা শাসনতান্ত্রিক ফর্মূলার প্রতিপাদ্য ব্যাখ্যা করি। ইহার পর পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টোর সঙ্গে আমার স্বাক্ষাৎ হয়। আমার সহকর্মীরা তাহার সহকর্মীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। আমরা তাদের বুঝাইতে চাহিয়াছি যে, ছয় দফা ভিত্তিক ফেডারেল ইস্কিমের স্বপক্ষে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হওয়ার পর ইহা এখন জনগণের সম্পদ। জনগণ আওয়ামী লীগকে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ম্যান্ডেট দিয়াছে এবং আওয়ামী লীগ এই ম্যান্ডেটটি বাস্তবায়নের অবিচল প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ। তবে ছয় দফা বাস্তবায়িত হইলে পাঞ্জাব, সিন্ধু সীমান্ত বা বেলুচিস্তানের ন্যায্য স্বার্থ বা ফেডারেল সরকারের কার্যকারিতা ক্ষুন্ন হইবে বলিয়া কাহারো মনে ভ্রান্ত ধারণা থাকিলে তা নিরসনের জন্য আমরা ছয় দফার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে রাজী আছি।
আগে পশ্চিশ পাকিস্তানে দলীয় সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া পরে ঢাকা আসিয়া আবার আলোচনা শুরু করিবেন এই অজুহাত তুলিয়া পিপলস পার্টিই ঢাকায় গুরুত্ত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত আলোচনা মুলতবি রাখিয়া যায়। এদিকে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা ওয়াদার পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি দেশকে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রদানের জন্য সকল মহলের ওলেমায়ে ইসলামের মৌলানা নুরানী, নওয়াব আকবার খান ভক্তি, মওলানা গোলাম গাউস সহ জারতি ও মৌলানা মুফতি মাহমুদ (জমিয়তে ওলামায়ে  ইসলাম) ও অন্যান্য পশ্চিমাঞ্চলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। একই সঙ্গে আমরা অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকার জন্য চাপ দিতে থাকি। পরিষদের অধিবেশন ডাকিতে বিলম্ব হইয়াছে এবং শেষ পর্যন্ত উহা ডাকার আগেই দুইটি মাস অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। শেষ পর্যন্ত যখন তেশরা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহুত হইয়াছে তখন মুহুর্তের জন্য হইলেও মনে হইয়াছে, যে কুচক্রি শক্তি প্রতিবার গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সক্রিয় হইয়া উঠিত তাহাদের উপর যুক্তিবাদী শক্তির বিজয় সুচিত হইয়াছে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় একটি নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করিয়াছে, ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করিয়াছে এবং তারপর প্রতিটি গণ-আন্দোলন বানচালের অশুভ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হইয়াছে।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহুত হইবার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহই স্বাক্ষ্য দেয় যে, এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি আর একবার ছোবল হানার প্রস্তুতি নিতেছে। জনাব ভুট্টো এবং পি-পি-পি আকস্মিকভাবে এমন সব ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তা চালাইতেছেন যাহার উদ্দেশ্য মনে হয় জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কর্মধারা বিঘ্নিত করিয়া শাসনতান্ত্রিক ধারাকে বানচাল করা। আর এইভাবেই তারা জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিহত করিতে চান।
পিপলস পার্টিও সেক্রেটারি জেনারেল জনাব জে,এ, রহিম এক বিবৃতিতে বলেয়াছিলেন, ‘আমরা দেখিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানযে আসলেই একটি কলোনি ইহা অতৃপ্ত মানসিকতার কথা নয়-কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তব।’ কিন্ত তা স্বত্বেও ৬ দফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কতিপয় মৌলিক আপত্তি সানধানতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে যে, ইহা বাংলাদেশকে কলোনি হিসাবেই বজায় রাখার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রধানত: কেন্দ্র কর্তৃক বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই দেশের অপরাংশের কায়েমী স্বার্থবাদীদের তরক্কির জন্য বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ চলিয়াছে, বাংলার সম্পদ পাচার করিয়াছে। এইভাবেই প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা আশি ভাগেরও বেশী পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের কল্যাণে ব্যায়িত হইয়াছে। গত ২৩ বছরের মোট আমদানীর দুই-তৃতীয়াংশ আসিয়াছে পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৫ শত কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় মুনাফা শিকারী শিল্পপতির স্বার্থে বাংলাদেশকে সাতকোটি লোকের ‘সংরক্ষিত বাজার’ হিসাবে ব্যবহার করা হইয়াছে। আর এই নির্মম শোষণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনিবার্য বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। দিকে দিকে দূর্ভিক্ষের করাল ছায়া-অর্থ নাই, সংগতি নাই। বাংলাদেশের মানুষ আজ ভয়াবহ আকালের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। যা কিছুই ঘঁটুক না কেন, আমরা আর এই অবস্থা চলিতে দিতে পারি না।
বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য কেন্দ্রের হাতে না থাকিলে এ হেন নির্মম শোষণ চলিতে পারিল না। এই পটভূমিতে কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য বহাল রাখার জন্য জেদ নগ্নভাবে এই সত্যই প্রকট করিয়া তোলে যে, ইহার উদ্দেশ্য জাতীয় সংহতি অর্জন নয়। বরং বাংলাদেশের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য প্রধান হাতিয়ার গুলো কেন্দ্রের হাতে রাখা।
পিপলস পার্টির অন্য একটি উক্তিতে এই সত্যের যথাথতা প্রমানিত হয়। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পরিষদ গঠনের দাবী সমর্থনে খাঁটি ফেডারেশনের (উহার অর্থ যাহাই হউক না কেন, কারণ কোন দুইটি ফেডারেশনই যখন একে অন্যের সহিত সাদৃশ্যপুণ্য নহে) নীতি গ্রহণের প্রস্তাব করা হইয়াছে। যাহার দ্বিতীয় কক্ষে সকল ইউনিটের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকিতে হইবে বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। অপর কথায়, ধরুণ, দ্বিতীয় কক্ষের সদস্য সংখ্যা একশত হইলে উহাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হইবেন মাত্র বিশজন। এইভাবে বহত্তর জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশকে একটি গুরুত্ত্বহীন সংখ্যালঘু ইউনিটে পরিণত করার প্রস্তাব দেয়া হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ইতিপূর্বে কখনো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব শতকরা বিশ ভাগে হ্রাস করার প্রস্তাব উত্থাপন করিতে সাহস পায় নাই। কিন্তু সংখ্যা সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের বর্তমান প্রস্তাব গৃহীত হইলে বাংলাদেশ অন্য পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্বেও অসহায় সংখ্যালঘু ইউনিটে পরিণত হইবে। এই পদ্ধতিতে অপর অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা কেন্দ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখিবে। এভাবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হইলে যে সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্যের ক্ষমতাবলে ঔপনিবেশিক শোষণের পুরাতন পদ্ধতি স্বাচ্ছন্দে চিরস্থায়ীভাবে কায়েম করিবে। এইসব প্রস্তাব কেন্দ্রীয় আমলাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কায়েম করিবে। এইসব প্রস্তাব কেন্দ্রীয় আমলাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃষ্ট প্রমান বহণ করিতেছে। তাহারা এভাবে তাহাদের প্রভু পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের মনোরঞ্জন অব্যাহত রাখিতে পারিবে। -গত ২৩ বৎছর যাবৎই তাহারা বিশ্বস্ততার সহিত তাহাদের ঐসব প্রভুর সেবা করিয়া আসিতেছে।
সেইজন্য সমান প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একটি কার্যকরি দ্বিতীয় কক্ষ গঠনের প্রস্তাব অন্তত পাকিস্তানের আদর্শে খাঁটি ফেডারেশনের জন্য মোটেই কার্যকরি নমুনা নহে, বরং উহা বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শোষণ চিরস্থায়ী করার অশুভ পায়তারা মাত্র।
৬ দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য আপত্তি চিরাচরিতভাবে বিকৃত তথ্য পরিবেশনেরই সামিল এবং বাংলাদেশের মানুষ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করাই ইহার মুল উদ্দেশ্য। ৬ দফা কর্মসূচীতে ফেডারেশন সরকারকে ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কৃপার উপর নির্ভরশীল হইতে হইবে বলিয়া যে পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হইয়াছে আসলে তাহা নহে। বরং উহাতে ফেডারেল সরকার কর্তৃক সাক্ষাৎ শাসনতান্ত্রিক বিধান মতে পর্যাপ্তভাবে রাজত্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা বিলি-বন্টনের স্পষ্ট বিধান রহিয়াছে; যাহার ফলে ফেডারেল আইন পরিষদ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের উপর ফেডারেল কর আরোপের ক্ষমতা লাভ করিবে।
ফেডারেশনের বিভিন্ন ইউনিটের সম্পদ হইতে প্রথম ব্যয় বরাদ্দ বাবদ উক্ত কর আদায় করা যাইবে।
অনুরূপভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যের উপর ছাড়িয়া দিলে ফেডারেল সরকারের পক্ষে বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় অসুবিধা দেখা দিবে বলিয়া যে আপত্তি তোলা হইয়াছে, তাহাও ঠিক নহে। কারণ, যুগে যুগে এ কথা পুনরনুমোদিত হইয়াছে যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহয্যের ক্ষেত্রে যে ক্ষমতার অধিকারী হইবে তা দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে ব্যবহার করা হইবে।
বাংলাদেশের লোক ও পশ্চিমাঞ্চলের নির্যাতিত জনগণের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টির জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হইতেছে তাহা চরম অসহণীয় অবস্থায় পৌঁছিয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাঙ্গালীদের প্রকৃত ‘শত্রু’ বলিয়া চিত্রায়িত করা হইয়াছে, যাহাদের নিকট গেলে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা নাকি ‘হোস্টেজ’ হিসেবে আটকা পরিয়া যাইবে। জাতীয় পরিষদকে কসাইখানা আখ্যা দিয়া পরিষদের বাঙ্গালী সদস্যদের প্রতি অযাচিত মন্তব্য করা হইয়াছে।
এইসব বাজে অভিযোগ উত্থাপনের একমাত্র কারণ এই যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করা হইয়াছে। দেশের সকল প্রধান প্রধান কেন্দ্রীয় সংস্থা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত বলিয়া বাঙ্গালীরা যখন বিগত তেইশ বৎসরে সকল সময়ই তথায় যাতায়াত করিতেছে, বিশেষত: সেক্ষেত্রে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া শুধু অশোভনই নয়, বরং অযৌক্তিকও। এভাবে আবহাওয়া বিষাক্ত করিয়া তুলিলে বাঙ্গালীরা কি ন্যায় সঙ্গত ভাবে প্রশ্ন করিতে পারে না যে, তাহাদিগকে পশ্চিম পাকিস্তানে গমণের জন্য আহ্বান জানানো হইবে কি না? আরো কতিপয় উক্তি এই ব্যাপারে আলোকপাত করিয়াছে যাহার মধ্য হইতে উপরোক্ত উক্তি মনোভাব টের পাওয়া যায়।
পিপলস পার্টির জনৈক সদস্য গত ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘পাকিস্তানটাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবী করিয়াছে যে, ‘জনগণ অবশ্যই দেশের অখন্ডতার প্রশ্নে তাহাদের সঠিক মনোভাব ব্যক্ত করিবে এবং মৌলিক ব্যাপারে যে কোন প্রকারের আপোষ মীমাংসা প্রত্যাখান করিবে; আসন্ন মারাত্বক বিপর্যয়ের হাত থেকে সমগ্র দেশকে রক্ষা করার কোন ক্ষমতা যখন তাহাদের থাকিবে না, তখন অন্তত যেটুকু পারা যায়, দেশের সে অংশটুকু রক্ষার জন্যও চেষ্টা করিবে। সঠিক রাজনৈতিক পন্থা হইতেই যেটুকু পারা যায় সেটুকু রক্ষা করা এবং দেশের অখন্ডতা ভঙ্গের প্রচেষ্টা বা প্রস্তাব না করা। আমরা অবশ্যই আওয়ামী লীগকে তাহার ৬ দফা হইতে সরিয়া দাড়াইতে বলিব এবং তাহা উহা না করিলে আমরা অবশ্যই যে কোন মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দফা প্রবর্তনের প্রচেষ্টাকে ঠেকাইব’।
এখানে দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হইয়াছে। উহার একটি হইতেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। উহাতে অভিযোগ করা হইয়াছে যে, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ছয় দফা চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে। ছয় দফা কর্মসূচি আসলে ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটগুলির স্বায়ত্বশাসনের নিরাপত্তা বিধানেরই কর্মসূচি। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ফেডারেশনভূক্ত ইউনিটগুলি একেবারে একই হারে বাংলাদেশের মতো স্বায়ত্ব শাসন না চায় অথবা যদি তাহারা কেন্দ্রের হাতে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা ছাড়িয়া দিতে চায় কিংবা কতিপয় আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানে আগ্রহী হয় তবে ছয় দফা ফর্মূলা তাহাদের পক্ষে অন্তরায় হইবে না। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগও কোন সময়েই এমন কোন ভূমিকা গ্রহণ করে নাই যে, ছয় দফা ফেডারেশনভূক্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইউনিটগুলির উপর চাপাইয়া দেওয়া হইবে। অপর যে বিষয়টি লক্ষণীয় ভাবে উত্থাপন করা হইয়াছে তাহা হইতেছে এই যে, যদি বাংলাদেশকে অতীতের শর্তের মধ্যে আবদ্ধ না রাখা যায়, অর্থাৎ যদি উহাকে কলোনি হিসেবে বজায় না রাখা যায় এবং তাহার পরিবর্তে যদি বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্টদের প্রদেশ হিসেবে উহার ন্যায় সঙ্গত ভূমিকা পালন করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচাইতে হইবে।
কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে ‘কাহার নিকট হইতে’ এবং ‘কাহার জন্য’ বাঁচাইতে হইবে? স্পষ্টত নিবন্ধকার ইহাই দেখাইতে চান যে পশ্চিম পাকিস্তানকে সেই বাঙ্গালীদেরই হাত হইতে বাঁচানো হইয়াছে যাহারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং তিনি ইহাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেই স্বার্থান্বেষী মহলের জন্যই বাঁচাইতে চাহেন যাহারা এইরূপ গণতান্ত্রিক পরিবেশে টিকিয়া থাকিবেন না এবং যাহাদের পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অবহেলিত জনগণকে শোষণের অধিকার নিশ্চিত হইবে। এমনকি নিবন্ধকার বাংলাদেশের ব্যাপারে উক্ত স্বার্থান্বেষী মহলের ‘স্বাধিকার হারাইতে হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তাহাদের এই শোষণের অধিকারকে নিশ্চিত করিতে চান বলিয়া মনে হয়। পাকিস্তানের জাগ্রত জনগণের মনে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয় যে, ষড়যন্ত্রকারী এবং স্বার্থান্বেষী মহল ও তাদের তোষামদকারীরা নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা প্রণীত একটি শাসনতন্ত্র গ্রহণ ও তাদের হস্তেই ক্ষমতা হস্তান্তরকে বানচাল করার শেষ বেপরোয়া অপচেষ্টায় মাতিয়া উঠিয়াছে। তাহাদের এরূপ বেপরোয়া মনোভাব এতই চরম আকার ধারণ করিয়াছে যে তাহারা জাতীয় অখন্ডতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার ভাব করিয়া পাকিস্তানের অস্তিত্ব লইয়াও জুয়া খেলিতে ইচ্ছুক। তাহারাই পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে একত্রে বাস করার ভিত্তি তৈরির শেষ সুযোগ বানচাল করিয়া পাকিস্তানের অখন্ডতার উপর একটি চরম আঘাত হানিতে উদ্যত হইয়াছে।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে যে শাসনতন্ত্র গৃহীত হইবে-তাহার লক্ষ্যই হইবে উক্ত মিলনের ভিত্তি রচনা করা। আমরা এখনো এই ফোরামে স্বার্থক প্রচেষ্টা চালাইতে প্রস্তুত রহিয়াছি এবং ইহাই আমাদের এই দেশকে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রদানে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য একমাত্র উপযুক্ত ফোরাম। এই দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমরা পাকিস্তানের প্রত্যেক অংশের জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সহযোগিতা করিতে আহ্বান জানাই।
পাকিস্তানের নির্যাতিত জনগণ ও বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা, কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র জনগণের বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। যাহারা ‘অনভিপ্রেত সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়ত্ব’ ও ‘নির্বাচিতের সেচ্ছাচার’ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তাহাদের প্রতি আমাদের জবাব হইতেছে, পাকিস্তানের জনগণ সংখ্যালঘু একনায়কত্ব সহ্য করিবে না। এমনকি ক্ষমতার দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইলেও কোন স্বৈরাচারই তাদের ভীত করিতে পারিবে না।
আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি তাহা হইতেছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকার বাধ্য করিয়াছে। কারণ, স্বৈরাচারী ক্ষমতার দন্ড জাগ্রত জনগণের সংকল্পের আঘাতের কাছে টিকিয়া থাকিতে পারে না।
যে কোন ভবিষৎ স্বৈরাচারির ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আমরা ষড়যন্ত্রের অশুভ শক্তির প্রতি কোন প্রকার বিবেক বর্জিত পায়তারা না করার অথবা বারো কোটি মানুষের ভাগ্য লইয়া খেলা না করার জন্য সর্তকবাণী উচ্চারণ করিতেছি। যদি কেহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাঁধা প্রদানের বা বানচাল করার চেষ্টা করে তবে বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে জাগ্রত জনগণের পবিত্র দায়িত্ব হইবে তাহা প্রতিরোধ করা। আমি বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণকে আমাদের মাটি হইতে গণবিরোধী শক্তিকে যে কোন উপায়ে নির্মূল করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানাইব।
আমরা আজ প্রয়োজন হইলে জীবন বিসর্জন দিব-যাহাতে আমাদের ভবিষৎ বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করিতে না হয়; যাহাতে তাহারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সম্মানের সহিত মুক্ত জীবন যাপন করিতে পারে, সেই প্রচেষ্টাই আমরা চালাইব।
পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন...ইত্যাদি কথা শুনিতে শুনিতে আমরা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি। যখনই বাংলার মানুষ তাহাদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া উত্থাপন করিয়াছে, তখনই শোষকগণ ইসলাম ও সংহতি বিপন্নের কথা তুলিয়াছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী বিজয় বানচাল এবং ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচন ঠেকাইয়া সামরিক আইন জারী-বিভিন্ন সময়, বারবার এইসব বাজে ধূয়া তোলা হইয়াছে। আমরা এইসব ভূয়া সংহতিবাজদের চাইতে অনেক বেশি খাঁটি পাকিস্তানী। এইসব নুইসেন্স আমরা আর সহ্য করিতে রাজী নই।
বাংলার উপকুলে মহাপ্রলয়ে যখন ১০ লক্ষ লোক প্রাণ হারাইয়াছে, লক্ষ লক্ষ লোক অন্তহীন দুর্দশার মধ্যে তখন এইসব সংহতিবাজের অনেকেই বাংলায় আসিয়া তাহাদের দেখিতে পারেন নাই।
অনেকেই জানিতে চান, আমি পশ্চিম পাকিস্তানসফর করিতেছি না কেন? নির্বাচনের আগে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের সফরে গিয়াছি, আমার দল বিভিন্ন প্রদেশে প্রতিদ্বন্ধিতা করিয়াছে। অর্থাৎ যারা আজ সংহতির ডঙ্কা বাজাইতেছেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশে কোন পার্টি অফিস নাই-দুর্দিনে তাঁহারা এখানে আসেন না। জাতীয় সংহতি এখনো বিপন্ন হয় নাই। তবে কেউ যদি তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তার জন্য আমাদের কোন দায়-দায়িত্ব নাই।
সংগ্রহ-মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ পৃষ্ঠা ১৪৭ 

আওয়ামী লীগের ঘোষণা পত্র

[আওয়ামী লীগের ঘোষণা পত্র রচনায় শেখ মুজিব অংশ গ্রহণ করেন। সেই কারণে আমরা এই ঘোষণা পত্রটিকে এখানে সংযোজিত করলাম-সম্পাদক]
সত্তরের দশকে পৌঁছেই পাকিস্তানের জনগণ যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, অন্যকোন দেশের মানুষকে তারচেয়ে বড় কোন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়নি। স্বাধীনতা অর্জন এবং পাকিস্তানসৃষ্টির ফলে দেশবাসীর যে হৃদয় মন আশা-আকাঙ্খার উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল সে মন নৈরাশ্য এবং বঞ্চনাবোধের কাছে আজ পরাজিত। স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠু সজীব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-যেখানে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করবে, ন্যায় বিচার এবং সাম্য বিরাজ করবে। এই অঙ্গীকার আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। গণতন্ত্রকেই শিকড় মেলতে দেয়া হয়নি এবং একটার পর একটা ‘কোটারি’ এসে অন্যায়ভাবে জনগণের ক্ষমতা দখল করেছে। এইসব ‘কোটারি’ তাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের নগ্ন প্রয়াসে লিপ্ত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সম্পদ নিজেদের হাতে সংহত ও পুঞ্জীভূত করেছে এবং পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষকে শোষণের শিকারে পরিণত করেছে। এইভাবে স্বাধীনতা জনগণের জন্য মুক্তি আনার বদলে আরো বেশী রকম দাসত্ব নিয়ে এসেছে।
আমাদের সমাজ যে বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে তাই গুরুতর। দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের সম্পদ যথেষ্ট নয়। দেশের দুইটি অংশ সহস্রাধিক মাইলের ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন। তাই এখানে একটা সুষ্ঠু সমাজ গঠনের কাজ স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন। সুদীর্ঘ বাইশ বছরে প্রায় কখনোই এই দায়িত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে আমরা মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানকে ক্ষমতা এবং সম্পদ অর্জনের হীন ও নগ্ন প্রয়াসে লিপ্ত থাকতে দেখেছি। কাজটি তাই আজ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মেহনতি জনতা আজ জেগে উঠেছে এবং তারা আর তাদের অধিকারের বঞ্চনা সহ্য করতে রাজী নয়। বারো কোটি মানুষের একটা জাতি সুবিধাভোগি একটা কোটারির হাতে কিছুতেই নিজেকে সমর্পন করে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা। এই কোটারির হাত থেকে নিজেদের ন্যায় সঙ্গত ক্ষমতা ছিনিয়ে আনতে তারা বন্ধপরিকর। মানুষে মানুষে এবং অঞ্চল অঞ্চলের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই অবিচারকে চিরস্থায়ী করার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনসাধারণ বিদ্রোহ আরম্ভ করেছে। মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার এবং অবশিষ্ট জনগণের প্রতি সম্পর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শনের ফলে আজ অর্থনৈতিক কাঠামোর আশু এবং আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের দুই অংশের উৎকট বৈষম্য ক্রমাগত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক অর্থনীতি আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই ধ্বংসের হাত থেকে আঞ্চলিক অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য আঞ্চলিক সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করার এবং অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষমতা দিয়ে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ছাড়া এটা সম্ভব নয় বলেই আজ শাসনতন্ত্রের এই পরিবর্তনের দাবী অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
জনগণই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। সমাজকে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে পুর্নগনের সাধারণ প্রচেষ্টায় জনগণকে সক্রিয় এবং সমবেতভাবে আত্মনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য সমাজ ব্যবস্থা বিধি ও কাঠামোর আমুল পরিবর্তন দরকার। আর এটা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি সামাজিক বিপ্লব সাধন করা এবং এই জন্যই আমাদের একটি নতুন শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর প্রয়োজন। এই বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে আজ আমরা এসে দাড়িয়েছি। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। কারণ এর উপর আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে।
ঔপনিবেশিক শাসনকালের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করেছি তাকে ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। আজকে দেশের জনগণ ও সমাজের জরুরী প্রয়োজন মিটানোর উপযোগী করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ডিজাইন (নকশা) করতে হবে।
এরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের অধিকার আদায়ের দৃঢ় সংকল্পের প্রথম বহি:প্রকাশ। আজ পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। শাসকচক্রের বারংবার আক্রমনের মুখে অগণিত পরিবার ও জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রকৃতপক্ষে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেও জনস্বার্থের জন্যই শহীদ হয়েছেন। স্বাধীনতার শিখা অনির্বাণ রাখার জন্য হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে। এই সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য অসংখ্য মানুষকে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে এবং অনেকেই পরিবার, সম্পত্তি এবং জীবিকা নির্বাহের উপায় হারাতে হয়েছে।
জনগণের নিরবিচ্ছিন্ন, সুকঠিন ও সুপ্রতিজ্ঞ এই সংগ্রামের ঐতিহ্যময় পটভূমিতে আওয়ামী লীগ আমাদের সম্মুখে সমুপস্থিত চ্যালেঞ্জকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার জন্য যে সাহস এবং সংকল্পের প্রয়োজন জাতির উপর আমাদের বিশ্বাস, জনগণের উপর আস্থা এবং সর্বোপরি সর্বশক্তিমানের উপর আমাদের ঈমানের মাধ্যমেই আমরা তা লাভ করেছি। তাই গণতান্ত্রিক উপায়ে বিল্পব সাধনের জন্য এবং তা দিয়ে বর্তমান অন্যায় অবিচারের উপরে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর স্থলে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে সুবিচার রক্ষাকারী একটি নতুন শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এই ঘোষণাপত্রে একটি ব্যাপক রূপরেখা পেশ করা হয়েছে।

সংগ্রহ-মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ পৃষ্ঠা-১৫৭
 
শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য

যথাযর্থ সজীব গণতন্ত্র
এমন একটা যথার্য সজীব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে জনগণ স্বাধীনতা এবং মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করতে পারবে এবং ন্যায় ও সাম্য বিরাজ করবে।

ইসলাম
জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হলো ইসলাম। আওয়ামী লীগ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে যে পবিত্র কোরান ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলীর পরিপন্থি কোন আইন পাকিস্তানে প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংখ্যালঘু
সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং আইনের কাছে সমান আশ্রয় পাবে। তারা পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন এবং প্রচারে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং পরিচালনায় এবং স্ব-স্ব ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ব্যতীত অন্য যে কোন ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন ব্যাক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা হবে না। নিজ ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট না হলে কোন ব্যাক্তিকে ধর্ম সম্পর্কীয় কোন নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোন ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জোড় করা হবে না।

জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব
অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিকের কর্ম সংস্থানের সুযোগসহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরনের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের-একতার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্রে থাকবে।

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য
প্রত্যেক নাগরিকের শাসনতান্ত্রিকভাবে সাম্য ও আইনের সমান আশ্রয় দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই গ্যারান্টি কার্যকর করাকে সুনিশ্চিৎ করার জন্য যাতে প্রত্যেকটি নাগরিক নিজের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনগত সাহায্য পায় তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে।
আওয়ামী লীগ প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সাম্যের নীতির প্রতি বিশ্বাস পুনরায় ঘোষণা করেছে এবং সকল নাগরিককে গণতান্ত্রিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।

মৌলিক অধিকার
বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, জনসভা আহ্বানের স্বাধীনতা, সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিগতকাল থেকে শাস্তি কার্যকর করা ও সর্বোপরি বে-আইনী গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে আটক থেকে রক্ষার ব্যবস্থাসহ সকল মৌলিক অধিকার শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হবে। অস্পুশ্যতা, দাসত্ব এবং বল পূর্বক শ্রম আদায় নিষিদ্ধ করা হবে।
প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ‘সার্বজনীন মানবিক অধিকার ঘোষণার’ অন্তর্গত অধিকার সমূহ নিশ্চিত করা হবে।
এতদ্ব্যতীত শাসনতন্ত্রের বিধান থাকবে যে, যুদ্ধকালীন প্রকৃত আক্রমণাদির সময় ছাড়া মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। জাতীয় জরুরী অবস্থার অজুহাতেও এই অধিকার খর্ব করতে দেওয়া যাবে না।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শাসনতন্ত্রে প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের নিশ্চয়তা থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখার মত চরিত্রবান, জ্ঞানবান এবং ন্যায়বান ব্যাক্তিরাই যাতে বিচার বিভাগের সদস্য হতে পারেন শাসনতন্ত্রে সেইরূপ বিধান রাখা হবে।

ফেডারেল বিধান
পাকিস্তানহবে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকটিকে ৬ দফা ফর্মুলার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রদানকারী ফেডারেল রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র)।

১নং দফা
সরকারের ধরণ হবে ফেডারেল এবং পার্লামেন্টারী। এতে ফেডারেল আইনসভার এবং ফেডারেশনের অন্তর্গত ইউনিটগুলোর আইনসভার নির্বাচন হবে প্রত্যেক এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। ফেডারেল আইনসভার প্রতিনিধিত্ব হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে।

২নং দফা
ফেডারেল সরকারে হাতে থাকবে কেবল মাত্র দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রীয় বিষয় এবং নিচে ৩ নং দফার বর্ণিত শর্তাধীনে মুদ্রা।

৩নং দফা
দেশের দুইটি অংশের জন্য দুইটি পৃথক এবং সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থা সহ দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এতে আঞ্চলিক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। এই ব্যাঙ্কগুলো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর এবং মূলধন পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করবে।

৪নং দফা
রাজস্ব সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর হাতে থাকবে। দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দফতর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব ফেডারেল সরকারকে দেয়া হবে। শাসনতন্ত্রে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে নির্ধারিত হারের ভিত্তিতে উক্ত রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ফেডারেল সরকারের তহবিলে জমা হবে। করনীতির উপর অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফেডারেল সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মিটাবার নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।

৫নং দফা
ফেডারেশনের অন্তর্গত অঙ্গরাষ্টগুলোর নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকটি ইউনিটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখার শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকবে। শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী ধার্য হারের ভিত্তিতে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাবে। ফেডারেল সরকার কর্তৃক পররাষ্ট্র নীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে আঞ্চলিক সরকারগুলোকে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে দেওয়া হবে।

৬নং দফা
কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে ‘মিলিশিয়া’ বা ‘প্যারামিলিশিয়া’ রাখার ক্ষমতা দেওয়া হবে।

এক ইউনিট বাতিল ঃ
এক ইউনিট বাতিলের ফলে যদি কোন সাধারণ বিষয় অমীমাংসিত থেকে যায় তবে তা ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানের উইনিটগুলোর জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী মীমাংসা করার জন্য রেখে দেওয়া হবে।
ফেডারেল সরকারের প্রতিনিধিত্ব ঃ
ফেডারেল সরকারের সকল শাখায় ও ফেডারেল সার্ভিসে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব লাভের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শাসনতান্ত্রিক সংবিধান থাকতে হবে। স্বল্প প্রতিনিধিত্বশীল অঞ্চলগুলো, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানথেকে বর্ধিত হারে লোক নিয়োগের মাধ্যমে যতসত্বর সম্ভব বর্তমানের স্বল্প প্রতিনিধিত্বের অবসান করা হবে। প্রাথমিক সংশোধনমূলক পদক্ষেপ হিসাবে বর্তমানে করাচিতে অবস্থিত নৌবাহিনীর সদর দফতর ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হবে।

গণতান্ত্রিক প্রশাসন ঃ
বর্তমান প্রশাসনযন্ত্রগুলো একটি ঔপনিবেশিক সরকারের কার্যাবলী সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হয়েছিল। একটি চলমান, গণতান্ত্রিক সমাজের বা রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে এই প্রশাসনযন্ত্রের কাঠামোর আমূল পুনগঠনের প্রয়োজন। এজন্য যে অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শাসনতন্ত্রে প্রতিফলিত হবে, তা হলো ঃ
ক. বর্তমান নিখিল পাকিস্তানও সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের বিলোপ সাধন।
খ. পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা এই দুটি ফেডারেল প্রশাসন পরিচালনার জন্য ফেডারেল সার্ভিস প্রবর্তন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল অংশ থেকে এতে লোক নিয়োগ।
গ. অঙ্গরাষ্ট্রগুলো কর্তৃক নিযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত কর্মচারীদেও সমন্বয়ে কতিপয় বিশেষ পেশাদার ক্যাডার প্রবর্তন। এই ক্যাডার কর্মকুশলতা ও মেধার মুল্যায়নের ভিত্তিতে অধিকতর সচলতা বিধানকারী সার্ভিস রুলের একটি নয়া কাঠামোর অধীনে থাকবে।
ঘ. জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব নির্বাচিত পরিষদের উপর অর্পণ। বিশেষভাবে শিক্ষিত কর্মচারীরা এই পরিষদকে সাহায্য করবে।
ঙ. মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করে মৌলিক প্রশাসন উইনিটের আকার হ্রাস ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় সরকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চ. প্রশাসনিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচার উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক কার্যাবলী তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ।



অর্থনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তি
শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প-যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধিও ফল যথাযথ বন্টনের বিধান থাকবে। যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের অতল তলে নিমজ্জিত এবং জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো থেকে বঞ্চিত, সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজন অপরিহার্য। আমাদের সমাজের নব জাতকের সংখ্যার উর্দ্ধগতি ও মৌলিক সম্পদের স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত অর্থনৈতিক  উন্নতি অর্জনে বিরামহীন সংগ্রাম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। আমাদের কাজ হলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন। সংগ্রাম ও ত্যাগ ব্যতীত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন ও ন্যায়-পরায়ন সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা অঙ্গীকারের সামিল।
দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধনের লক্ষ্য অর্জনের অঙ্গীকার নিজেদের আবদ্ধ করে আমরা দেশবাশীকে প্রকৃতপক্ষে বিরামহীন সংগ্রাম ও সব রকম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস, দেশের সকল স্তরের মানুষ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সমানভাবে ত্যাগের বোঝা বহণ করবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতির ফলও সমানভাবে ভোগ করবে-এই নিশ্চয়তা দিতে পারলেই আমরা তাদের কাছে এই আহ্বান জানাতে পারি। অতীতে অধিকতর দরিদ্র মানুষ এবং দরিদ্রতর অঞ্চলগুলোকে দিয়ে এই ত্যাগের বোঝা বইয়ে নেওয়া হয়েছে এবং নগণ্য সংখ্যক সুবিধাভোগী অর্থনৈতিক উন্নতির ফসল ঘরে তুলছে। অর্থনৈতিক উন্নতির এই অন্যায় পন্থাকে আমরা সম্পুর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করি।
সামাজিক অসাম্যের গোড়ায় এমন একটি ক্রুটিপুর্ণ প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে যা ব্যাক্তিগত উদ্যমকে (enterprise) অর্থনৈতিক উন্নতির একমাত্র বাহনে পরিণত করে। ব্যক্তিগত মুনাফার পথ ধরে দেশের সম্পদ অপরিহার্যভাবেই মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত হয় এবং অর্থনীতির মূল সেক্টরগুলো শক্তিশালী ‘কোটারি’র হাতে চলে যায়। এটা সামাজিক সুবিচার ও সাম্যের লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব করে তুলে। তাই জাতীয়করণ, সরকারী সেক্টরের সম্প্রসারণ, সমবায় সংগঠনগুলোর উন্নয়ন এবং শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনা ও মালিকানায় শ্রমিকের অংশীদারত্বের মতো নয়া প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনের জন্য পরিকল্পিত নির্দিষ্ট নীকিগুলো নিম্নরূপ হবে।

সরকারী খাত ও জাতীয়করণ
শুধুমাত্র ক্রমবর্ধমান ট্যাক্স ধার্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ এবং অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর নিয়ন্ত্রণ অধিকার থেকে সুবিধাভোগী কোরিকাকে বিরত রাখা সম্ভব নয়; কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করার জন্য অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর জাতীয়করণ এবং ভবিষ্যতে মূল সেক্টরগুলো সরকারী খাতের আওতাভুক্ত করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সামাজিক ন্যায় বিচারের অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনীতির উন্নতি করতে হলে এই ধরণের জাতীয়করণের কর্মসূচী গ্রহণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত। অবশ্য, অত্যন্ত সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা সহকারে জাতীয়করণ-কর্মসূচী রূপায়ন করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মচারীর এবং সর্বোপরি দক্ষতার উপর অতিরিক্ত চাপ না করে সেদিকে লক্ষ্য রেখে জাতীয়করনের মাত্রা, গতি গঠন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা উদ্ভাবিত না হলে মূল্য নির্ধারণ নীতির ত্রুটি এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব সংগঠনগুলো অদক্ষতায় আক্রান্ত হতে পারে-সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকা এবং এটা সুষ্পষ্টই দেখা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ব সংগঠনগুলোর পরিচালনার জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সবচেয়ে ভাল পেশাদার কর্মচারী নিয়োগ করলে ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সর্ব্বোচ্চমান পোঁছান যেতে পারে। উপরোক্ত বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয়করণের জন্য অগ্রাধিকারের তালিকাটি নিচে দেওয়া হলো ঃ
১. ব্যাঙ্কিং।
২. বীমা।
৩. লোহা ও ইস্পাত, খনি, মেশিন যন্ত্রপাতি, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং, পেট্রো-কেমিক্যাল, সার, সিমেন্ট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সহ ভারী শিল্প।
৪. বৈদেশিক বাণিজ্য-বিশেষতঃ নিম্নলিখিত পাট ও তুলা ছাড়াও লৌহ ও ইস্পাত দ্রব্য, কয়লা, খাদ্রশস্য, সিমেন্ট এবং সার সহ প্রধান প্রধান পন্যের আমদানী রপ্তানি।
৫. পাট ব্যবসা।
৬. তুলা ব্যবসা।
৭. শিপিংসহ প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তঃ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবহণ।
৮. পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিতব্য অপারাপর মূল শিল্প-কারখানা।

ক্রমবর্ধমান কর
দেশের বর্তমান কর প্রথায় মুষ্টিমেয় বিশেষ সুবিধাভোগীর প্রতি চিরাচরিত আনুকূল্যই প্রতিফলিত হয়েছে এবং এই করপ্রথা পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা পশ্চাৎমুখি। উচ্চতর উপার্জনকারী শ্রেণীর উপর ধার্য করে বোঝা আন্তর্জাতিক মানের হিসাবে সবচেয়ে কম। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠানকল্পে সাধারণ মানুষের স্কন্ধে পরোক্ষ করের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কর কাঠামোর আমূল রদ-বদলের প্রয়োজন। এইজন্য আয়করে একটি সত্যিকারের ক্রমবর্ধমান প্রথা প্রচলন এবং মূলধনের লাভ (Capital gains) মুনাফা, সম্পদ, উপহার ও উত্তরাধিকারের উপর থেকে মোটা পরিমানের ট্যাক্স আদায় করা আবশ্যক। উপরন্ত বর্তমানে প্রচলিত ‘ছাড়’ (deduction) অব্যাহতি (exemptions) এবং ‘ট্যাক্স হলিডে’ প্রথা সামাজিক অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সম্পদ পুঞ্জিভূত করতে সাহায্য করছে। এই সকল বিষয় ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন এবং উপরোল্লিখিত সামাজিক অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এ ধরনের ‘ছাড়’ অব্যাহতি ‘ট্যাক্স হলিডে’ প্রথা দূর করতে হবে।

আন্তঃ আঞ্চলিক ও আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য
গত ২৩ বছরেরও বেশী সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানথেকে ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও সাহায্যের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহারের দরুণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই এবং প্রত্যেক অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। ন্যায় বিচারের খাতিরে পাকিস্তানের অধিক উন্নত অঞ্চলগুলো থেকে স্বল্পোন্নত অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমানে সম্পদ স্থানান্তর করা উচিত এবং আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস ও পরিশেষে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলোকে নীতি গ্রহণ করতে হবে।

মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর ব্যবস্থা
জনগণ তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব-এই নীতি অনুসরণ করে বিপুল পরিমান পণ্য মজুদ, বন্টন ও গুদামজাত করার এবং সর্বোপরি অর্থ সাহয্যের (সাবসিডি) মাধ্যমে যাতে জনগণ সব সময়ে ন্যায্য মূল্যে মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রথমেই যে সব প্রধান পণ্যকে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে তার মধ্যে থাকবে চাল, গম, লবন, কেরোসিন। খাদ্য হিসাবে ব্যবহার্য্য তৈল ও মোটা সূতি কাপড়।

মনোপলি ও কার্টেল
মনোপলি (একচেটিয়া ব্যবসায়) ও কার্টেল (দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বনিকদের আঁতাত) প্রথা মুলতঃ ন্যায় ও সাম্যনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দুশমন এবং সেজন্য অর্থনৈতিক কাঠামোগত যে পরিবর্তন উদ্ভাবন করা হয়েছে তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মনোপরি ও কার্টেল প্রথাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার নিশ্চয়তা দেবে।

বিলাস দ্রব্যের উপর বিধি নিষেধ
দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগের সমান অংশীদারিত্বের মূলনীতি অনুসরণে বিলাসদ্রব্য ব্যবহারের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। কতিপয় ভাগ্যবানকে যথেচ্ছ পরিমান বিলাস দ্রব্য ব্যবহারের প্রশ্রয় দিয়ে মেহনতি মানুষের প্রতি ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানানো অন্যায়। বিলাস পণ্যের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করার জন্য যে সমস্ত বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তাতে থাকবে ঃ
ক. বিলাস দ্রব্যের আমদানির উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা।
খ. দেশে বিলাস দ্রব্য উৎপাদনের উপর কঠোর বিধিনিষেধ।
গ. জনগণের আশ্রয়স্থলের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিলাসবহুল ও জাঁকালো দালান নির্মানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির চাপে গুরুতররূপে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কেবলমাত্র অর্থমঞ্জুরী নহে, প্রকৃত মজুরীর মান রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যই উপরে বর্ণিত মূল্য স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে।

শিল্প
অতীতে শিল্প উন্নয়নের জন্য গৃহীত নীতিগুলো সমাজের প্রয়োজন মিটানোর দিকে বড় নজর দেয়নি। আমাদের সমাজের শিল্পোন্নয়নের মূল লক্ষ্য হবে-
ক. উৎপাদনশীল সরঞ্জাম (Capital goods) ও ভোগ্যপন্যের মূল আবশ্যকতা পুরণার্থে একটি শৈল্পিক ভিত্তি স্থাপন।
খ. মৌলিক আবশ্যকীয় দ্রব্যের জন্য বৈদেশিক সূত্রের উপর বিপজ্জক নির্ভরশীলতা হ্রাস।
গ. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জনে আমাদের অতীতের নীতিগুলো শুধু ব্যর্থই হয়নি উপরোক্ত বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক ঋণ সহ দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলোর বিপুল অপচয় ঘটিয়াছে। মৌলিক সামাজিক লক্ষ্য অর্জন ত্বরাম্বিত করার জন্য পরিকল্পিত শিল্পায়নের নয়া বাস্তবায়ন কৌশলের রূপরেখা নীচে দেওয়া হলোঃ

ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানা
রাষ্ট্রায়ত্ব খাতঃ
ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানার জাতীয় করণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অ-রাষ্ট্রায়ত্ব খাতঃ
যে সব বৃহদায়তন শিল্প জাতীয়করণ করা হয়নি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃংক্ষলার অধীন থাকবে।

ব্যবস্থাপনা ও ইকুইটি মুলধনে শ্রমিকদের অংশিদারিত্বঃ
যে সমস্ত শিল্প কারখানা সত্বর জনগণের মালিকানধীনে আনা হবে না, সরকার ক্রমবর্ধমান হারে তাদের ‘ইকুইটি’ মুলধন দখল করবে। সরকার যেটুকু ইকুইটি মুলধন আয়ত্ব করবে সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকরা যৌথভাবে সেই পরিমান অংশের মালিকানা লাভ করবে এবং সেই পরিমান অংশের মুনাফার ভাগ পাবে। শ্রমিকরা কেবল ইকুইটি মুলধনের নয় শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনায়ও অংশগ্রহণ করবে।

মাঝারি আয়তন শিল্প কারখানাঃ
বেসরকারী খাতে মধ্যমায়তন শিল্প কারখানার উন্নতির জন্য সরকার উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় প্রেরণা যোগাবে। অবশ্য এইসব শিল্প কারখানা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃক্ষলার অধীনে থাকবে।

ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পঃ
আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার উৎসাহ ও সাহায্য যোগাবে এবং নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান করবে। উদাহরণ স্বরূপ, তাঁতীরা ন্যায্যমুল্যে সুতা, প্রচুর পরিমানে ঋণ ও বাজারের যাবতীয় সুবিধা পাবে। ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বৃহদায়তন শিল্প-কারখানার পরিপুরক হওয়ার মত করে এই সব ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানাকে উন্নত করা হবে। সমবায়ের মাধ্যমে এইসব ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানাকে যতদূর সম্ভব উন্নিত করা হবে।
কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে চাল ও আটার কল, তেল কারখানা, চিনির কল এবং অনুরূপ কৃষিজ পন্যশিল্প যতদূর সম্ভব বেশী করে স্থাপন করা ও চালানো হবে। যাতে গ্রামাঞ্চলে দূরপ্রাপ্তসহ দেশের সর্বত্র ক্ষুদ্রায়তন শিল্প ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যাতে শিল্পায়নের সুযোগ-সুবিধার শরীক হতে পারে এবং শহরগুলোর উপর থেকে মানুষের ভীড় ও চাপ কমে যায় সেটাই এই ব্যবস্থার লক্ষ্য।

কৃষি ও গ্রামের জনগণঃ
আমাদের জনগণের অধিকাংশই গ্রামাঞ্জলের অধিবাসী। সেজন্য কৃষি ও গ্রামের মানুষের অবস্থা উন্নয়নের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া না হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সমস্ত পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। একদিকে আমাদের গোটা সমাজের সর্বত্র দারিদ্র ছড়িয়ে পড়েছে, অন্যদিকে গ্রাম ও শহরের জীবন যাত্রার মানের মধ্যে গুরুতর বৈষম্য রয়েছে। এর পিছনে ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও নিকট অতীতে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির জন্য এই বৈষম্য আরো বেড়ে গেছে। ফলে, গরীব চাষির হাত থেকে সম্পদ ধনী পুজিপতিদের হাতে ব্যাপকভাবে পাচার হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ অবিলম্বে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে এইরূপ শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার অঙ্গিকার করছে। আর এটা করতে হলে কৃষিখাতে সুদূর প্রসারী বিপ্লবের প্রয়োজন এবং এ ধরনের বিপ্লব সাধনের পূর্ব শর্ত হলো ভূমি ব্যবহারে বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন এবং বহুমুখী সমবায়ের মতো নয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
আমাদের গ্রামাঞ্চলের জনগণের আরো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, অতীতের শোষণের ফলে সৃষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের কৃষিকে নতুন জীবন দিতে হলে সরকারকে প্রভূত পরিমানে সার ও উন্নত বীজ থেকে শুরু করে নলকূপ, পাওয়ার পাম্প ও কীটনাশক ঔষধ ইত্যাদি সাহায্য দিতে হবে। আওয়ামী লীগ আমাদের কৃষি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করছে।
জায়গিরদারী, জমিদারী ও সরদারী প্রথা বিলোপ এবং সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ
জমির ব্যবহারিক পদ্ধতিতে যে সমস্ত পরিবর্তন সাধন করা হবে বলে স্থিও করা হয়েছে তা হলোঃ
ক. পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যমান জায়গিরদারী, জমিদারী ও সরদারী প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন।
খ. জমির প্রকৃত চাষীদের স্বার্থে ভূমি-ব্যবস্থার পুনঃবির্ন্যাস।
গ. জমির সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ এবং নির্ধারিত পরিমানের অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় জনসাধারণের অবস্থা ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে আওয়ামী লীগ জমির উপর এই সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ করবে।
ঘ. সরকারী খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া হবে।

বহুমুখী কৃষি সমবায়ঃ
কৃষি বিপ্লবের আরো একটি পূর্বশর্ত হলো, কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। জমি খন্ড বিখন্ড ও উপ বিভক্তির ফলে যেসব অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা গেলেই এটা সম্ভব হবে। ভূমির একত্রিকরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। তবে সমবায়ের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চাষীর প্লটগুলোকে গ্রুপ করে তার যৌথ ব্যবহারের ব্যবস্থা দ্বারা আশু সমাধান করা যাবে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠায় বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিটি থানায় একটা করে মূল উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই রকম সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষি সেক্টরে বিপুল পরিমান সাহায্য দিয়ে সরকার এইসব সমবায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। সেচ, পানি নিস্কাষণ, বাঁধ, গভীর নলকূপ, পাওয়ার পাম্প, উন্নত ধরণের বীজ, সার, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, কীটনাশক ঔষধ, ঋণ, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষাদান-প্রভৃতির আকারে এই সাহায্য দেওয়া হবে।

ভূমি রাজস্বঃ
আমাদের বর্তমান জনসাধারণের উপর ভূমি-রাজস্ব একটি বিরাট বোঝা। এর আশু সমাধান হিসাবে পাকিস্তানের সর্বত্র পঁচিশ বিঘা একর পর্যন্ত জমির খাজনা ও বকেয়া মওকুফ করা হবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বর্তমান ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন। জমি রেকর্ডের ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত ধরণের হবে।

পাটঃ
প্রধান অর্থকরী ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল বলে পাটের উপর বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। পরগাছার উপর মধ্যবর্তী শ্রেণী (middleman) অসাধু ব্যবসায়ী পাট চাষীদের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে পাট-শিল্পপতিরা বিনিময় হারকে (exchange rate) সুকৌশলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে পাট চাষীদের ক্ষতি করে। আভ্যন্তরীণ বেচাকেনা ও রপ্তানীসহ সম্পূর্ণ পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা হবে। জাতীয়করণের মুল লক্ষ্য হলো পরগাছার মতো এইসব দালালদের উচ্ছেদ করে পাট উৎপাদনকারীদের শোষণমুক্ত করা। কাঁচা পাটের বিনিময়ে হারকে পাট উৎপাদনকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে দেওয়া হবে না। এইসব ব্যবস্থার দ্বারা বর্তমান মূল্যের চাইতে উচ্চমূল্যে কাঁচা পাটের সর্বনিম্ন মূল্য নিশ্চিত করা যাবে। পাটের মান এবং একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাটের নতুন ব্যবহার উদ্ভাবন করার জন্য সরকার পাট গবেষণাকে খুব বেশী অগ্রাধিকার দেবে। অতীতে পাট গবেষণার প্রতি গুরুতর অবহেলা করা হয়েছে। বর্তমানের অ-চিন্তিত ও আংশিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পাট ব্যবসা ও শিল্পের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে। পাটের মান ও একর প্রতি পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি, পাট উৎপাদনকারীদের সর্বদা সর্বোচ্চ মুল্য দেওয়ার এবং দেশের অর্থনীতিতে পাটের অংশ যাতে সবচেয়ে বেশী হয় সে উদ্দেশ্যে একটা ব্যাপক ‘স্কিম’ নিয়ে তাকে কার্যকর করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তুলাঃ
তুলাও একটি অর্থকরী ফসল। এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থার প্রয়োজন। তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ ও তুলা চাষের উন্নয়ন ও গবেষণার উপর অত্যাধিক জোড় দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে এই প্রধান অর্থকরী ফসলের অংশ আরো বাড়ান হবে।

চাঃ
আমাদের চা শিল্পের চরম অদক্ষতার নিদর্শন। প্রতি একরে আমাদের দেশে গড়ে ১২ মন চা উৎপন্ন হয়। অথচ, ঠিক একই রকম অবস্থায় অন্যান্য দেশে একর প্রতি ৩৫ মন চা উৎপাদন হয়। বীজের মান উন্নত করার দিকে প্রায় কোন রকম নজর দেওয়া হয়নি। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং মৃত্তিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা, সার ও কীটনাশক ঔষধের অধিকতর ব্যবহারের মাধ্যমে একর প্রতি উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। উৎপাদন লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারলে ইজারা বাতিল সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চা বোর্ডের ক্ষমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য চা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আছে এমন কর্মচারীদের চা বোর্ডে নিযুক্ত করতে হবে। চায়ের বাজারের বর্তমান গুরুতর স্থিতিহীন অবস্থার অবসান করা দরকার। বর্তমানের ‘মার্কেটিং ইউনিট’ গুলো শৃংখলার সাথে কাজ না করলে ‘টি মার্কেটিং বোর্ড’ স্থাপন করতে হবে।

আখ ও তামাকঃ
আখ ও তামাক-এই দুইটি ফসলের উৎপাদনী সম্ভাবনা প্রচুর। এদের মান উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদনকারীদের জন্য স্থিতিশীল ও উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিৎ করার জন্য স্বতন্ত্র বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উন্নতমানের বীজ, সার এবং ঋণ হিসেবে প্রভুত পরিমানে সরকারী সাহায্য দেওয়া হবে।

ফল চাষ ও আবাদ এবং ফলের বাগানঃ
বৃহদাকারে ফলের চাষ আমাদের অর্থনীতিকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে ফল চাষ উন্নয়নের এবং আবাদের পরিকল্পনা করা হবে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ, মান এবং একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৃহদায়তন শিল্পের সুবিধা পাওয়া যাবে।

বনজ ও বনজ সম্পদঃ
নির্বিচারে বন এলাকা ধ্বংস করার ফলে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ দিনের পর দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অতিসত্ত্বর বন জরিপ ও বন সংরক্ষণ প্রণালী নির্ধারণ করতে হবে। নতুন নতুন বন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। নির্বিচারে বনজ সম্পদ আহরণের ফলে যে ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা এড়াতে হলে এই সম্পদের সদ্ব্যহারের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণঃ
পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থা পুননির্মাণের যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। কারণ প্রতি বছর বন্যায় আমাদের অপরিসীম ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিক পুর্নবিন্যাসের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থার একটি ব্যাপক পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অতি অল্পদিন ক্ষমতায় থাকাকালে ‘ক্রুগ মিশন’ কে বন্যা নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পাকিস্তানে আমন্ত্রন করার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। কি ‘ক্রুগ মিশন’ পরিকল্পনা, কি তার পরের কোন পরিকল্পনা, কোনটাই পরবর্তী কোন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। এই সমস্যা বর্তমানে অত্যন্ত গুরুতর আকার ধারণ করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রনের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে আওয়ামী লীগ ওয়াদাবদ্ধ।

জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততাঃ
ঈশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিকে জলাবদ্ধতা এবং লবনাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা ত্বরাম্বিত করা হবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততা আক্রান্ত জমি পুনরুদ্ধার করা হবে।

বিদ্যুৎ শক্তিঃ
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অত্যুক্তি করার অবকাশ নাই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরাম্বিত করার কাজে বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহারের অবকাশ অপরিসীম।
পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কারণ, এর ফলে কেবল ব্যাপক আর্থিক লাভই হবেনা, অধিকন্তু এর সাহায্যে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক পদ্ধতি শিক্ষাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যও অর্জিত হবে এবং আমাদের গ্রামবাসীরা বিংশ শতাব্দীর একটা মৌলিক সুখ স্বাচ্ছন্দও ভোগ করতে পারবে। পল্লী বৈদ্যুতিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ট্রান্সমিশন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি অবশ্যই করতে হবে।
সর্বাধিক পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের উদ্দ্যেশ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের প্রত্যেকটি উৎসের সদ্ব্যবহার করা হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে আগামী ৫ বৎসরের মধ্যে ন্যূনপক্ষে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণের উদ্দ্যেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ইউনিটের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ানো হবে। রূপপুর আনবিক শক্তি প্রকল্প ও জামালগঞ্জ কয়লা খনি প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদঃ
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের ব্যাপারে ক্ষমাহীন অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। এই ব্যাপারে কোন রকম ব্যাপক পানি বা ভূ-তাত্ত্বিক জরিপও চালানো হয়নি। এই ধরণের জরিপের ফলে মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ পাওয়া যেতে পারে। কাজেই এইসব প্রাকৃতিক কার্যকরভাবে ব্যবহারে কর্মসূচি প্রণয়ণের জন্য অবিলম্বে এই ধরণে জরিপের কাজ আরম্ভ করা হবে।

নদী পরিচর্যা ও উন্নয়নঃ
পাকিস্তানের, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য নদ-নদী এক বিরাট প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে অন্যান্য সম্পদের ন্যায় একমাত্র গবেষণা ও অন্যান্য পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নদী সম্পদকে সমাজের প্রভূত কাজে লাগানো সম্ভব। কিন্তু এই ধরণের পরিকল্পনার অভাবে ভূমি ক্ষয়ের মতো সমস্যাগুলো গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে যে ক্ষমাহীন অবহেলা দেখানো হয়েছে অবিলম্বে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নদী-গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করে তার প্রতিকার করা দরকার। এ ইন্সটিটিউট পানি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা এবং নদী ট্রেনিং স্কীম গ্রহণের মাধ্যমে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদকে সমাজের প্রয়োজন মিটাবার কাজে লাগাবে।

মৎস্য সম্পদঃ
যে সমাজে শতকরা ৭০ জন লোক প্রোটিন সল্পতায় ভুগে সে সমাজে মৎস সম্পদের অসীম গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না। কাজেই সামদ্রিক মৎস সহ মৎস সম্পদের উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করা হবে। এই সেক্টর থেকে থেকে কেবল যে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রাই আয় হবে তা নয়, এ আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধার্থ মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রোটিনও যোগাবে। এই ব্যাপক পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে মৎস উন্নয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, মৎস বন্দর উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রে মৎস্য স্বীকার ও মোটার চালিত আভ্যন্তরীণ মৎস্য স্বীকার, নৌ-বহরের উন্নতি বিধান, মাছ রাখার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও বিতরণ ব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক মৎস চাষ ও উন্নয়ন।

গবাদি পশু, হাস-মুরগী এবং ডেইরী ফার্মিংঃ
গবাদি পশু উন্নয়ন এবং হাস-মুরগি ও ডেইরী ফার্মিং-এর প্রতিও নিদারুন অবহেলা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু, হাস-মুরগী ও ডেইরী ফার্মিং এর উন্নয়নকল্পে দেশের সকল অঞ্চলে ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হবে।

শ্রমিকদের অধিকারঃ
আন্তজাতিক শ্রম সংস্থার ঘোষণা মোতাবেক শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার, যৌথ দরকষাকষির অধিকার এবং ধর্মঘটের অধিকার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিকদের এই ধরণের অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে প্রণিত সমস্ত আইন বাতিল করা হবে।
সরকার যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য স্বার্থ উন্নয়নে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং সেই সঙ্গে শিল্প উৎপাদন উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে মৌলিক সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে সেজন্যে সরকারের শ্রম সংক্রান্ত সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রের পুনর্বিন্যাস করা হবে।
সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা এবং শ্রমিকদের জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউশান প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করবে এবং ট্রেনিং ইন্সটিটিউশানে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য শিক্ষা দেওয়া হবে।
শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী মূল বেতন দেওয়া হবে এবং চাকুরীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। একই কাজের জন্য পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সবাই সমান বেতন পায় তার ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারবর্গকে অবশ্যই নিম্নলিখিত মৌলিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে ঃ
১. বিনা ভাড়ায় বাসোপযোগী গৃহ।
২. বিনা খরচায় চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা।
৩. অসুস্থতার সময়ে পুরা বেতনে ছুটি।
৪. প্রত্যেক পুরা বছরের জন্য পুরা বেতনে এক মাসের ছুটি।
৫. অক্ষমতা ও অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
৬. নুন্যপক্ষে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় পর্যন্ত বিনা খরচে শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা।
৭. মহিলা শ্রমিকদের বেলায় পুরা সুযোগ-সুবিধাসহ মেটারনিটি ছুটি।
উপরোক্ত অধিকার সুনিশ্চিত করা ছাড়াও ন্যায় ও সাম্যপরায়ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালনার সঙ্গে শ্রমিকরা ক্রমেই বেশী করে সংযুক্ত হয়ে উঠবে।
এই একই সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিকরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তার মুনাফায় তাদের একটা অংশ পাওয়ার অধিকার থাকা উচিৎ। এতে উৎপাদন বৃদ্ধির অংশ শ্রমিকরাও পাবে।
সরকারী এবং আধা-সরকারী সংস্থাগুলোর চাকুরীরত শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী বেতন, চাকুরীর নিরাপত্তা এবং অসুস্থতা ও অবসরকালীন সুবিধাসহ কল্যাণমূলক সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

কর্ম সংস্থানঃ
বেকারত্বই নিকৃষ্টতম সামাজিক অবিচার। প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্য কর্মসংস্থানের সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা সমস্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। আমাদের সমাজের বিপুল জনসম্পদকে কাজে লাগাবার জন্য জনশক্তির ব্যাপক পরিকল্পনা আবশ্যক। সর্বাধিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যেসব মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তার কয়েকটি হলো ঃ
১. সড়ক নির্মাণ, সেচ ও পানি নিস্কাশন কাজ, স্কুলভবন নির্মাণ ও একই ধরনের অন্যান্য কাজের জন্য পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন।
২. শিল্প ও কৃষিতে অধিক উৎপাদন পদ্ধতির (labour intensive techniques) প্রবর্তন।
৩. পল্লী এলাকায় কুটির শিল্পগুলোকে ব্যাপক সাহায্য দান।

শিক্ষাঃ
আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সম্ভব করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
এই প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য অনেক বেশী সম্পদ বরাদ্দের প্রয়োজন। মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা চারভাগ এইখাতে নিয়োজিত করতে হবে। এই অধিক বরাদ্দ থেকে গৃহাদি নির্মাণ বাবদ অপেক্ষাকৃত কম খরচ করে শিক্ষকদের বেতনের স্কেল বাড়ানোর জন্য বেশী অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সকল শ্রেণীর জনসাধারণকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বর্তমানে মিশানারী স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ক্যাডেট কলেজ ইত্যাদির মতো কতিপয় উন্নত ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা তেমন হবে না। সারাদেশে এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য এইসব বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যাবে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণঃ
সমূলে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্দশ্যে নয়া কৌশল এবং প্রচলিত নিয়ম বহির্ভুত পন্থা অবলম্বনের দরকার হবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রদের নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের জন্য ‘জাতীয় সার্ভিস প্রোগ্রাম’ কাজে লাগানো এই ধরণের একটি পন্থা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ
সকলের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমকি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। আগামি পাঁচ বৎসরের মধ্যে এই লক্ষ্যে পোঁছা যাবে বলে আশা করা যায়। মাধ্যমিক শিক্ষা সকল শ্রেণীর জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনা হবে।

কারিগরি ও পেশাগত শিতকক্ষাঃ
সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমাজের প্রয়োজনের ছাচে ঢালাই করা হবে এবং এই ধরণের প্রয়োজন সম্পর্কে সুষ্ঠু জরিপের পরই কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউশন সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করা এবং মেধার ভিত্তিতে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের জন্য শিক্ষার পথ খুলে দেওয়া হবে। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা লাভের পথে দারিদ্র যেন বাঁধা হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। সকল ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে দ্রুততার সাথে সমগ্র পাকিস্তানে মেডিকেল কলেজ এবং কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেকগুলি নয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

শিক্ষকতা পেশাঃ
আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। এজন্য কেবল তাদের বেতনের স্কেল বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলেই চলবে না; সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা এবং সম্মানও দিতে হবে।

স্বাস্থ্যঃ
সমগ্র সমাজে একটি ব্যাপক স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা চালু করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অবিলম্বে প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে মেডিকেল কেন্দ্র এবং প্রত্যেক থানাকেন্দ্রে একটা করে হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। এই ধরণের মেডিকেল কেন্দ্র ও হাসপাতালে জরুরী ঔষধ-পত্র পাওয়া যাবে। প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য নুন্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের সাহায্যে পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জাতীয় সার্ভিস চালু করা হবে। এই সকল কেন্দ্রে নিয়োগের জন্য অধিক সংখ্যক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তার ছাড়াও মেডিকেল ট্রেনিং প্রাপ্ত কর্মচারীর প্রয়োজন হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আগামী পাঁচ বৎসরের মধ্যে কমপক্ষে প্রত্যেক গ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যক নলকূপ স্থাপনের লক্ষ্য থাকবে।
বসন্ত, যক্ষা এবং কলেরার ন্যায় প্রতিরোধযোগ্য রোগের টিকা এবং ইনজেকশন দানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

পরিবহণ ও যোগযোগঃ
পরিবহণ ও যোগাযোগ অর্থনীতির অন্যতম কাঠামো হওয়ায় এর উপর নজর দেওয়া জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থার উন্নতি বিধানকল্পে নিম্ন লিখিত নির্দিষ্ট লক্ষ্য গ্রহণ করা হবেঃ

সড়কঃ
ক. পুর্ব পাকিস্তান এবং পাঞ্জাবের অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এলাকা, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে পাকা সড়কের ব্যাপক সম্প্রসারণসহ শহর এবং বাজার কেন্দ্রগুলির সহিত গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বড় রাস্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী বহু ছোট রাস্তা নির্মাণ।
খ. ঢাকার সঙ্গে উত্তর বঙ্গের সমস্ত প্রধান শহরের যোগাযোগ সাধন করে ঢাকা-দিনাজপুর হাইওয়ে নির্মাণ।
গ. ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে প্রশস্তকরণ।

সেতু ও সুড়ঙ্গ –পথঃ
ক. উত্তর বঙ্গের সাথে প্রদেশের অন্যান্য স্থানের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে যমুনার উপর সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
খ. পাঞ্জাবের ডুড়িয়া খান এবং ডেরাগাজিখানের নিকট সিন্ধু নদীতে এবং সিন্ধুতে সিন্ধু নদীর গুরুত্বপুর্ণ স্থানগুলোয়, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হবে।
গ. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিধানকল্পে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করতে হবে।

রেলওয়েঃ
রেলওয়ে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন স্কীমে পাকিস্তানের সকল রেলওয়েতে নিম্নশ্রেণীতে ভ্রমণকারী যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হবে।

বন্দরঃ
সামদ্রিক এবং আভ্যন্তরীণ নদী বন্দর- উভয় প্রকারের বন্দরের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বেলুচিস্তানের বন্দরগুলির উন্নতিবিধান করা হবে। করাচি বন্দরের বর্তমান সুযোগ-সুবিধার উন্নতিবিধান করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতা দ্বিগুন করা হবে এবং চালনা বন্দরের ক্ষমতা যথেষ্ট বাড়ানো হবে।

বাসস্থানঃ
আশ্রয় মানুষের জীবনের একটি মৌলিক প্রয়োজন। নিম্ন আয়ের লোক এবং পল্লীবাসীদের জন্য বাস্থানের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রমিকদের জন্য মালিকদের দ্বারা বাস্থানের ব্যবস্থার স্কীম ছাড়াও সরকার বাসস্থান উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ক. শহরগুলিতে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য আবাসিক উইনিট নির্মাণ।
খ. পল্লী এলাকায় বাসস্থান নির্মানের জন্য পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনায় সদ্ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষা পাওয়ার জন্য পল্লী এলাকায় গৃহ নির্মানের নয়া মডেল প্রবর্তন।

নারী সমাজঃ
আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অধেূক নারী। প্রধানতঃ শিক্ষার অভাবে তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে সামর্থ হচ্ছে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের সমান সুবিধা ভোগের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে যত তারাতারি সম্ভব তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। নারী সমাজকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারের গ্যারান্টি দেওয়া যাবে। সমান কাজের জন্য তাদের সমান বেতন দেওয়া হবে। মেধার ভিত্তিতে তাদের জন্য সকল সরকারী চাকুরীর দ্বার মুক্ত থাকবে।

যুব সমাজঃ
কর্মক্ষমতায় পরিপূর্ণ এবং আদর্শবাদী অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত আমাদের যুব সমাজ জাতির এক বিরাট সম্পদ। তাদের আদর্শবাদী অনুপ্রেরণা এবং কর্মক্ষমতাকে জাতি গঠনমূলক কাজের অভিসারী না করতে পারলে জাতীয় জীবনে চরম হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতি গঠনমূলক কার্যসূচির সঙ্গে দেশের যুব সমাজকে জড়িত করার অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা গঠন এবং সমবায় স্কিমের কথা বলা যেতে পারে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে একটা সার্ভিস কোর গঠন করে গ্রাম, কল-কারখানা এবং শহরের বস্তি অঞ্চলে এই ধরণের সেবার জন্য এদের প্রতি আহ্বান জানানো যেতে পারে।

ভাষা ও সংস্কৃতিঃ
পাকিস্তানের দুইটি রাষ্ট্রভাষা (বাংলা ও উর্দু) যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরেজীর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাকিস্তানের সকল এলাকার ভাষা এবং সাহিত্যের উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে।

মোহাজেরঃ
মোহাজেরদের স্থায়ী বসতি এবং অর্থনৈতিক পূণর্বাসনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারা যাতে অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সকল ব্যাপারে নিজেদের সমান বলে অনুভব করতে পারে এবং অন্য সকর নাগরিকের সহিত সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের ক্রমান্বয়ে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে একীভূত করে নিঃশেষে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হলো আমাদের লক্ষ্য। যত শীঘ্রই সম্ভব পুনর্বাসনের ব্যাপারগুলো চূড়ান্ত করা হবে।

উপজাতীয় এলাকাঃ
দেশের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সকল ব্যাপারে উপজাতীয় এলাকার জনসাধারণ যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে উপজাতীয় এলাকাগুলোকে দেশের বাকী অংশের সঙ্গে সম উন্নয়ন পর্যায়ে আনার জন্য সব কম প্রচেষ্টা চালানো হবে।

বৈদেশিক নীতিঃ
আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বের ভিত্তিতেই আমাদের বহিঃসীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নই নয়, আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের প্রশ্নও জড়িত রয়েছে।

স্বাধীন, জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিঃ
আমাদের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা একটি স্বাধীন, জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য ওয়াদাবদ্ধ। স্বীকার করতে হবে যে এতদিন যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি অনুসৃত হয়েছে তার সঙ্গে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাবেক নীতির ফলে বৈদেশিক সাহায্য এবং ঋণের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঋণ ও দেনার বোঝা বেড়ে গেছে। বিদেশের উপর এই ধরণের নির্ভরশীলতা আভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আপোষ নীতি গ্রহণে মারাত্মকভাবে বাধ্য করে। ফলে জাতীয় স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পরে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে নয়া কলা-কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এই পরস্পর বিরোধী নীতির অবসান ঘঁটানোই আমাদের লক্ষ্য। এর ফলেই আমরা সত্যিকারভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে সক্ষম হব।

শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানঃ
“সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়”-এই নীতির অনুসরণে ন্যায় এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সহ সকল দেশের সঙ্গে শাস্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে আগ্রহী। এই উদ্দ্যেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য বিশ্বে বর্তমানে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে তার প্রতি আকৃষ্ট হব না এবং আকৃষ্ট হওয়ার মনোবৃত্তিও আমাদের নেই।

বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানঃ
শান্তিপুর্ণ সহ-অবস্থানের ললক্ষ অনুযায়ী আমরা সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত মীমাংসার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেব।

কাশ্মীরঃ
জাতিসংঘের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কাশ্মীর বিরোধটির মীমাংসার উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। মৌলিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের জনসাধারণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।

ফারাক্কা বাঁধঃ
পূর্বেকার সরকারগুলোর ক্ষমাহীন অবহেলার ফলেই ফারাক্কা বাঁধ বাস্তবে রূপলাভ করতে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রতি মারাত্মক ও স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য অবিলম্বে পররাষ্ট্রনীতির সকল হাতিয়ারকে কাজে লাগাতে হবে।

সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তি ত্যাগঃ
সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তিতে চির আবদ্ধ হয়ে থাকাকে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি বলে বিশ্বাস করি এবং এই কারণেই আমরা সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তি থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানের বেরিয়ে আসার পক্ষপাতী।

জাতিসংঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাঃ
আমরা জাতিসংঘ সনদে সন্নিবিষ্ট নীতিগুলো, বিশেষ করে মানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকার এবং সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সাম্যের ব্যাপারে আমাদের শর্তহীণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করছি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানব কল্যাণের ব্যাপারে আমরা জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানাব।

সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ
আমরা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থণ ঘোষণা করছি।
 
১৯৭১ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আজ মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন ১২:১ মিনিটের সময়। আমরা মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে এসেছি। বাঙ্গালীরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে যে রক্ত দেয়া শুরু করেছে, সে রক্ত আজো শেষ হয় নাই। কবে শেষ হবে তা জানি না।
আজ শহীদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে, যে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার ভাইয়েরা আর শহীদ হবে না, গাজী হবে।
আমরা জানি, যে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৫২ সালে গুলে করে আমার ভাইদের শহীদ করেছিল, আজো তাদের কাজ শেষ করে নাই। ষড়যন্ত্র আজো চলছে, ষড়যন্ত্র ভবিষ্যতে চলবে। কিন্তু বাংলাদেশের চেহারাটা দেখে নাই। এ আন্দোলন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখে শুরু হয়। ১৯৫২ সালে আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে প্রমান করেছে, আমরাও বাংলা ভাষাকে অমর্যাদা করতে দেব না। রক্তের বিনিময়ে হলেও বাংলাকে স্বাধীকারকে দমাতে চায়, যারা আজ বাংলা সাংস্কৃতিকে, বাংলার মানুষকে আজ লুট করতে চায়, কলোনী করতে চায়, বাজার করতে চায়-এত বড় বিজয়ের পরও ষড়যন্ত্র করতে চায়। তাদের জেনে রাখা উচিৎ যে ১৯৫২ সালের বাঙ্গালী আর ১৯৭১ সালের বাঙ্গালীদের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই আপনাদের কাছে আমরা আবেদন আজ পবিত্র ভাষা দিবস, আজ আমি বেশি কিছু বলতে চাই না, আপনাদে সামনে এতটুকু বলতে চাই, আমাদের বাংলাদেশের ভাইয়েরা বোনেরা রক্ত দিয়ে দেখাইয়া গেছে দরকার যদি হয় আমরা বাংলার মানুষ রক্ত দিতে জানি।
আজ তাই এই শহীদ দিবসে শহীদদের আত্মার কথা মনে করে যারা শহীদ হয়েছে ১৯৫২ সালে, ১৯৫৪ সালের অত্যাচার, ৫৮ সালের প্রচার, ৬২ সালে শহীদ, ৭ই জুনের শহীদ, গত গণ আন্দোলনের শহীদ-যাদের চিনি না-নাম জানা অজানা কত ভাইদের রক্ত গিয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে শহীদ হচ্ছে। আজ মানুষ শুধু গুলি খেয়ে শহীদ হচ্ছে না, না খেয়ে শহীদ হচ্ছে। কাপড় পায়না, পেটে খাবার নাই, শোষণ করিয়েই যাচ্ছে, বাংলার মানুষকে বদার করেছে, বাংলার মানুষকে লুট করেছে। বাংলার মানুষকে পথের ভিখারী করেছে। আমরা কারো উপর বে-ইনসাফী করতে চাই না। পাঞ্জাবী তার অধিকার পাক, বেলুচিস্তান অধিকার পাক, আমিও বাঙ্গালী, আমিও আমার স্বাধীকার চাই-এখানে আপোষ নাই।
তাই আপনাদের কাছে আজকে আমি অনুরোধ করব, বাংলার ঘরে ঘরে যান। প্রস্তুত হয়ে যান। বাংলাদেশের ভাইয়েরা আর শহীদ নয়, বাংলার ছেলেদের গাজী হয়ে মা’র কোলে ফিরে যেতে হবে। শহীদ নয় গাজী। আর নয়। আমাদের ভাইদের কথা আমরা ভুলতে পারি না। যাদের মা আজো কাঁদে, যাদের বাপ আজো কাঁদে, যাদের ছেলে-মেয়ে আজো বাপ বাপ মা মা বলে চিৎকার করে বেড়ায়; তাদের আত্মা বাংলার ঘরে ঘরে, বাংলার দুয়ারে দুয়ারে আজকে আঘাত করছে, বলছে-বাঙ্গালী তুমি কাপুরুষ হইও না। বাংলায় তুমি জানের জন্য ভয় করনা। বাঙ্গালী তুমি সংগ্রাম করে এগিয়ে যাও। তাই শহীদ দিবসে আমরা শপথ নিয়েছি, রক্ত দেবো, দাবী ছাড়ব না। দাবী আদায় করে ছাড়ব।
আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল, ভাইয়েরা সামনে আরো কঠিন হবে বলে আমার মনে হচ্ছে- ষড়যন্ত্রকারীরা থামে না, তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সকলের সহযোগিতা ও ভাতৃত্ব কামনা করি। তার অর্থ এই নয় যে, আমার সাতকোটি মানুষকে তারা গোলাম করে রাখবে। তার অর্থ এই নয় যে আমার দেশকে কেউ গোলাম করে রাখবে। যে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষ একদিন আগরতলা থেকে আমাকে বের করে নিয়ে এসেছিল। আমি ওয়াদা করতে পারি তোমাদের কাছে, এই শহীদ দিবসে আল্লাহর নামে আমার রক্ত দিয়ে তোমাদের রক্তদান নিশ্চই শোধ করতে চেষ্টা করব।
তাই আজ আপনাদের কাছে বলে যাচ্ছি, জীবন মানুষ পয়দা হয় মৃত্যুর জন্য। বেঁচে আছি এতো একটা এক্সিডেন্ট। আজ ঘুরছি কালই মরে যেতে পারি। যারা মরে গেছে তারা পথ দেখিয়ে গেছেন। যারা শহীদ হবেন তারাও পথ দেখিয়ে যাবেন, ভবিষ্যৎ বংশধর-তারা বুক উচু করে দাড়িয়ে দুনিয়া ছেড়ে বলতে পারবে-আমি বাঙ্গালী, আমি মানুষ, আমার স্বাধীকার আছে, আমার অধিকার আছে। তাই আজকে শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, ঘরে ঘরে আপনারা দূর্গ গড়ে তুলেন। আমরা সকলের সহানুভূতি ভালবাসা চাই। কারো বিরুদ্ধে আমাদের হিংসা নাই। কেউ যদি অন্যায় করে আমাদের উপর শক্তি ব্যবহার করতে চায়-নিশ্চয়ই এদেশের মানুষ আর সহ্য করবে না। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল যতদিন পর্যন্ত বাংলা থাকবে, বাংলার আকাশ থাকবে, বাংলার মাটি থাকবে-বাংলার মাটিতে মানুষ বেঁচে থাকবে। ততদিন পর্যন্ত আমরা একুশে শহীদদের কথা কেউ ভুলতে পারব না। কারণ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এই ইতিহাস খুজে পাওয়া যায় না, আমার বাংলার মাটিতে ছাড়া। এ আন্দোলনে আমিও জড়িত ছিলাম। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ তারিখে আমি গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই। ১৯৫২ সালের ১৬ইং ফেব্রুয়ারি তারিখে অনশন ধর্মঘট করি আর আমার ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করি, তারা একুশ থেকে আন্দোলন শুরু করবে। ২৭ তারিখে আমাকে বের করে দেওয়া হয় জেল থেকে। আমি মরে যদি যাই জেলের বাইরে যেন মরি। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম, আজো জড়িত আছি। জানি না কতদিন থাকতে পারব। আমি প্রস্তুত আছি, তবে আপনাদের কাছে আমার বলার এইটুকু রইল যে এই বাংলা যেন আর অপমানিত না হয়। আর এই শহীদ যারা হয়ে গেছে তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি যেন আমরা না করি। মনে রাখবেন আপনারা নিশ্চই বিশ্বাস করেন এবং জানেন শহীদের রক্ত কখনোই বৃথা যায় নাই এবং যাবেও না ইনশাল্লাহ। তাই আপনাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি এই রাত্রি বেলা। জানি না কবে দেখা হয় আপনাদের সঙ্গে। আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান, ইনশাল্লাহ যখন রক্ত দিতে শিখেছি বাঙ্গালী তার দাবী আদায় করবে। আসসালামুয়ালাইকুম। শহীদ স্মৃতি অমর হউক।

সংগ্রহ-সিডি থেকে
 
 
১ মার্চ ১৯৭১, সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা


হোটেল পূর্বানী, ১ মার্চ ১৯৭১
আপনারা সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নামে প্রচারিত বিবৃতি শুনেছেন। সাধারণত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ তার কণ্ঠেই শোনা যেত। অথচ ও ক্ষেত্রে বিবৃতিটি অন্য কারো কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সকল এম.এন.এ এখন ঢাকায়, ভূট্টো ও কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানী এম.এন.এ অধিবেশনে যোগদান করে শাসনতন্ত্র রচনায় সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই মুহুর্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মূলতবি ঘোষণা সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক।
আমি আগে থেকে বলেছি, ষড়যন্ত্র চলছে। এই ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি এবং আমরা এর কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি সংখ্যালঘু দলের একগুয়ে দাবির ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে  ছেড়ে দিতে পারি না।
এর প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার ঢাকায় এবং পরশু সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শিগগিরই মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমিন, প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে আলোচনা করবো। আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
আমরা যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হয়েছি। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। কিন্তু পুরোনো ষড়যন্ত্র আবার শুরু করেছে। বাংলাদেশকে উপনিবেশ এবং বাজার হিসাবে শোষণ করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র। কিন্তু আমরা আমাদের সম্মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যাব। কারণ আমরা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আপনারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তবে সব রকম হিংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকবেন। আমাদের দল একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং আমরা শান্তি পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব।
জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরাই জনগণের কাছে দায়ী। শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনাব ভুট্টো- কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর সব দলের সদস্যরাই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ঢাকা আসতে আগ্রহী ছিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর পর তার একটা নিজস্ব কার্যধারা রয়েছে। শাসনতান্ত্রিক বিল পেশের পর সেভাবেই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যেত। কিন্তু একটি দলের আবেগে সাড়া দিতে গিয়ে তা বানচাল করা হয়েছে। জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পরিষদ সদস্যকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি আইন নিজ হাতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে তো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না? তবে কি আইন সব দরিদ্র বাঙালিদের জন্যে।
আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আহ্বানের দাবী করেছিলাম। সেই সময়ে জনাব ভুট্টো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আহ্বানের দাবী জানান এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনে তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। আমি পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে আমার মত ঘোষণা সত্ত্বেও জনাব ভুট্টো স্থগিত রাখার দাবী জানান এবং সেটাই করা হচ্ছে। এর অর্থ কি এই নয়, কর্তৃপক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাশুরুর মতই গৃহীত হয় এবং আমরা সংখ্যাগুরু।
বাঙ্গালিদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করছি। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমি পাঞ্জাব, সিন্ধু বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অনুরোধ করবো। প্রদেশে বসবাসকারী অবাঙ্গালিরা এদেশেরই সন্তান। জনগণের সংগ্রামে তাদেরও অবশ্যই যোগ দিতে হবে। জনগণ ৬-দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। দাবী আদায়ের জন্য এগিয়ে গেলে কেউ আমাদের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তার পরিণতির জন্য তারাই দায়ী থাকবেন।

[সূত্র ঃ পূর্বদেশে, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রাম, ২মার্চ, ১৯৭১] 
 
 
১৯৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সামনে হরতাল পালনে ঘোষণা দেন

[১ মার্চ, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ‘পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে, বলে কারণ দেকানো হয়। বাংলাদেশের জনসাধারণ ও ঘোষণার সাথে সাথে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঢাকায় শত শত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল বেরিয়ে যায়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। মিছিলকারীরা ভুট্টো বিরোধী এবং বাংলার স্বাধিকার দাবিতে স্লোগান দেয়। সে সময়ে ঢাকায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলছিল। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের জন্যে হোটেলের সামনে সমবেত হয়। হিংসাত্মক ঘটনার আশঙ্কায় তিনি জনগণকে শান্ত করতে চাইলেন। হোটেলে সমবেত সাংবাদিকদের কাছে তিনি তাঁর কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে তিনি হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের সামনে দেয়া ঘোষণার অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]
আপনারা সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নামে প্রচারিত বিবৃতি শুনেছেন। সাধারণত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ তাঁর কণ্ঠেই শোনা যেত। অথচ এ ক্ষেত্রে বিবৃতিটি অন্য কারো কন্ঠে প্রচারিত হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সকল এম,এন,এ, এখন ঢাকায়, ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানী এম.এন.এ অধিবেশনে যোগদান করে শাসনতন্ত্র রচনায় সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই মূহুর্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
আমি আগে থেকেই বলেছি, ষড়যন্ত্র চলছে। এই ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি এবং আমরা এর কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি সংখ্যালঘু দলের একগুঁয়ে দাবির ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে-এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে পারি না।
প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় এবং পরশু সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শিগগিরই মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমিন, প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে আলোচনা করবো। আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
আমরা যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হয়েছি। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। কিন্তু পুরোনো ষড়যন্ত্র আমার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে উপনিবেশ এবং বাজার হিসাবে ঘোষণা করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র। কিন্তু আমরা আমাদের সম্মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যাব। কারণ আমরা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আপনারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তবে সব রকম হিংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকবেন। আমাদের দল একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং আমরা শান্তি পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব।
জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরাই জনগণের কাছে দায়ী। শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনাব ভুট্টো-কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর সব দলের সদস্যরাই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ঢাকা আসতে আগ্রহী ছিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর পর তার একটা নিজস্ব কার্যধারা রয়েছে। শাসনতান্ত্রিক বিল পেশের পর সেভাবেই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যেত। কিন্তু একটি দলের আবেগে সাড়া দিতে গিয়ে তা বানচাল করা হয়েছে। জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পরিষদ সদস্যকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি আইন নিজ হাতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না? তবে কি আইন সব দরিদ্র বাঙ্গালিদের জন্যে?
আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আহ্বানের দাবি করেছিলাম। সেই সময়ে জনাব ভুট্টো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আহ্বানের দাবি জানান এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। আমি পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে আমার মত ঘোষণা সত্ত্বেও জনাব ভুট্টো স্থগিত রাখার দাবি জানান এবং সেটাই করা হচ্ছে। এর অর্থ কি এই নয়, কর্তৃপক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করছেন? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরুর মতই গৃহীত হয় এবং আমরা সংখ্যাগুরু।
বাঙ্গালিদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না আমরা ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিন্তান ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অনুরোধ করবো। প্রদেশে বসবাসকারী অবাঙ্গালিরা এদেশেরই সন্তান। জনগণের সংগ্রাম তাঁদেরও অবশ্যই যোগ দিতে হবে। জনগণ ৬-দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। দাবি আদায়ের জন্য এগিয়ে গেলে কেউ যদি আমাদের পথে অনরায় সৃষ্টি করে, তার পরিণতির জন্য তাঁরাই দায়ী থাকবেন।

[সূত্রঃ পূর্বদেশ, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রাম; ২ মার্চ, ১৯৭১] 
 
 
১৯৭১ সালের ২ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের তীব্র নিন্দ্রা প্রকাশ করে বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা বিক্ষোভ মিছিলে সয়লাব হয়ে যায়। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে রাত্রে মানুষের ঢল নামে। জনগণের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি ঢাকাকে প্রকম্পিত করে তোলে। সেনাবাহিনী জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি ছোড়ে। এতে কয়েকজন নিরস্ত্র মানুষ নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। মধ্যরাত পর্যন্ত অন্তত তিনজনের লাশ এবং আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে আনা হয়। ২ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু গুলিবর্ণের ঘটনার নিন্দা করেন। তাঁর বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ দেয়া হলো।]
আজ এখানে নিরস্ত্র বালকের উপর গুলি চালানো হয়েছে। এতে কমপক্ষে ২ ব্যক্তি নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হন। তাদের উপর গুলি চালানো হয়েছে, কারণ তারা বাংলাদেশের প্রতি এক চরম অবমাননার বিরুদ্ধে সারা বাংলারই অপরাপর জনমানুষের সাথে একাত্ম হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সে যে কোন অবমাননা করুক না কেন। আমি এই গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাই এবং যারা শক্তি দিয়ে জনগণ মোকাবিলা করতে চান, তাদের এই ধরনের বেপরোয়া পথ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদন জানাচ্ছি, তাদের খেয়াল রাখা উচিত যে, নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ গণহত্যার শামিল এবং সেটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধও বটে।
তাদের জানা উচিত, বাংলাদেশে যদি আগুন জ্বলে ওঠে তবে তারা এর শিখা এড়াতে পারবেন না। এই ধরনের সংঘাত অব্যাহত থাকলে আগুন জলবেও। আমরা বাংলাদেশের ৭ কোটি লোকের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিনিধিদের সাথে ৩ মার্চ অধিবেশনে বসতে রাজি ছিলাম। প্রকৃত পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রতিনিধি এর মধ্যেই এ ব্যাপারে ঢাকা এসে পৌঁছেছিলেন।
কিন্তু এক আকস্মিক হস্তক্ষেপের ফলে এই অধিবেশন স্থগিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী দলের ত্রাণকারীরূপে একটি সংখ্যালঘু দল এ হস্তক্ষেপে উৎসাহ দেয়। তারা জানায় যে, একমাত্র তাদের আরোপিত শর্ত ছাড়া অধিবেশন হতে পারবে না। এমন কি তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রতিনিধি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় দেখায়।
একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নিদের্শক্রমে সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিদলের অধিকার অস্বীকার জনগণের প্রতি দুঃসহ অপমান ছাড়া আর কিছুই না।
বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের নির্দেশ কিংবা ভীতির কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নয় বলে বর্তমানে শক্তি দিয়ে তাদের মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা মর্মান্তিক যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বহনের জন্য যে বিমানগুলো ব্যবহার হতে পারত তা এখন সামরিক অফিসার ও সেনাবাহিনীর লোকদের অস্ত্রশস্ত্র বহণ করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সাত কোটি বাঙ্গালিকে দমনের উদ্দেশ্যে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকলে জনগণ গতকাল থেকে সরব বাংলাদেশে স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বাঙ্গালিরা আর নির্যাতিত হতে রাজি নয় এবং তারা একটি স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হতে প্রস্তুত নয়। এই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে সরকারী কর্মচারীসহ সব শ্রেণীর বাঙ্গালির পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে গণবিরোধী শক্তিকে কোনভাবে সহযোগিতা না করা এবং বস্তুত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা। এখন যেহেতু প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন- তাঁরাই সব কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস। সব কর্তৃপক্ষই এই সত্যটির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন আশা করি।
এরকম পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন বা সামরিক আইন আর অব্যাহত রাখার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। আমি তাই অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সংঘাতের আশু অবসান ও জনপ্রতিনিধিদেরকে ক্ষমতা প্রয়োগের বাঁধা অপসারণের দাবি জানাচ্ছি।
উপরোক্ত দাবি পূরণ না হওয়া এবং বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
আমি আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচী ঘোষণা করছি এবং আমাদের জনগণকে নিম্নোক্ত নির্দেশ দিচ্ছি :
(ক) কাল ৩ মার্চ থেকে আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সরকারী অফিস, সেকেটারিয়েট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য কোর্ট-কাচারি, স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশন, পিআইএ, রেলওয়ে ও অন্যান্য যোগাযোগ সংস্থা, পরিবহন, সরকারী ও বেসরকারী কল-কারখানা, ফ্যাক্টরি, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থা ও বাজারসহ সর্বত্র হরতাল যা যা হরতালের আওতার বাইরে থাকবে সেগুলো হলঃ এম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ সংস্থা।
শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখলভাবে হরতাল পালন এবং লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অবাঞ্ছিত ঘটনা যাতে না ঘটে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সকলের প্রতি সর্তক থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রত্যেকে, তা তাঁরা যেখানকারই হোন না কেন বা যে ভাষায়ই কথা বলুন না কেন, তাঁরা আমাদের কাছে বাঙ্গালি। তাঁরা নিজেরা, তাঁদের সম্পত্তি ও ইজ্জত আমাদের পবিত্র আমানত এবং এসব অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
(খ) ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কথা ছিল। এই দিন এখন জাতীয় শোখ দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই উপলক্ষে বিকেল ৪ টায় ছাত্রলীগের জনসভার অব্যবহিত পর পল্টন ময়দান থেকে এক মিছিলের আমি নেতৃত্ব করবো।
(গ) রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্রসমূহ ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য বা বিবৃতি পেশ না করলে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত সকল বাঙ্গালি বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করবেন।
(ঘ) ৭ মার্চ বিকেল দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে এক জনসমাবেশে আমি বক্তৃতা করবো। তখন পরবর্তী কর্মপন্থা জানানো হবে।
(ঙ) আমি শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের সাধারণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, কোন প্রকার শৃঙ্খলা ভঙ্গ আমাদের আন্দোলনের স্বার্থের পরিপন্থি হবে এবং উস্কানিদাতা ও গণবিরোধী চক্রের স্বার্থের অনুকুল হবে।

[সুত্র ঃ আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তান, ৩ মার্চ, ১৯৭১]
 
 
১৯৭১ সালের ৩ রা মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকায় ১০ ঘন্টার জন্যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জনগণ তা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় অসংখ্য মিছিল বের করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দেয়। সান্ধ্য আইন ভঙ্গকারীদের লক্ষ্য করে সেনাবাহিনী গুলি ছোড়ে। এতে বহু হতাহত হয়। সংবাদপত্রে এতদসংক্রান্ত সংবাদ ও ছবি ছাপার ওপর সেন্সরশিপ ও সামরিক আইন বিধি জারি করা হয়। ৩ রা মার্চ সারা বাংলাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। এ জনসভা ছিল তৎকালের এক জঙ্গি সমাবেশ। মিছিল-সমাবেশের অগণিত নারী-পুরুষের হাতে বাঁশের লাঠি, বল্লম, লোহার রড, টেটা আ তলোয়ার ছিল। উল্লেখ্য, ছাত্র সমাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]
গতকাল আর আজ এই শহরের অলিতে-গলিতে শত শত নিরপরাধ মানুষকে গুলি করা হয়েছে। অনেকে আহত এবং নিহত হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকান্ড যাঁরা করছেন, তাঁদের সতর্ক করে দিতে চাই, হত্যা করে এ আন্দোলন থামানো যাবে না। ৭ কোটি মানুষকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আমাদেরকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নাই, কারণ আমরা প্রাণ দিতে জানি। আমরা মারা গেলেও বাংলার মানুষের স্বাধিকার অর্জিত হবে।
সেনাবাহিনীর কাজ বিদেশী শত্রুর মোকাবিলা করা, ভাইকে হত্যা করা নয়। গুলি করার জন্যই আমাদের করের পয়সার আপনাদের অস্ত্র দেয়া হয়। মেহেরবানি করে আপনারা ব্যারাকে ফিরে যান। আমার মানুষ শান্তি পূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
বাঙ্গালির উপর গতরাতে যে নির্মম হর্ত্যাকান্ড চালানো হয়েছে, তারপর আর স্থির থাকা যায় না। নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে হত্যার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই, এটা কাপুরুষতা। গতকাল রাতে নিজ কানে আমি মেশিনগানের গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছি।
দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য বাংলার মানুষ বা আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। এ অবস্থায় আমরা সৃষ্টি করিনি। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কথা শোনা হয়নি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের অনুরোধ জানাই। কিন্তু জনাব ভুট্টো তাতে অসম্মতি জানিয়ে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন আহ্বানের কথা বলেন। তাঁর কথামত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের কথা ঘোষণা করেন। আমরা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা অনুযায়ী পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি নেই। কিন্তু জনাব ভুট্টো আবার এই অধিবেশন পিছিয়ে দেবার দাবি তোলেন। আমরা অধিবেশন বাতিল না করার জন্য বলি। জনাব ভুট্টো তখন শুধু অস্বীকৃতিই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের আগুন জ্বালাবেন বলে হুমকি দিলেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে ৭ কোটি বাঙ্গালির বিরুদ্ধে অন্ত্র ধারণ করা হলো। এর থেকে বড় লজ্জার আর কিছু নাই।
যারা বাংলার স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন নস্যাৎ করতে চায়, তারাই হরতালের সুযোগে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও দাঙ্গা করছে। যদি আপনারা আমাকে ভালবাসেন, যদি সংগ্রামে জয়ী হতে চান, তাহলে আপনারা এসব লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও গুন্ডামিকে দৃঢ়তার সাথে বাঁধা দেবেন। বাঙ্গালি হোক, বিহারী হোক, স্থানীয় হোক আর বহিরাগত হোক-সবাই আমাদের জিম্মায়, এদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। তাই শান্তিপূর্ণভাবে শৃঙ্খলার সাথে গণআন্দোলনের লক্ষ্যপথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। শৃঙ্খলার সাথে আন্দোলন না করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হবে। আপনারা হলেন একটি সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাবাহিনী। যে নির্দেশ দেব তা তালিম করবেন।
আমি আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জনতার সামনে আসতে বাধ্য হয়েছি। ইচ্ছা ছিল ৭ মার্চ সব কথা বলবো। কিন্তু পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে আবার ছাত্রলীগের সভায় এসেছি। জানি না আপনাদের সামনে আর বক্তৃতা করতে পারবো কি পারবো না। তাই আজ স্পষ্টভাবে আমি আমার কর্মসূচি জানিয়ে দিতে এসেছি।
যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে এবং ভোট দিয়েছে-আমি মরে গেলেও আমার আত্মা তাদের সুখ ও সমৃদ্ধি যখন দেখতে পাবে, তখন শান্তি পাবে। ৭ কোটি মানুষের হত্যা করতে পারবেন না। আমি না থাকলেও বাংলার মানুষ তাদের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যাবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত, সাধারণ মানুষ আমাদের ভাই, আমরা তাদের সাথে থাকতে চাই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা তা চান না। গত ২৩ বছর বাংলাদেশকে শোষণ করে ছোবড়া বানিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ বাংলার মানুষের সাথে থাকতে চান না।
সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা নির্ভীকভাবে সকল খবর পরিবেশন করবেন। যদি আপনাদের কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করা জয়, আপনারা তা মানবেন না। সংবাদপত্র মালিক যদি এতে বাঁধা দেয় তাহলে চাকা বন্ধ করে দেবেন।
আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। এই সময়ে কোর্ট-কাছারি, অফিস-আদালত, সরকারী অফিস, কল-কারখানা, রেল, স্টীমার, বিমানসহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে। সরকারী কর্মচারীবৃন্দ অফিস-আদালতে যোগ দেবেন না। সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সকল প্রকার ট্যাক্স ও খাজনা প্রদান থেকে প্রত্যেকে বিরত থাকুন। আমি সংবাদপত্র, এম্বুলেন্স, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, বন্ধ না করার নিদের্শ দিয়েছি। এই কয়দিনের মধ্যে যদি সরকারী মনোভাব পরিবর্তন না হয়, তাহলে ৭ মার্চ আমি আমার যা বলার তা বলবো। হরতাল চলাকালে সকলে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করবেন এবং বেলা ২টার পর রিকশাওয়ালাদের বেশি পয়সা দিবেন। হাসপাতালে গুলির আঘাত আহত ব্যক্তিদের জন্য ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানেরও আমি জরুরি আহ্বান জানাই।
আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চাই। মনে রাখবেন আমি জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। রক্তের বিনিময়ে হলেও দুঃখী জনগণের বিশ্বাস অক্ষুন্ন রাখবো। যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও বেঈমানী করবো না।
[সূত্র ঃ সংগ্রাম, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও আজাদ; ৪ মার্চ, ১৯৭১] 
 
 
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে এক ঘোষণায় বলা হয় যে, একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাহায্য করতে প্রেসিডেন্ট তাঁর সাধ্যানুযায়ী সবকিছুই করবেন বলে গত ১ মার্চ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঢাকায় এক বৈঠকে মিলিত হবার জন্যে জাতীয় পরিষদের সকল পালামেন্টারী গ্রুপের নেতাদের কাছে জরুরী ব্যক্তিগত আমন্ত্রণলিপি পাঠিয়েছেন। আগামী ৮ মার্চ পবিত্র আশুরার দিন হওয়ায় আগামী ১০ মার্চ এ সম্মেলনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর প্রেসিডেন্ট তার কোন কারণ দেখাচ্ছেন না। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এ আমন্ত্রণকে ‘নিষ্ঠুর তামাশা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃত্তির মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ উদ্ধৃত হলো।]
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় যে মুহুর্তে ব্যাপকভাবে নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হচ্ছে, যে সময় আগামী ১০ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলনে মিলিত হবার প্রস্তাবিত আমন্ত্রণ বেতারে ঘোষণা করা হয়। এখানো যখন বিভিন্ন সড়কে শহীদদের রক্ত শুকিয়ে যায়নি, এখনো যখন কিছু কিছু লাশ কবর না দেয়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং শত শত ব্যক্তি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করছে, সে সময় একটি নিষ্ঠুর পরিহাসের মত এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আর এমন কিছু ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হবার জন্য এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যাদের দূরভিসন্ধিই নিরপরাধ ও নিরস্ত্র কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ আমাদের কানে এখনো যে অস্ত্রের কর্কশ ভাষা শোনা যাচ্ছে, তাতে এই ‘আমন্ত্রণ কার্যত বন্দুক উঁচিয়েই জানানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাই আমি এ ধরনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলাম।
[সূত্র ঃ দৈনিক সংগ্রাম; ৪ মার্চ, ১৯৭১]

 ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বান

[১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রাতে ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জনগণ আবার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে এবং সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করে গুলিবর্ষণে ঢাকায় অন্তত ২৩ জন নিহত ও ৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়। চট্টগ্রামে ১২১জন নিহত ও অগণিত মানুষ আহত হয়। ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু জনগণকে আহ্বান জানান। তাঁর অভিনন্দন বার্তার বর্ণনা নিম্নরূপ ছিল।]
শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং আমাদের আহ্বানে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশু যে স্বতস্ফুর্ত সাড়া দিয়েছেন, তার জন্য আমি আমাদের বীর জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ, যেমন-শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্ররা তাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে বুলেটের সামনে যে সাহস ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, বিশ্বের জনগণের তা জানা দরকার।
ক্রমাগত হরতালের ফলে জনগণকে যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা সহ্য করার জন্যও আমি আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাদের অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে চরম আত্মত্যাগ ব্যতীত কোন জনগণই মুক্তি পায়নি। কাজেই জনগণকে যে কোন মূল্যে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পাঁচ ও ৬ তারিখের ৬ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত থাকবে। তবে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছেঃ
১. যে সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী অফিসে কর্মচারীদের এখনো বেতন দেয়া হয়নি, সে সমস্ত অফিস কেবল কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জন্য বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বেতনের চেকের টাকা প্রদান এবং বাংলাদেশের মধ্যে নগদ অর্থ আদান-প্রদানের জন্য ব্যাংকগুলো উক্ত সময় (বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা) খোলা থাকবে। ষ্টেট ব্যাংকের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বেতনের ব্যাপারে বাংলাদেশে অনুর্ধ্ব দেড় হাজার টাকার চেক ষ্টেট ব্যাংক থেকে ভাঙ্গানো যাবে; তবে ষ্টেট ব্যাংকের মারফত বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাইরে কোন টাকা পাঠানো যাবে না। রেশনের দোকান বা খাবার সরবরাহকারীদেরও তাদের ব্যবসার জন্য এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
২. নিম্নলিখিত অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসগুলোকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছেঃ
(ক) হাসপাতাল ও ওষুধের দোকান (খ) এম্বুলেন্স গাড়ী (গ) চিকিৎসদের গাড়ী (ঘ) ডাক্তারদের গাড়ী (ঙ)সংবাদপত্র (চ) পানি সরবরাহ (ছ) গ্যাস সরবরাহ (জ) বিদ্যুৎ সরবরাহ (ঝ) স্থানীয় টেলিফোন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে ট্রাঙ্কল টেলিফোন (ঞ) দমকল (ট) ঝাড়–দার ও ময়লাবাহী ট্রাক।

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান; ৫ মার্চ, ১৯৭১] 
 
বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ 
আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয়-আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহি, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় বাংলার মানুষ আর তারা অধিকার। কিন্তু দুঃখের বিষয়-আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজ পথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমুর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি । ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুবখান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেয়া হলো এবং এর পর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বলেলেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন ,শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।

তারপরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সংগে আলোচনা হলো আমরা তাকে ১৫ ইং ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু 'মেজরিটি' পার্টিরনেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যা লঘুদলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই ,সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন। আমি বললাম ,তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হওয়া সত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজন ওহন। জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয় ; আরো আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ও মুফতি মাহুমুদ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারী নেতা এলেন ,তাদের সঙ্গে আলোচনা হলো-উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই ,এটা জনগণের সম্পদ। কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে 'ডবল জিম্মী' হতে পারবেন না। পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে,তাদের মাথা ভেঙে দেয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবেনা। তাসত্বেও পয়ত্রিশ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্ত পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলো , বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে, বলা হলো আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি।

এরপর বাংলার মানুষ প্রতি বাদ মুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তি পূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথেনেমে এলো। কিন্তু কি পেলাম আমরা ? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়েযে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে,আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলী। আমরা বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইয়াহিয়া খান বলেছেন ,আমি নাকি ১০ ই মার্চ তারিখে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তাঁর সাথে টেলিফোন আমার আলাপহয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেণ্ট , ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরীব জন সাধারণকে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে । আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না। কিসের গোলটেবিল বৈঠক ? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে ?

তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহবান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত ,খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো-কিন্তু গুলীকরে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলী খাই, দোষ আমাদের-আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের। ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্ত আমার দাবী সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসনো না। এ দাবী মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠেনা, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাবনা।

ভাইয়েরা , আমার উপর বিশ্বাস আছে ? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসীর কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনে ছিলেন। সে দিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম ,রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো; মনে আছে ? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারী, হাইকোর্ট , সুপ্রীমকোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। ট্রেন চলবে-তবে সেনাবাহিনী আনা-নেয়া করা যাবে না। করলে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না। সেক্রেটারীয়েট, সুপ্রীমকোর্ট ,হাইকোর্ট জজকোর্ট সহসরকারী, আধাসরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান প্রদানের ব্যাঙ্ক গুলো দুঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবেন না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। তবে, সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।

এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে , বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি একটিও গুলী চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবেনা। গুলী চালালে আর ভাল হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবা না। বাঙ্গালী মরতে শিখেছে , তাদের কেউ দাবাতে পারবে না।

শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামীলীগ সাহায্যে কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন। সাত দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি শিল্পমালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন, আন্দোলন কিভাবে করতে হয় আমি জানি। কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্ম কহলের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী,হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।

রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোন বাঙ্গালী রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না। শান্তিপূর্ণ ভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না , মুখ দেখা দেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবেনা। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃংখলা বজায় রাখুন। শৃংখলা ছাড়াকোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি , রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শৃংখলা বজায় রাখুন। শৃংখলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ।
 
৭ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি
 

[১৯৭১ সালের ৬ ও ৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসভবনে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির রুদ্ধতার বৈঠক হয়। দুপুরে সামান্য বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক চলে। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে যাবার পূর্বে এই বৈঠক হয়। ছাত্র-জনতার দাবী অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু সভায় চারটি দাবী উত্থাপন করবেন বলে স্থির হয়। ৭ই মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে উত্থাপিত দাবী বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে এবং সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত উক্ত বিবৃত্তির পূর্ণ বয়ান উদ্ধৃত হলো।]
পহেলা মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র যারা জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্যে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের উপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে যারা প্রাণ দিয়েছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সেচ্ছাচারমূলক ও অযাচিত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়েই তারা শহীদ হয়েছেন। এই শহীদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বলে চিত্রিত করা সত্যের অপলাপ মাত্র। সত্যিকারের রাজত্ব কায়েমের জন্য যারা দায়ী বস্ততপক্ষে তারাই হচ্ছে আসল দুস্কৃতকারী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ অবস্থার অবতারণা করা হয়েছে তা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসার একটু সময় করতেও সক্ষম হয়নি। প্রেসিডেন্ট যাকে ‘ক্ষমতার নূন্যতম প্রয়োগ’ বলে অভিহিত করেছেন, তার ফলেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হয়ে থাকে, তাহলে কি আমাদের এটাই বুঝতে হবে যে, তিনি যাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রয়োগ’ বলবেন, তার লক্ষ হবে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এই নগ্ন হুমকির আমি নিন্দা করছি। জাতি অনেক অর্থব্যয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে বিদেশী হামলা প্রতিহত করার জন্য, বেসামরিক নারিকদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নয়। অপর অঞ্চলের উর্দি পরা সৈনিকরা যে বাড়াবাড়ি করছে, তারা দখলকারী বাহিনীর মতো যে ভূমিকা পালন করছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের আজ রক্ষা-ব্যবস্থা প্রয়োজন।
বলা হয়েছে যে, জাতীয় পষিদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে ভূল বোঝা হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য এবং একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ঘোষিত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু দলের একক খেয়ালের প্রতি সাড়া দিয়েই কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয় নাই?
আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারীর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিলাম। অপরদিকে উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপটি চেয়েছিলো মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিশেন হোক। এই সংখ্যালঘু গ্রুপটির মতের কাছেই নতি স্বীকার করা হয়েছে এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রথমত এই সংখ্যালঘু গ্রুপ একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য উত্থাপন করে বলেছে যে, ঢাকা এলে এর সদস্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা ডবল জিম্মি হয়ে যাবে। এরপর এই দল থেকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে, তারা যেসব শর্ত আরোপ করতে তা মেনে নিলেই শুধু তারা পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে। এরপর আরেক পর্যায়ে এই সংখ্যালঘু গ্রুপের সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নেয়। সবচেয়ে নিম্নতর তা হলো এই যে, উক্ত গ্রুপের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথেই আইনগত কাঠামো আদেশে আনা হলো একটি সংশোধনী। এতে বলা হলো পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সদস্যরা ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারবেন। কিন্তু এরপর উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিলেন পদত্যাগ না করার। এই দলের এই এলোপাতাড়ি ইচ্ছা অনিচ্ছা চরমে পৌঁছালে ২৭ ফেব্রুয়ারী। সেদিন এই দল থেকে ঘোষণা করা হলো যে, এই দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া যদি পরিষদের অধিবেশন বসে তাহলে এই দল একটি গণ-আন্দোলন শুরু করবে। এই দল এতদূর পর্যন্ত বলতে পারল যে, পরিষদের অধিবেশনে যারা যোগদান করবে, তাদের ওপর জনগণ পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে এবং জনগণ যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই দলটিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই দলটি থেকে আরো হুমিক দেয়া হয় যে, এই দলের কোন সদস্য যদি পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলীয় কর্মীরাই তাদের চিশ্চিহ্ন করে দেবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পার্লামেন্টারী পার্টি ঢাকায় সমবেত হন এবং পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও পরিষদ সদস্যরা ঢাকা আসতে শুরু করেন।
প্রধান নির্বাচনী কমিশনারও ঢাকা এসে পৌঁছেন এবং ২ মার্চ পরিষদের মহিলা সদস্যদের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের নিজেরও ১ মার্চ  ঢাকা আসার সম্ভাবনা ছিল।
শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের  নিজেদের অবস্থানও আমরা অত্যন্ত ষ্টুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছিলাম ২৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রদত্ত আমাদের বিবৃবিতে। এতে আমরা পাকিস্তানের প্রত্যক অংশ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিটি সদস্যকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এই ঐতিহাসিক কাজে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী আমরা এই পর্যন্ত বলেছিলাম যে, কোনো সদস্য নয় ও যুক্তিসঙ্গত কিছু পরিষদে উত্থাপন করলে আমরা তা মেনে নেবো। কিন্তু সে প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় এবং তা করা হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে।
পহেলা মার্চ থেকে বিবৃতিতে আকস্মিক ও অহেতুকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্র্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এজন্য অজুহাত দেখান হয়, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। বাংলাদেশের মানুষ কি এর থেকে মনে করতে পারে না যে, একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নির্দেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। তারা কি যুক্তিসঙ্গতভাবেই ভাবতে পারে না যে, একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করা এবং সংখ্যাগুরু জনসাধারষতে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য কতিপয় শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছে? দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে এসব সন্দেহ আরো দৃঢ়তর হয়ে উঠে। এতে প্রমাণ হয়, ‘রাজনৈতিক বিরোধ’ রূপ নিচ্ছে, যদি না সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর নির্দেশের কাছে মাথা নত করে।
কার্যত ২৪ ফেব্রুয়ারির বিবৃতিতে আরো হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম, যখনই আমাদের দেশে জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেছে, তখনই জঘন্য চক্রান্তকারীরা তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ গোটা কয় ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বানচাল করে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে বঞ্চনা করেছে। ১৯৫৩ সালে ক্ষমতাসীন পাঞ্জাবী জোটের চক্রান্তে বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। একই চক্র ১৯৫৪ সালে বাংলার নির্বাচন সরকার এবং খোদ গণ-পরিষদকেই কায়েমি স্বার্থ সেখানেও আবার আঘাত হানে এবং ক্ষমতা জবরদখল করে নেয়। কিন্তু তাদের এ কথা জেনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণ এবং পশ্চিমাঞ্চলে নির্যাতিত জনতা সম্ভাব্য সব উপায়ে তাদের এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করবেই।
সত্যের খাতিরে আমি পরিস্কারভাবেই বলে দিতে চাই, গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হোক, এ ধরণের কোন ধারণাই আমি দিই নাই। আমি প্রেসিডেন্টকে কেবল এই কথাই জানিয়ে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে কি মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা দেখা এবং যথেষ্টভাবে নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তার ঢাকা আসা উচিত। প্রেসিডেন্ট প্রস্তাবিত পূর্ববর্তী বৈঠকের ব্যাপারে ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমরা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, কয়েক সপ্তাহ আগেই কার্যনির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টরী বোর্ডের বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তখন আমাদের পক্ষে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া সম্ভব ছিলো না। অধিকন্তু আমরা এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, শাসনতান্ত্রিক সদস্যাদি গোপন আলোচনার বদলে জাতীয় পরিষদ ও তার কমিটিসমূহের মাঝেই সমাধান করা উচিত এবং একবার জাতীয় পরিষদ গঠিত হবার পর গোলটেবিল কিংবা গোপন বৈঠকের কোনো যুক্তিই নাই।
আওয়ামী লীগ কোনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে এ অবিযোগের জবাবেই আমি এসব বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করলাম। এ ধরণের বাঁধা সৃষ্টি থেকে যাদের ফায়দা হতে পারে সংখ্যাগুরু দল তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দেশের জনসাধারণ এবং কার্যত সারা বিশ্বের কাছেই এই আজ এ কথা পরিস্কার যে, পশ্চিমাঞ্চলের একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাঁধা সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিজে ও সংখ্যালঘু চক্রটির নির্দেশে নতি স্বীকার করাকেই তার নৈতিক কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন। একটি সংখ্যালঘু চক্র যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বানচাল করার জন্য কায়েমি স্বার্থের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়, তবে গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত যদি গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্তাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয় তবে তার দায়িত্ব এই সংখ্যালগু চক্র এবং তার সাথে চক্রান্তকারীদেরই বইতে হবে।
এসব মহলই কি সেই গুটিকয় লোক নয়, যারা একত্রে বসবাসের ভিত্তি উদ্ভাবনের জন্য  জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টার উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে। প্রতিটি সুস্থমনা ব্যক্তিই আজকে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্তু জনতাকে গুলি করে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সংহতি অকন্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করেছে, না অন্য কিছু? এ ভূমিকা নিয়ে যাবার পর এখন দেশে ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কোন ব্যক্তিবিশেষই নিজেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে দাবী করতে পারেন না।
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এই দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই একমাত্র বৈধ উৎস। গত সাত দিনের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলি মেনে চলেছে। প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদস্থ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। কাজেই জনগণের নির্বাচিত  প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ না করা বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এরপর আমাদের আসতে হয় আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথায়। আমরা বহুবার এ অধিবেশন আহ্বানে জরুরী প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছি। কিন্তু আজ এক অস্বাভাবিক এবং মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার নীতির অনুসরণে প্রকৃতপক্ষে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও বিশ্বের সর্বত্র সুবিবেক জনগণসহ সবদিক থেকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে বলে আওয়াজ তোলা হচ্ছে।
জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ভীতিপদ পরিবেশে কাজ করবে এটা আশা করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আমদানীসহ এই মোকাবিলাজনিত অবস্থা বজায় থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নির্যাতনের পরিবেশ অব্যাহত থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেসামরিক জনতার উপর প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর আসতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা বন্দুকের মুখে জাতীয় পরিষদে অধিবেশনে যোগদানের বিষয় বিবেচনা করবেন, এটা আশা করা যায় না।
যদি প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবে কামনা করেন যে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তাহলে অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ক. অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।
খ. বেসামরিক জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যাতে এখন থেকে একটা বুলেটও ছোড়া না হয়।
গ. সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং দেশের পশ্চিম অংশ থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য আমদানী অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
ঘ. বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন শাখায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না এবং সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আক্রমনজনিত শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে।
ঙ. আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ কেবলমাত্র পুলিশ ও বাঙ্গালি ইপিআর বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের উক্ত কাজে সহায়তা করবেন।
চ. অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
ছ. অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
যদি সামরিক মোকাবিলা চলতে থাকে এবং আমাদের নিরস্ত্র গনগণের ওপর বুলেট নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে সন্দেহের কোন অবকাশ না রেখে আমি বলতে চাই যে, সে অবস্থায় কোন জাতীয় পরিষদই কাজ করতে পারবে না।
আমাদের জনগণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা তাদেরকে আর উপনিবেশ অথবা বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। তারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হবার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছে। আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতি জনগণকে অনাহার, রোগ ও বেকারত্ব  থেকে বাঁচাতে হবে। উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ লোকের পুনর্বাসনের কাজ এখনো বাকি রয়েছে। যদি শাসকগোষ্ঠী এ সমস্ত আশা-আকঙ্খা ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে মুক্তির জন্যে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে জনগণও প্রস্তুত। যে মুক্তির জন্যে অনেক শহীদের রক্ত ঝরেঝে এবং যার জন্য বহু লোক আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জনগণের সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যাবে না।
আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনগণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তারা বীরত্বের সাথে বুলেটের মোকাবিলা এবং সুপরিকল্পিতভাবে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বাঙ্গালি ও তথাকথিত অবাঙ্গালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দালাল, উস্কানিদাতা ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের দূরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য আমি আমাদের জনগণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আবার বলছি যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি লোকেই বাঙ্গালি এবং তার শারীরিক নিরাপত্তা, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং যে কোন মূল্যে তা করতে হবে। আমাদের সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত না হয়, আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

আগামী এক সপ্তাহের কর্মসূচী
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছেঃ
১. খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোন কোন অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে।
৩. রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয় তাহলে রেলওয়ে শ্রমিকরা সহযোগিতা করবেন না।
৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সর্ম্পকে খবর গোপন করতে পারবে না, অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত বাঙ্গালিরা সহযোগিতা করবেন না।
৫. কেবল স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে।
৬. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৭. ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোন উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না।
৮. প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
৯. অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে যে কোন সময় উপরোক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষনা করা হতে পারে।
১০. প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ মার্চ-১৯৭১]
 
 
 
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু নির্দেশসহ দেয়া বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর ৮ মার্চ থেকে সারা বাংলাদেশে এক অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সরকারী-বেসরকারী সকল ভবন, শিক্ষা ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি যানবাহনে ছোট ছোট কালো পতাকা লাগানো হয়। বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য সব নির্দেশ পালিত হয়। লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারপতি অস্বীকৃতি জানান। প্রেসিডেন্ট ১০ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাঙ্গালী সামরিক অফিসারের পরিবারবর্গকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো শুরু হয়। বিদেশী নাগরিকগণও বাংলাদেশ থেকে সরে যেতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নির্দেশ জারি করে, এক অর্থে বাংলাদেশের প্রশাসনের ভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু নির্দেশাবলী যখন সংবাদপত্রে বিতরণ করা হয়, তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকার পথে ১৫ মার্চ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন। এর আগের দিন অর্থাৎ ১৪ মার্চ টিক্কা খান একটি সামরিক আইন আদেশ জারির মাধ্যমে সকল সরকারী প্রতিরক্ষা কর্মচারীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগ দেয়ার জন্যে বলা হয়। তাদের চাকরিচ্যুত করার এবং সামরিক আদালতে বিচারের হুমকিও দেয়া হয়। বাঙ্গালি কর্মচারীরা এ নির্দেশ উপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধুর ১৪ মার্চের বিবৃতি এখানে উদ্ধৃত হলো। এ বিবৃতির সাথে আলাদাভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ হিসেবে বিশদ ব্যাখ্যাসহ ৩৫টি নির্দেশ সংবাদপত্রে প্রেরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশও এতদসহ দেয়া হলো।]
জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। মুক্তিকামী মানুষ বিশ্বের সবখানে যাঁরা প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন মুক্তির জন্য, আমাদের সংগ্রামকেও তাঁদের নিজেদের বলে গণ্য করা উচিত। শক্তির সাহায্যে যারা শাসনের চক্রান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়সংকল্প ও সংঘবদ্ধ জনশক্তি কেমন করে মুক্তির দূর্জয় দূর্গ গড়ে তোলে, আমাদের জনগণ তা প্রমাণ করেছে।
আজ বাংলাদেশের প্রতিনি নারী-পুরুষ এমন কি শিশু পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহসে বলীয়ান। নগ্নভাবে শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে দলিত করার কথা চিন্তা করেছিল যারা, তারা নিশ্চিতই পরাভূত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ, সরকারী কর্মচারী, অফিস আর কল-কারখানার শ্রমিক, কৃষক আর ছাত্র সবাই দৃপ্তদম্ভে ঘোষণা করেছে-তারা আত্মসমর্পণের চেয়ে মরণ বরণ করতেই বদ্ধপরিকর।
এ বড় দুঃখজনক যে, এমন পর্যায়ে কিছু অবিবেচক মানুষ সামরিক আইন বলে নির্দেশ জারি করে বেসামরিক কর্মচারীদের একাংশকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ এ দেশের মানুষ সামরিক আইনের কাছে মাথা নত না করা দৃঢ়তায় একাট্টা। আমি তাই, সর্বশেষ নির্দেশ যাদের প্রতি জারি করা হয়েছে, তাঁদেরকে হুমকির কাছে মাথা নত না করার আবেদন জানাই। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে। তাদের ত্রাসিত করার উদ্দেশ্যে এই যে চেষ্টা তা বাংলাদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখাবার অন্যান্য সাম্প্রতিক চেষ্টার মতো নস্যাৎ হতে বাধ্য।
বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণ বরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনতা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আমি জনগণকে যে কোন ত্যাগের জন্য এবং সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে যে কোন শক্তির মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাচ্ছি।
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে যে নয়া কর্মসূচী শুরু হবে নির্দেশাবলীর আকারে তা বিশদভাবে নিচে উল্লেখ করা হলো। নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী কার্যকরী হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব ঘোষিত সকল নির্দেশ, অব্যাহতি ও ব্যাখ্যাসমূহ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

আগামী কর্মসূচি ঘোষণাঃ
১নং নির্দেশ
সরকারী সংস্থাসমূহ
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেকেটারিয়েটসমূহ, সরকারী ও বেসরকারী অফিসসমূহ, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহ, হাইকোর্ট এবং বাংলাদেশস্থ সকল কোর্ট হরতাল পালন করবে এবং নিম্নে বর্ণিত বিশেষ নির্দেশাবলী এবং বিভিন্ন সময়ে যেসব ছাড় ব্যাখ্যা দেয়া হবে তা সবই মেনে চলবেন।

২নং নির্দেশসমূহ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ
সমগ্র বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

৩নং নির্দেশ
আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা
(ক) ডেপুটি কমিশনারগণ ও মহকুমা অফিসারগণ তাঁদের কোন দপ্তর না খুলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন ও শৃক্ষলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং উন্নয়ন কাজও প্রয়োজন হলে এই সকল নির্দেশ কার্যকরী বা প্রয়োগ করার দায়িত্ব পালন করবেন। ডেপুটি কমিশনারগণ ও মহকুমা অফিসারগণ তাদের এই সব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নিবিড় সহযোগিতা বজায় রাখবেন।
(খ) পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রয়োজন বোধে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যোগ দেবেন।
(গ) জেলের দপ্তরে কাজ চলবে এবং জেল ওয়ার্ডরগণ তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে যাবেন।
(ঘ) আনসার বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।

৪নং নির্দেশ
বন্দর (অভ্যন্তরীণ বন্দরসহ)
বন্দর কর্তৃপক্ষ পাইলটেজসহ সকল কাজ করে যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কেবলমাত্র সেই সব অফিস খোলা থাকবে যেগুলো জাহাজসমূহের সহজ ও সুষ্ঠ আসা-যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু সৈন্য চলাচলে কিংবা সমরাস্ত্র আনানোর ও বাংলাদেশের মানুষকে নির্যাতনের জন্য সৈন্য ও সমরাস্ত্র না নেয়ার কাজে কোনভাবেই সহযোগিতা বা সাহায্য করা যাবে না। জাহাজসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খাদ্যবাহী জাহাজসমূহের মাল খালাস ত্বরান্বিত করার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর শুল্ক (পোর্ট ডিউজ) ও মাল খালাসের কর বা শুল্ক আদায় করবেন। অভ্যন্তরীণ বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর শুল্ক ও অন্যান্য শ্রল্ক আদায় করবেন।

৫নং নির্দেশ
আমদানি
আমদানিকৃত সকল মাল দ্রুত খালাস করতে হবে। শুল্ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখাসমূহ কাজ করে যাবেন এবং ধার্যকৃত শুল্ক সম্পূর্ণরূপে পরিশোধের পর মাল খালাসের অনুমতি দেবেন। এই কাজ সমাধানের জন্যে ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডে ও ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে বিশেষ একাউন্ট খোলা হবে। কাস্টমস কালেক্টরগণ এই বিশেষ একাউন্ট পরিচালনা করবেন। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে যেসব নির্দেশ ইস্যু করবেন, কাস্টমস কালেক্টরগণ তদনুযায়ী  একাউন্ট পরিচালনা করবেন। যে শুল্ক আদায় করা হবে তা কোনমতেই কেন্দ্রীয় সরকারের নামে জমা হবে না।

৬নং নির্দেশ
রেলওয়ে
রেলওয়ে চালু থাকবে। তবে রেল কর্তৃপক্ষের কেবলমাত্র সেই অফিসই খোলা থাকবে যেগুলো রেল চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্যে সৈন্যদের আনা-নেয়া বা সমরাস্ত্র পরিবহনের কোন কাজে কোনভাবেই সাহায্য বা সহযোগিতা করা যাবে না। বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য পরিবহনের জন্য রেলওয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল ওয়াগনের ব্যবস্থা করবে।

৭নং নির্দেশ
সড়ক পরিবহন
সারা বাংলাদেশে ইপিআরটিসি চালু থাকবে।

৮নং নির্দেশ
অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর কাজ চালু রাখার জন্য ইপিএসসি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও আইডব্লিউটিএ’র প্রয়োজনীয় কিছুসংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবেন। গণনির্যাতনের জন্য সৈন্য বা রণ সম্ভার আনা-নেয়ার ব্যাপারে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কোন সহযোগিতা করতে পারবেন না।

৯নং নির্দেশ
বাংলাদেশের মধ্যে শুধু চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম ও মনি অর্ডার পৌঁছানোর জন্য ডাক ও তার বিভাগ কাজ করে যাবে। সরাসরি বিদেশে চিঠিপত্র ও টেলিগ্রাম প্রেরণ করা যাবে না। ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশ নেয়ার ও দেয়ার জন্য সোম, মঙ্গল,বুধ ও বৃহস্পতি শুধু অপরাহ্ন ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এই এক ঘন্টা আন্তঃআঞ্চলিক টেলিপ্রিন্টার যোগাযোগ চালু থাকবে। ২৫ নং নির্দেশে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে। আন্তঃআঞ্চলিক প্রেস টেলিগ্রাম চালু থাকবে। পোষ্টাল সেভিংস ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি কার্যরত থাকবে।

১০নং নির্দেশ
বাংলাদেশের মধ্যে কেবলমাত্র স্থানীয় আন্তঃজেলা ট্রাক টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। টেলিফোন মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগগুলি কাজ করে যাবে।

১১নং নির্দেশ
বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলি কাজ চালিয়ে যাবেন। তাঁরা গণআন্দোলন সম্পর্কিত সকল বক্তব্য, বিবৃতি, সংবাদ ইত্যাদি প্রচার করবেন। যদি না করেন তবে এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না।

১২নং নির্দেশ
জেলা হাসপাতাল, টিবি ক্লিনিক, কলেরা ইন্সষ্টিটিউটসহ সকল হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশান সার্ভিসগুলো যথারীতি কাজ করে যাবে। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল সোর্স কাজ করে যাবে এবং সকল হাসপাতাল ও হেলথ সেন্টারে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করবেন।

১৩নং নির্দেশ
বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজের সাথে ও এই কাজের সংরক্ষণ ও মেরামত কাজের সাথে জড়িত ইপিওয়াপদার বিভাগগুলো কাজ করে যাবে।

১৪নং নির্দেশ
গ্যাস ও পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এসবের সরক্ষণ ও মেরামতের কাজও চালু থাকবে।

১৫নং নির্দেশ
ব্রিক ফিল্ড ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

১৬নং নির্দেশ
আমদানি, বন্টন, গুদামজাতকরণ ও খাদ্যশস্যের চলাচল জরুরি ভিত্তিতে কার্যকরী থাকবে। এ সবের প্রয়োজনে ওয়াগন, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য সকল প্রকার পরিবহন ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে চালু থাকবে।

১৭নং নির্দেশ
(ক) ধান ও পাটবীজ, সার ও কীটনাশক ক্রয়, চলাচল ও বন্টন অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার ও চাল গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও এর সকল প্রকল্পগুলো যথারীতি কাজ করবে।
(খ) পাওয়ার পাম্প ও অন্যান্য কারিগরি যন্ত্রপাতির চলাচল, বন্টন, মাঠে চালু রাখা ইত্যাদি অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া, তেল, জ্বালানি, যন্ত্রপাতি ও এসবের সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্যে প্রয়োজনীয় বিভাগ খোলা থাকবে।
(গ) নলকূপ খনন, খাল খনন ও এই জাতীয় পানি সেচ সম্পর্কিত সকল কাজ চালু থাকবে।
(ঘ) পূর্ব পাকিস্তান সমবায় ব্যাংক, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো থানা সমবায় সমিতি এবং অন্যান্য সমবায় সংস্থাগুলোকে কৃষি ঋণ দেয়া অব্যাহত থাকবে।
(ঙ) যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো তার কাজ সুচারুরূপে পরিচালনার জন্যে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থার প্রয়োজনীয় শাখাগুলো খোলা থাকবে।
(চ) কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলো থেকে ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্যে সুদবিহীন ঋণ ও কৃষকদের প্রয়োজনীয় ঋণ দেওয়া বলবৎ থাকবে।
(ছ) আলু কিনে গুদামজাত করার জন্যে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের তহবিল মওজুদ রাখতে হবে।

১৮নং নির্দেশ
বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণ
বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ, শহর সংরক্ষণ এবং নদী খনন ও যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ ওয়াপদার পানি উন্নয়ন কাজ, মালপত্র খালাস ও আনা নেয়া এবং এই ধরনের অন্যান্য জরুরি কাজ সুচারুরূপে চালিয়ে যাওয়া হবে। সরকারী এজেন্সী কিংবা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা কন্ট্রাক্টরদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে।

১৯নং নির্দেশ
উন্নয়ন ও নির্মাণ কার্য
বৈদেশিক সাহায্যে তৈরি রাস্তা ও পুল প্রকল্পগুলোসহ সকল প্রকার সরকারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারী এজেন্সী ও সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে ঠিকাদারদের পাওনা যথারীতি মিটিয়ে দেয়া হবে। উক্ত সংস্থাগুলো থেকে যদি মালমসলা সরবরাহের চুক্তি থাকে তাহলে সেই চুক্তি মোতাবেক যথারীতি সরবরাহ করা হবে।

২০নং নির্দেশ
ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার বাঁধ তৈরি ও উন্নয়নমূলক কাজসহ সকল প্রকার সাহায্য পুনর্বাসন ও পুননির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারী এজেন্সী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলো ঠিকাদারদের পাওনা মিটিয়ে দিবে।

২১নং নির্দেশ
ইপিআইডিসি, ইপসিক ফ্যাক্টরি ও ইষ্টার্ণ রিফাইনারি
ইপিআইডিসি ও ইপসিকের সকল কারখানায় কাজ চলবে এবং যতদূর সম্ভব উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এই সকল কারখানা চালু রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের ব্যাপারে ইপিআইডিসি ও ইপসিকের যে সকল শাখা খোলা রাখা প্রয়োজন হবে তা খুলে রাখতে হবে। ইষ্টার্ণ রিফাইনারির কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে হবে।

২২নং নির্দেশ
বেতন দান
সরকারী ও আধা সরকারী সংস্থার কর্মচারী ও প্রাইমারী শিক্ষকদের বেতন যাদের রোজ, সাম্পাহিক, পাক্ষিক কিংবা মাসিক হিসাবে দেয়া হয়ে থাকে, তাদের সেভাবে দিতে হবে। যাদের বন্যায় সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে এবং বাকি বেতন দেয়ার কথা, তা দিয়ে দিতে হবে। বেতন বিল তৈরির জন্য সরকারী আধা-সরকারী বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো খোলা রাখতে হবে।

২৩নং নির্দেশ
পেনসন
সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীসহ সকল অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনসন নির্দিষ্ট তারিখে পরিশোধ করতে হবে।

২৪নং নির্দেশ
এ.জি (ইপি) ও ট্রেজারী
এই নির্দেশে যে সকল কাজ চালিয়ে যাবার জন্যে হুকুম দেয়া হয়েছে তাদের টাকা-পয়সা দেয়া-নেয়া ও সরকারী কর্মচারীদের বিল তৈরী করা জন্যে সামান্য সংখ্যক কর্মচারী দ্বারা এ.জি (ইপি) অফিসের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

২৫নং নির্দেশ
(ক) ব্যাংকিং কার্য পরিচালনার জন্যে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে ৪টা পর্যন্ত সকল ব্যাংক খোলা থাকবে। (অবশ্য মাঝে টিফিনের ছুটি থাকবে) কিন্তু শুক্রবার ও শনিবারে  ব্যাংকিং কাজের জন্যে সকাল ৯টা থেকে ১১-৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য ১২-৩০ মিঃ পর্যন্ত খোলা থাকবে। অনুমোদিত লেনদেনের ক্ষেত্রে বুক ব্যালান্সসহ অন্যান্য কার্যাবলী নিয়মিতভাবে চলবে।
(খ) কয়েকটি বিধি-নিষেধ ছাড়া ব্যাংকগুলো যে কোন পরিমাণ জমা গ্রহণ, বাংলাদেশের ভিতর যে কোন পরিমাণ আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স, বাংলাদেশের ভিতর আন্তঃব্যাংক ট্রান্সফার এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিটি বা মেইল ট্রান্সফার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ ড্র করাসহ তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাবে। যেসব বিধিনিষেধ মানতে হবে সেগুলো হচ্ছেঃ
১. যদি চেকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংস্থার প্রতিনিধির বা বেতন রেজিষ্ট্রারের সার্টিফিকেট থাকে তাহলে বেতন ও মজুরী পরিশোধ করা।
২. সপ্তাহে এক হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাফাইড ব্যক্তিগত ড্রইংস।
৩. চিনিকলের জন্য আখ ও পাটকলের জন্যে পাটসহ শিল্পের কাঁচামাল কেনা জন্যে অর্থ দান।
৪. বাংলাদেশের ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়সহ যে কোন বাণিজ্যিক খাতে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেমেন্ট। ঐ অংক ক্যাশ অথবা ক্যাশ ড্রাফট মারফত উঠানো যাবে। কিন্তু উপরে উল্লিখিত ২ ও ৪ নম্বর শর্তে কোন অর্থ দেওয়ার পূর্বে অতীত রেকর্ড দেখে ব্যাংকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, অর্থ গ্রহণকারী একজন বোনাফাইড শিল্প অথবা বাণিজ্যিক সংস্থা অথবা ব্যবসায়ী এবং সে যে অর্থ উঠাচ্ছে তা তার এক বছরে সাপ্তাহিক গড় অর্থ উঠানোর চাইতে বেশি না হয়।
৫. উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নিযুক্ত তালিকাভুক্ত কন্ট্রাক্টরদের অর্থদান। তবে যে কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার কাছ থেকে চেকে একটি সার্টিফিকেট আনতে হবে, যে টাকাটা উঠাতে চাওয়া হচ্ছে তা উল্লিখিত কাজের জন্যে প্রয়োজনীয়।
(গ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে কোন একাউন্টে ক্রস চেক ও ক্রস ডিম্যান্ড ড্রাফট প্রদান করা ও জমা নেয়া যাবে।
(ঘ) ষ্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা থেকে অর্থ প্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিটি পাঠানো যাবে। যে সমস্ত ব্যাংকগুলোর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেগুলো ঢাকাস্থ ষ্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পাওনা গ্রহণ করতে পারবে।
(ঙ) অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ের জন্যে সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত এক ঘন্টা আন্তঃশাখা টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস চালু থাকবে।
১. প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে সোমবার ও বুধবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি খবর পাঠাতে ও পেতে পারে।
২. প্রত্যেক ব্যাংক অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে একটি খবর পেতে পারে।
(চ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিল সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রস চেক বা ক্রস গ্রান্টের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করতে হবে।
(ছ) অনুমোদিত ডিলারের সাহায্যে ফরেন ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গানো যাবে।
(জ) কুটনীতিকগণ অবাধে তাঁদের একাউন্টের কাজ পরিচালনা করতে পারবে এবং বিদেশী নাগরিকগণ বৈদেশিক মুদ্রা একাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করতে পারবেন।
(ঝ) লকার্স পরিচালনার কাজ বন্ধ থাকবে।
(ঞ) ষ্টেট ব্যাংক বা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।
(ট) বিদেশী রাষ্ট্র থেকে লাইসেন্সের মাধ্যমে দ্রব্যাদি আমদানির জন্যে লেটার অব ক্রেডিট খোলা যাবে।
(ঠ) পণ্য বিনিময়ের চুক্তি (যে সমস্ত দ্রব্য ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে) মোতাবেক প্রেরিত দ্রব্যের ছাড় করতে হবে।
(ড) ইষ্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড ও ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশ লিমিটেডের মারফত বকেয়া রপ্তানি বিল সংগ্রহ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশ মোতাবেক কাজ পরিচালিত হবে।

২৬নং নির্দেশ
ষ্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের মতো কাজ করবে এবং সে একই অফিস সময়ে চলবে এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং পদ্ধতি কাজ করার জন্যে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে অনুরূপভাবে খোলা থাকবে। উল্লিখিত কাঠামো ও বিধি নিষেধ এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ‘পি ফর্ম বরাদ্দ করা যেতে পারে এবং বিদেশে অবস্থানরত ছাত্র ও অন্যান্য অনুমোদিত প্রাপকের জন্যে বিদেশে প্রেরণের টাকা ও গৃহীত  হতে পারবে।

২৭নং নির্দেশ
বাংলাদেশের জন্যে আমদানি লাইসেন্স ইস্যুকরণ ও আমদানিকৃত দ্রব্যাদি চলাচলের বিধি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যে আমদানি-রপ্তানি কন্ট্রোলারের অফিস নিয়মিতভাবে চলবে।

২৮নং নির্দেশ
সকল ট্রাভেল এজেন্ট অফিস ও বিদেশী বিমান পরিবহন অফিস চালু হতে পারে। কিন্তু তাদের বিক্রয়লদ্ধ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংকে জমা রাখতে হবে।

২৯নং নির্দেশ
বাংলাদেশে সকল অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চালু থাকবে।

৩০নং নির্দেশ
পৌরসভার ময়লাবাহী ট্রাক, রাস্তায় বাতি জ্বালানো, সুইপার সার্ভিস এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় অন্যান্য ব্যবস্থা চালু থাকবে।

৩১নং নির্দেশ
কোন খাজনা কর আদায় করা যাবে না।
(ক) পুনঃনির্দেশ দেয়া পর্যন্ত-
(১) সকল ভূমি-রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে। (২) বাংলাদেশের কোথাও কোন লবণ কর আদায় করা যাবে না। (৩) বাংলাদেশের কোথাও কোন তামাক কর আদায় করা যাবে না, (৪) তাঁতীরা আবগারী শুল্ক দান ব্যতিরেকেই বাংলার সুতা কিনবেন। মিল মালিক ও ডিলাররা তাদের কাছ থেকে আবগারী শুল্ক আদায় করতে পারবেন না।
(খ) এছাড়া সকল প্রাদেশিক সরকারের কর, যেমনঃ প্রমোদ কর, হাট, বাজার, পুল ও পুকুরের উপর ধার্যকৃত কর আদায় করা যাবে এবং বাংলাদেশের সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে।
(গ) অকট্রয়সহ স্থানীয় কর আদায় করা যাবে।
(ঘ) কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ কর- যেমন আবগারী কর, বিক্রয় কর এখন থেকে আদায়কারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা আদায় হবে, তবে তা কেন্দ্রীয় খাতে জমা করা যাবে না অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে হস্তান্তর করা যাবে না। এসব আদায়কৃত কর ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক অথবা ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশনে ‘বিশেষ একাউন্ট’ খুলে জমা রাখতে হবে এবং ব্যাংক দুটিও তাদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী এগুলো গ্রহণ করবে। সকল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে এ নির্দেশ ও বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হবে, তা মানতে হবে।
(ঙ) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর আদায় ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ জারি হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

৩২নং নির্দেশ
পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন চালু থাকবে এবং পোষ্টার লাইফ ইন্সুরেন্সসহ সকল বীমা কোম্পানী কাজ করবেন।

৩৩নং নির্দেশ
সকল ব্যবসা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট নিয়মিতভাবে চলবে।

৩৪নং নির্দেশ
সকল বাড়ির শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন হবে।

৩৫নং নির্দেশ
সংগ্রাম পরিষদগুলো সর্বস্তরে কাজ চালু রাখবে এবং এ সকল নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে যাবে।

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ, ১৫ মার্চ ১৯৭১] 
 
 
 
১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে যেভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত বলে উল্লেখ করায় ১৭ মার্চ, ১৯৭১ ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসন ‘কি পরিস্থিতিতে ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ, সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল  তা তদন্তের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেন। নির্দেশে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানহাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হবে। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার তদন্ত দাবি করেছিলেন, কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ কি পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তলব করা হল তা নিরূপণের জন্যে তদন্ত কমিশন গঠন করলেন। সঙ্গতভাবেই বঙ্গবন্ধু এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করলেন। কমিশনের কাজে কোনভাবে সহায়তা না করার জন্যে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তানআওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ এবং চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ আবিদুর রেজা খানকে সদস্য করে বঙ্গবন্ধু একটি পাল্টা তদন্ত কমিশন গঠ করেন এবং তাঁদের সরজমিন তদন্তের জন্যে চট্টগ্রাম প্রেরণ করেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ যে বিবৃতি দেন, এখানে তার বয়ান উদ্ধৃত হলো।]
আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি যে দাবি জানিয়েছিলাম, ঘোষিত “তদন্ত কমিশন” সে দাবি পূরণ করতে পারবে না। সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশবলে এ তদন্ত কমিশন গঠন এবং সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের রির্পোট পেশ করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা অত্যন্ত আপত্তিজনক। কারণ এর শর্তাবলী পূর্বাহ্নে বিবেচ্য প্রধান প্রধান মৌলিক বিষয়গুলো নস্যাৎ এবং পৃথককৃত ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্ত করার পথ রুদ্ধ করে দেবে।
এ তদন্ত কমিশনের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হলো-‘২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত কি পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্যের জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল। সুতরাং মৌলিক বিষয়টি এভাবেই স্থির করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তদন্তের বিষয় ছিল বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহয্যের জন্যে জন্যে নিয়োগ না করে সেনাবাহিনীর নিয়োগ ও শক্তি প্রয়োগ রাজনৈতিক স্বার্থেই করা হয়েছিল কিনা? তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতপক্ষে যেসব জোর-জুলুম করা হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে ‘কমিশন’-এর সে ব্যাপারে তদন্তের পথ রূদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে এমন কি হতাহতের সংখ্যা কত এবং কোন পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র জনগণের প্রতি গুলিবর্ষণ করা হয়েছে তারও তদন্ত করা যাবে না।
সুতরাং ‘কমিশন’ কোন সত্যিকার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে না। ফলে, সত্যি ঘটনার মূল উদঘাটনের ব্যাপারে তদন্ত হবে না এবং এটা জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটা ফন্দিমাত্র।
সুতরাং আমরা এরূপ ‘কমিশন’ অনুমোদন করতে পারি না। বাংলদেশের জনগণ কোনক্রমেই এরূপ ‘কমিশনের’ সাথে সহযোগিতা করতে পারে না। এ ‘কমিশনে’ কারো কোন সদস্য মনোনীত কিংবা কারো এর সদস্য হিসেবে কাজ করা উচিত নয়।
জনগণের পক্ষ থেকে আমরা ৭ মার্চ ৪-দফা শর্ত উপস্থিত করেছি। তার মধ্যে একটি দাবী ছিল যথাযথ শর্ত সম্বলিত ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেগুলোর মধ্যে কেবল নামমাত্র এবং খন্ড খন্ড দাবি গ্রহণ এবং যেভাবে এ দাবি গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে আমরা যে চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছি, সে সমস্যার সমাধান হবে না।

[সূত্র: পূর্বদেশ, ১৯ মার্চ ১৯৭১]
১৯৭১ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সংবাদপত্রে দেয়া বিবৃতি

[বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রশাসন চলার দিনগুলোতে ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের ৫২তম জন্ম দিন সমুপস্থিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিন ইবা কি আর মৃত্যুদিনই বা কি? ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ও বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন, প্রবীন সাংবাদিক সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নাট্যকার মুনীর চৌধুরী সহ কয়েকজন পাকিস্তানসরকার প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আন্দোলনে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানান। নিচে বিবৃতিতে উদ্ধৃত হলো।]
একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।
এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দুর ও গ্রামে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের স্বাধীনতা-প্রিয় মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছে। একটি ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়সংকল্প জাতি কিভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আওয়ামী লীগের নির্দেশের আওতা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কাজে নিরলস পরিশ্রম করার জন্য সর্বস্তরের জনগণ, ক্ষেতের চাষী, কারখানার শ্রমিক, অফিসের কর্মচারী সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাই। আওয়ামী লীগের নির্দেশমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্য যাঁরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছেন, সেইসব ছাত্র, শ্রমিক এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সদস্যদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ প্রমাণ করেছে তাঁরা সুচারুভাবেই তাদের নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। উস্কানির্মূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার জন্য ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিদের আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি। জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটানো অব্যাহত রাখার স্বার্থেই অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের জনগণকে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতে হবে।
[সূত্র : দৈনিক আজাদ,২১ মার্চ, ১৯৭১]


১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের সাথে তথাকথিত আলোচনায় মিলিত হন। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে, ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম দফা আলোচনার দিন চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা চীন থেকে আনা অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান জাহাজ থেকে খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯ মার্চ সেনাবাহিনী ঢাকার কাছে জয়দেবপুরে বেসামরিক লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপেক্ষ ২০ জন লোক নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, পরের দিন প্রেসিডেনেটর সাথে নির্ধারিত বৈঠকে নাও যেতে পারেন। ১৯ মার্চ ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারী করা হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্টের জরুরি বার্তা পেয়ে ২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকা এলে ক্রুদ্ধ জনতা বিমানবন্দর ও হোটেলের সামনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরের দিন ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে বসেন। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার সুযো সৃষ্টির’ কথা বলে ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চ থেকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত ঘোষণা করেন। ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানদিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে সকল স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগ (প্রতিরোধ বাহিনী) ঢাকার পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। অধিকাংশ বিদেশী দূতাবাসেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চীনা দূতাবাসে পাকিস্তানী পতাকা ছাত্ররা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ছাত্রা প্যারেড করে করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি বাসভবনে যায়। তাঁরা বাড়ির সামনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। উক্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]
এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের দাবির প্রশ্নে আপোস নাই। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা দাবি আদায় করবোই। জনগণের অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি আত্মার একটি আত্মা ও বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকবো।
আমরা নিশ্চয়ই শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তার অর্থ এই যে, যে কোন আক্রমণ আমরা সহ্য করবো। গত ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলন ক্ষমতাসীন চক্রের মাজা ভেঙ্গে দিয়েছি। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের দাবির প্রশ্নে কোন আপোস নাই। বাঙ্গালিরা আজ ঐক্যবদ্ধ, তাই বিশ্বের কোন শক্তিই তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মা-বোনেরাও আজ সংগ্রামে রাস্তায় নেমে এসেছেন। বাংলাদেশে যাতে একটিও শোষণকারী থাকতে না পারে, সে জন্যে ব্যাপক আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে।
আমাদের সংগ্রামে ঐক্য ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকি তবে কোন শক্তিই আমাদের চূড়ান্ত বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, কোন শক্তিই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করতে হবে। মনে রাখবেন, সেই ভাল সিপাহসালার, যিনি কম রক্তপাতে সফলতা অর্জন করতে পারেন।

[সূত্র : আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ ১৯৭১]




১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[সারাদেশ জুড়ে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশী নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই দিন ছাত্রলীগ প্রতিরোধ বাহিনী পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গানটি গেয়ে পতাকা উত্তোলন করে। শহরের সব মিছিল গিয়ে শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে। সেদিন বঙ্গবন্ধু মিছিলকারীদের সমাবেশের উদ্দেশ্যে এই ভাষণটি প্রদান করেন।]
আমি আপনাদের কাছে মাত্র একটা কথা বলতে পারি-সাত কোটি লোক মুক্তি পাওয়া না পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আপনাদের মনে রাখা দরকার-নীতির সাথে আপোষ হয়না। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে চাই, কিন্তু নীতির সাথে আপোষ হয়না। এদেশের মানুষকে কলোনিয়ার মনে করতে হবে। যে কোন ত্যাগের মাধ্যমে আপনারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন-শহীদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না এবং যেভাবেই হোক এদেশ থেকে বাজার আমরা বন্ধ করে দেব এবং বাংলার মানুষকে আমরা মুক্ত করব। কারো সঙ্গে মাথা নথ করব না। দরকার হয় আরো রক্ত দেবো কিন্তু বাংলার মানুষকে আর আমরা পরাধীন থাকতে দেব না এবং আপনাদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। জয় বাংলা।

সংগ্রহ- ফাদার অব দ্য নেশন, ড. এ এইচ খান
 
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ শে মার্চ ১৯৭১

[প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বিকাল ৫টা নাগাদ সকলের অগোচরে ঢাকা ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথেই এ খবর পান। সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাবে, এ আশঙ্কায় তিনি নেতৃস্থানীয় সহকর্মীদের আন্দোলনের স্বার্থে গোপন আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তার শুভাকাঙক্ষীরা তাকেও নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার জন্য তাগিদ দেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায় এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে শুরু করে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ শহরে সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে শুরু করে এবং পূর্ব পরিকল্পিত অভিযান চালায়।
রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত টেলিফোনে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ঢাকায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্যে চট্টগ্রামে একটি বার্তা পাঠান। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বার্তাটি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় এখানে উদ্ধৃত হলো।]
“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা।”
আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
[বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিবির্শ্ব প্রচারকেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘বঙ্গবন্ধু স্পিকস’ তারিখ ঃ ২৬ মার্চ, ১৯৭১]
Declaration of Independence
This may be last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved”
[Message embodying Declaration of Independence sent by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to Chittagong shortly after midnight of 25 March. I,e early of 26th March, 1971 for transmission throughout Bangladesh over the ex-EPR transmitter.]