১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী লন্ডনের হোটেলে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
[বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নৃশংস অত্যাচার চালায়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিয় শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে প্রাণপন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বিমান কয়েকটি ভারতীয় শহরে বোমা বর্ষণ করে। ভারতও পাল্টা আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করেন। পরদিন ভূটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে। বাংলাদেশ পাক দখলদার বাহিনীর হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়। ইয়াহিয়া খান বাধ্য হলেন ভূট্টোকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৩ জানুয়ারী, ১৯৭২ করাচীর এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হবে। ৬ জানুয়ারী ভুট্টো জানালেন, শেখ সাহেবকে ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতা ডঃ কামাল হোসেনকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ভুট্টো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্দুকে বিদায় জানান। ৮ জানুয়ায়ী ভোরে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছে সাংবাদিকদের কাছে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁর হোটেলে সমবেত জনাকীর্ণ সাংবাদিকদের সামনে তিনি ইংরেজিতে বিবৃতি পাঠ করেন। বিবৃতির বঙ্গানুবাদ দেয়া হলো।]
জয় বাংলা!
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এর দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন দানকারী মার্কিন জনগণ ও অন্যান্য জনসাধারণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবি নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ‘বিশ্বাসঘাতক’এর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদন্ডের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্মময়, আমার বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন।
জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্যে নিষ্প্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যেখানে আমাকে তারা কোন রেডিও, কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেয়া হয় নাই।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে ভোগ করতে হয় নাই। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকান্ডে সেও লজ্জা পেতো।
প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোন একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোন কিছু বলতে পারবো না।
আমি আর এক মূহুর্তে এখনে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।
[সূত্র ঃ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও পূর্বদেশ; ৯ জানুয়ারী,১৯৭২]
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতের পালাম বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
[১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকারে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলে রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানালেন। বিমানবন্দরে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বঙ্গানুবাদ।]
আমার জন্যে এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশের যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাতাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী-যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার নূন্যতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে, আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পত পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে তাতে যোগ দেয়ার জন্যে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে।
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারো জন্যে কোন বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে, অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে। জয় বাংলা! জয় হিন্দু।
[সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৩ জানুয়ারি,১৯৭২
SHEIKH MUJABUR RAHMAN’S SPEECH IN REPLY TO PRESIDENT
GITI’S ADDRESS OF WELCOME
January 10,1972
For me, this is a most gratifying moment, I have decided to stop over in this historic Capital of your country on my way back to Bangladesh. For this is the least I can do to pay personal tribute to the best Friends of my people of India and this Government under the leadership of your magnificent prime Minister, Mrs Indira Gandhi, cheers. She is not only a leader of men, but also of mankind.
you all have worked so untiringly and sacrificed so gallantly in making this journey possible this journey form darkness to light, form captity to freedom, form desolation to hope.
I am at last going to sonar Bangla, the land of my derms, after a period of nine months. In these nine months, my people have traversed centuries.
When I was taken away from my people, they wept, when I was held in captivity, they fought and now that I go back to them, they are victorious. I go to join my people in the tremendous tasts that now lie ahead in turning victory into a road of peace, progress and prosperity. I go back not with any hatred in any heart for anyone, but with the satisfaction that truth has at last triumphed over falsehood, sanity over insanity, courage over cowardice, justice, good over evil, joi bangla, jai Hind.
SHEIKH MUJABUR RAHMAN’S SPEECH AT PUBLIC MEETING
NEW DELHI, January 10, 1972
In z voice with emotion, Sheikh Mujibur Rahman told the hyge gathering Bangladesh and its will never forget your prime Minister. yur Government and brave armed force and your common people who have extended all sympathies and support to their suffering and struggle.
The sheikh, dressed in a grey suit and a dark brown overcoat, drove to the grounds accoumpanied by the Prime Minister, Mrs. Indira Gandhi immediately after he was accorded reception at Delhi Airport. Speaking in Bengali, the Bangadandhu said never in the history of man had such brutalities been perpetrated as the Pakistan had done Bangladesh. He said that he believed in the ideals of secrularism, democracy, freedom of man and peace in the world.
As he was overwhelmed be emotion, the Bangabandhu said he could not help this for he never knew that he would live to his Sonar Bangla.
The Pakistan army had killed one million people of Bangladesh. India had looked after ten million people who had been forced out of Bangladesh.
His first words of address were: Shrimati Indira Gandhi ladies and gentlemen present.
Wave after wave of applause greeted the Banglabandhu as he rose to address the mammoth gathering.
He said that he was returning to his people, afree but sad people. He had lost a large number of his friends, who had been slaughtered by the Pakistan army, whose homes had been burnt and their honour taken away.
HW repeatedly spoke of the unity of feelings beteen the people of Bangladesh and of India, in their ideals and beliefs. He hoped that his country, Sonar Bangla, would prosper amid undying friendship between the two countries.
He said India had fed 10 million people of Bangladesh despite its own peoblems. I know this.
Till two days ago he was a prisoner and did not know whether he would be free and be able to go back to Bangladesh see his people and fulfil my hope.
Sheikh Mujib said great tasks lay ahead of him on his return to Bangladesh. He said he could never forget the help given by the Indian armed forces for the liberation of Bangladesh. Never before in the history of freedom struggles had any nation paid so colossal a price for freedom as the people of Bangladesh had done.
He ended his speech with a shout of Jai Hind, Mrs Gandhi then joined him bu hailing Jai Bangla.
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ভারতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সেনাবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যাক্তিগত ভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দি ছিলাম দু দিন আগেও। শ্রীমতি গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাতকোটি মানুষ ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি মানুষের থাকার ব্যবস্থা, রাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন- আমি জানি ভারতবর্ষের মানুষও দুখে আছে, এখানে তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও অভাব আছে, তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোকেরে সাহায্য করার জন্য। চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারব না। আমরা আশা করি, আপনারা জানেন, আজ বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে। আমি আরো সাহায্য সহযোগিতা আশা করি এবং এও আশা করি, দুনিয়ার যত শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সগযোগিতা করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি সেকুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতস্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোস্যালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষত্বের মিল, এটা বিশ্ব শান্তির মিল।
(সিডি শুনে লেখা হয়েছে)
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
[বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজধানীতে পৌঁছার সাথে সাথে বাংলাদেশে অপেক্ষামান লক্ষ লক্ষ মানুষের উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রথমে ইংরেজিতে তার বক্তৃতা শুরু করলেও শ্রোতাদের অনুরোধে পরে বাংলায় বলেন।
ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ নয় মাস পর তাদের অবিসংবাদী নেতার বক্তৃতা শোনার জন্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। অতি কষ্টে জাতির জনককে একটি খোলা ট্রাকে করে বিমানবন্দ থেকে সারা পথ প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে দিয়ে রেসকোর্সে আনা হয়। রেসকোর্সে পৌঁছুতে ট্রাকটির প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লাগে। ১০ জানুয়ারী ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]
যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই।
ভাইয়েরা আমার, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ দানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও।
আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
গত ৭ই মার্চ আমি রেসকোর্সে বলেছিলাম দুর্গ গড়ে তোলো। আজ আবার বলছি, আপনারা এ কথা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙ্গালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই।
গত দশ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাকে বিলীন করেছে। বাংলার লাখো লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য মানুষ গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি-বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অত্যন্ত ভালবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙ্গালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙ্গালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।
আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসাবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। তোমরা আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না।
তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইয়েরা, তাদের গায়ে হাত দিও না, তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই, বাঙ্গালিরা কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।
কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার হবে। সে ভার সরকারের উপর ন্যস্ত রাখুন। ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙ্গালিরা একবার মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।
মার্চের সেই রাতে আমাকে কেড়ে নেবার সময়ে আমার সহকর্মী তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যরা কাঁদছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি, এখানেই আমি মরতে চাই। তবুও মাথা নত করতে পারবো না। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নির্দেশ মতো সংগ্রাম চালিয়ো। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।
বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান।
পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা- আপনারা অসংখ্য বাঙ্গালিকে হত্যা করেছেন, অসংখ্য বাঙ্গালি মা-বোনের অসম্মান করেছেন, তবু আমি চাই আপনারা ভাল থাকুন।
আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারবো না। ওরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, এমন গ্রাম নাই যেখানে আগুন দেয় নাই, সেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এত বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজীর আর নাই। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত বেসামরিক লোক মরে নাই।
সকলে জেনে লাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যা, পন্ডিত মতিলাল হেরেুর নাতনী। তার রক্তে মিশে আছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সাথে দিল্লীতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখন দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর জনতাকে আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই। সালাম জানাই, মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মী বাহিনীকে। আমি সালাম জানাই সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীকে, কৃষককুলকে, বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া যাবে না। সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন, দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি বলতে চাই-ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সাথে আর না। মরে যাবে, তবুও বাঙ্গালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপানাদের মঙ্গল কামনা করি। আপনারা স্বাধীন দেশকে মেনে নিন। আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন।
গত ২৫শে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর হানাদার বাহিনী দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তজাতিক দল বর্বর পাক বাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করুক। জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবী পূরণ করা।
জয় বাংলা॥ বাংলাদেশ-ভারত ভাই ভাই॥
সংগ্রহ- সিডি থেকে।
১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারীতে প্রসিডেন্ট ভবনে বাস্তুহারাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা
আপনারা একটু শান্ত হন। আপনারা কষ্ট করে না আসলেও পারতেন। আমি জানি, যে রাত্রে আমাকে গ্রেফতার করে, সে রাত্রে আপনাদের গর-বাড়ি সব জ্বালাইয়া দেওয়া হয়। আমাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি দেখতে পেয়েছিলাম যাদের ঘর নাই, ছোট ছোট কুড়ে ঘর বানাইয়া আছে সেগুলোও জালিম পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকগুলো পুড়াইয়া দিয়াছিল।
আমি জানি, আজ স্বাধীনতা পেয়েছি, আপনারা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক কিন্তু কত রক্ত দিতে হয়েছে তার হিসাব নাই। কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ত্রিশ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে নাই। লক্ষ লক্ষ ঘর বাড়ি জ্বালাইয়া দেয়া হয়েছে। জালিমের দল চলে গিয়াছে সত্য, আমার দেশের সাতকোটি লোককে বাস্তুহারা করে গেছে। কিন্তু আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, আমার ঈমান আছে, আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে নতুন করে সোনার বাংলাকে নতুন করে গড়তে হবে এবং নতুন করে মানুষের জীবিকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ধৈর্য্যরে প্রয়োজন আছে। আপনারা শহরে আছেন, আমি আপনাদের বহু আগে বলেছিলাম আপনাদের জন্য শিঘ্রই আমি একটা বন্দোবস্ত করব। সেখানে আপনাদের সকলে একযোগে এক জায়গাতে আপনাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে হবে। রাস্তা-ঘাট, এখানে-ওখানে বাড়ি-ঘর আপনারা যা করেছেন আপাতত থাকেন। আমি আমার ছোট ভাইদের বলেছি, তোমরা তারাতারি একটা লিষ্ট বানও। কত আমার বাস্তুহারা ঢাকা শহরে আছে, তাদের জন্য আমি একটা জমি, এরিয়ার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, আপনারা সব সেখানে উঠে নেন। আপনারা সে জায়গায় থাকবেন, পরে আমি আপনাদের জন্য ঘর-বাড়ির কি ব্যবস্থা করতে পারি-দেখব। আপনারা ধৈর্য্য ধরেন, আপনাদের আইন শৃঙ্খলা মানতে হবে।
দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, চাল নাই, অর্থ নাই, খাবার নাই, জামা নাই, কিছুই নাই। কিছু কিছু সংখ্যক ব্যাসসায়ি জিনিস পত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে। তাদের জানা উচিৎ যে বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলার সরকার দৃস্কৃতিকারীদের ক্ষমা করবে না। তাদের আমি অনুরোধ করছি, জিনিস পত্রের দাম বাড়াতে পারবে না। যাতে ন্যায্য মূল্যে আমার জনসাধারণ জিনিস পত্র পায় সেদিকে খেয়াল রাখবে, নইলে তোমাদের ভবিষৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
আমি আপনাদের কাছে বলব যে, আমি খবর পাই জায়গায় জায়গায় দু’এক জায়গাতে একজন আরেকজনকে অত্যাচার করা হয়। স্বাধীনতা মানে বিশৃক্ষলা নয় স্বাধীনতা মানে গুন্ডামি বদমায়েশি নয়, স্বাধীনতা মানে একজনের কাছ থেকে জুলুম করে পয়সা উপার্জন করা নয়, স্বাধীনতা মানে মানুষ, মুক্ত দেশের মুক্ত মানুষ স্ব-সম্মানে উজ্জতের সাথে বাস করবে। এই সমাজে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গিকার, প্রতিজ্ঞা আমি কখন করেছি- আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যখন এসেছি। লক্ষ লক্ষ মা-ভাই-বোন আমার জন্য জীবন দিয়েছে। ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। আমার দেশের মানুষের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজ সব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যা করেছে-নমরুদ, ফেরাউন বোধ হয় লজ্জা পেত দেখলে, যা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকেরা করেছে।
চিন্তা নাই, আমার এত সুন্দর জনগণ, আমার এমন সোনার মানুষ আর আমার এমন সোনার বাংলাদেশ। ধৈর্য্য ধরে যদি কাজ করেন সকলে মিলে, ইনশাল্লাহ্ নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারব। আমার কোন লোভ নাই আপনারা জানেন। প্রধানমন্ত্রী আমি সারা পাকিস্তানের হতে পারতাম আপনারা জানেন। আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাই নাই, আমি চেয়েছিলাম ফাঁসি কাষ্ট। এইজন্য যে, আমি বাংলার মানুষকে অপমান করতে চাই না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, আপনারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চারদিকে নজর রাখবেন। একজন আরেকজনের উপর অত্যাচার করবেন না। আর দ্বিতীয় কথা আমার বাস্তুহারা ভাইরা, সাতকোটি মানুষ আজ বাস্তুহারা হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ ঘর বাড়ি গ্রামে গ্রামে পুড়াইয়া দিয়াছে, এইজন্য বারবার আমি একথা বলছি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন যত তারাতারি হয় আপনাদের নিজের জায়গায় বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। এখানে-ওখানে রাস্তার পাশে থাকলে চলবে না, কারণ আপনাদের অসুবিধা জনগণের অসুবিধা, আপনাদের কষ্ট জনগণের কষ্ট। একটা এরিয়া আমি দিব, যার মধ্যে আপনারা সুখে সাচ্ছন্দে এবং ঐ জায়গা আপনার নিজের জায়গা হবে। আমি এপিএসকে বলেছি, আমি ১৫ দিনের সময় দিলাম, ১৫ দিনের মধ্যে লিষ্ট করে তুমি আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিবা। আমি আশা করি এক দুই মাসের মধ্যে এর সমাধান হবে। আপনারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আজ আমি দেখি আমার এই নীল আকাশের তলে সবুজ মাঠে ওই আমার জাতীয় পতাকা উড়ে। ঐ জাতীয় পতাকাকে আপনারা ছালাম দেন। আল্লাহর উপর নির্ভর করে আপনারা দোয়া করেন, আমাদের সহকর্মীদের সকলে যেন ইমানের সঙ্গে রাখে এবং আপনাদের জন্য যেভাবে এদেশের যুবক ছেলেরা রক্ত দিয়েছে, সমস্ত দলের মুক্তিবাহিনীরা জীবন দিয়েছে, আমার সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে, পুলিশ রক্ত দিয়েছে, বুদ্ধিজীবীরা রক্ত দিয়েছে, মা-বোন রক্ত দিয়েছে। এই রক্ত যেন বৃথা না যায়। যারা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা দিয়ে গেল, তাঁ মরে নাই। তাদের আত্মা বেঁচে আছে। তারা দেখবে, তাদের আত্মা দেখবে যে বাংলার মানুষ সুখে বাস করছে কি না, বাংলার মানুষ পেট ভরে খাচ্ছে কি না, বাংলার মানুষ শান্তিতে বাস করছে কি না। ওদের আত্মা তখনই শান্তি পাবে যেদিন আপনারা পেট ভরে ভাত খাবেন, গায়ে আপনাদের কাপড় হবে, থাকার বন্দোবস্ত হবে, বেকার সমস্যা দূর হবে- সেদিনই আমি সেদিনই আপনাদের সত্যিকারের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের দাবী করতে পারব-এর আগে আপনাদের দাবী করার অধিকার আমার নাই। আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি বিদায় নিচ্ছি। বলেন জয়বাংলা।
সংগ্রহ- সিডি থেকে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারীতে সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
মাননীয় প্রধান বিচারপতি, মাননীয় বিচারপতিগণ, সুধীবৃন্দ, বারের সদস্যবৃন্দ, উপস্থিত ভদ্রমন্ডলী ও ভদ্রমহিলাগণ, মহিলা আছেন তাই বলতে হলো, আপানারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আপনাদের সঙ্গে দেখা করার। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনাদের সঙ্গে মিশা সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার অনেক বাল্যকালের সহকর্মী এখানে আছেন, যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি, পড়েছি, খেলেছি, তারা অনেকেই উপস্থিত আছেন।
আজ সত্যিই আনন্দ প্রকাশ করতে হয় এজন্য যে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে আজ আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন জাতি হিসাবে যদি স্বাধীন সুপ্রিমকোর্ট না থাকে তাহলে সে জাতি পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আমাকে স্মরণ করতে হয় আপনাদের এই বারের অনেক সদস্য- যারা জালেম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীর কাছে শহীদ হয়েছেন। আপনাদের অনেক সহকর্মী, মরহুম মশিউর রহমান, মরহুম আমিনউদ্দিন, আরো অনেকে শহীদ হয়েছেন। অনেক বারের সদস্য তাদের কালো কোর্ট ত্যাগ করে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র বাংলার মধ্যে ঢুকেছিল যুদ্ধ করার জন্য-বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে।
আপনাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। আমি জানি, তারা অনেকেই আমার সহকর্মী, তাদের কথা স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে। আজ এই শুভদিনে স্মরণ করতে হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, লক্ষ লক্ষ কৃষক ভাই, যারা শহীদ হয়েছেন এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে, যারা জীবন দিয়েছে, যারা পঙ্গু হয়ে ঘরে আছে, তাদের কথা স্মরণ করতে হয়। যদি তাদের কথা আমরা ভুলে যাই, তাহলে স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের জাতীয় পতাকা উঠাতে পেরেছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের সুপ্রিমকোর্ট, আজ আমাদের দেশে আইনের শাষণ হতে চলেছে, তাদের আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন।
আমি নিশ্চই সুখী হতাম, যেমন আমি পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেখি যে, এত জন ডাঃ এর নাম, যারা শহীদ হয়েছে। তাদের নাম লেখে ফলক করে রাখা হয়েছে। আমি সুখি হতাম বারের সদস্য ভাইয়েরা-যে যে সহকর্মীরা, যারা শহীদ হয়েছেন। এই সুপ্রিম কোর্টের গেটে এসে দেখতে পেতাম যে শহীদের নাম সেখানে লেখা রয়েছে, আমি সুখি হতাম। বেয়াদবী মাফ করবেন, আপনাদের আমি অভিযোগ করছি না। আজ, জনাব আমাদের মাননীয় বিচারপতি তার কথা তুলেছেন, বারের প্রেসিডেন্ট আমাদের এটর্নি জেনারেল, আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই অনেক আমরা সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেজন্যই শাসনতন্ত্র এত তারাতারি দেয়েছিলাম। যদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা, যদি রাজনীতি করতাম আপনারা নিশ্চই আমার পাশে যারা বসে আছেন জানেন যে, তালে তাল মিলিয়ে গালে গাল মিলিয়ে বহুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই, রাজনীতি করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য। সে মানুষের মুক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে, যদি মানুষ তা শাসনতন্ত্র না পায়। আইনের শাসন না পায়। দেশের অবস্থা আপনারা ভালো করে জানতেন জানেন, আপনারা বুদ্ধিজীবি মানুষ, আপনারা লেখা-পড়া করেন। আপনারা আইন নিয়া আলোচনা করেন। দেশের সমস্যা আপনাদের সামনে আসে। দেশের অবস্থা আপনারা ভালো করে জানেন।
অনেকেই আপনারা এখানে ছিলেন। অনেকেই রাত্রে ঘুমাতে পারেন নাই, রাত্রে ইয়ানাফসি ইয়ানাফসি করে আপনাদের দিন কাটাতে হয়েছে। অনেকের দেশ ত্যাগ করে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল। অনেকেই আত্ম গোপন করেছিলেন। আপনারা জানেন যে কি পৈচাশিক তান্ডবলিলা আমার বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। পুরা অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছে। স্বসশ্র বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে, পুলিশ বাহিনী, বিডিআরকে ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে নষ্ট করা হয়েছে। কোর্টও সব ধ্বংস করা হয়েছে। একটা ভস্মিভূত দেশের উপরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তারপরেও যাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সেই দিক দিয়ে আমরা নজর দেবার চেষ্টা করেছি, যাতে আপনাদের অসুবিধা না হয়।
আপনারা নিশ্চই আল্লার কাছে শুকর করবেন, যে বেতন আপনারা পান, কোর্টে আপনারা আসেন, গাড়ি আপনার চড়েন, পেট্রোল আপনারা পান, রাত্রে ঘুমাতে পারেন, আপনাদের শুকর করা প্রয়োজন। কারণ কি ছিলো আপনাদের, আপানারা ভালো করে জানেন? কি দিয়ে এই দেশ শাসনভার গ্রহণ করেছি সে অবস্থা আপনারা ভালো করে জানেন। আমি এই বিষয়ে আলোচনা করতে আপনাদের কাছে চাই না। কিন্তু আমরা চাই যে, আইনের শাসন হউক। বহুদিন আমরা দাবি করেছি যে, আজকে শাসনতন্ত্র হয়ে গেছে। শাসনতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে আমরা কিভাবে কাজ করি তার উপর নির্ভর করে।
কাগজে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা থাকে। দুনিয়ার কোন শাসনতন্ত্রেই খারাপ কথা লেখা নাই। কিন্তু সেটা যদি আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে কাজ করে এগিয়ে না যাই তাহলে দেশের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। আমাদের শাসনতন্ত্র আমাদের আদর্শ আছে। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। যেমন চারটা স্তম্ভের উপরে এই দেশের, আমরা তাকে ফান্ডামেন্টাল রাষ্ট্র আদর্শ আমরা বলি। চারটা রাষ্ট্রীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই দেশ চলবে। এইটাই হইল মূল কথা। এইটাকেই যদি ধ্বংস করতে কেউ না পারে, যেমন এক্সিকিউটিভ, যেমন আইনসভা তেমনি আপনাদের সুপ্রিম কোর্টেরও অধিকার রয়েছে যাতে এর উপরে কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে। আপনারা যখন বলেন, আমরাও তখন বলেছি এবং আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, জুডিশিয়ারি সেপারেট হবে এক্সিকিউটিভ থেকে। অনেকে বলেন, কমপ্লিট সেপারেশন। কোন রাষ্ট্রে কোনকিছুই কমপ্লিট সেপারেশন হয় না। একই সঙ্গে একটা অন্যটার সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। একই রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে যে অরগান গুলি থাকে যেমন জুডিসিয়ারি একটি অরগান, যেমন এক্সিকিউটিভ একটি অরগান। এরমধ্যে যদি কোপারেশন না থাকে, তাহলে সেদেশের মধ্যে কেওয়াজ সৃষ্টি হওয়ায়, যে কেওয়াজের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালের পর থেকে আপনাদের যে দশা হয়েছিল সে দশাই হবে। একটার সঙ্গে অন্যটা অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু যার যার যেখানে ক্ষমতা রয়েছে সেটাকে নিশ্চই প্রতিপালন করবেন।
আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। আপনারা আইনের শাসন পরিচালনা করবেন। আইনের মধ্যে যদি গোলমাল হয়, সেখানে আপনাদের সংশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে। মনে করেন তাতে পরিপূর্ণতা হচ্ছে না। আপনাদের ক্ষমতা রয়েছে নতুন আইন পাশ করা। এমন আইন পাশ করা উচিত হবে না দেশের মধ্যে রেশারেশি সৃষ্টি হয়।
সেজন্য আইনের শাসন করতে হলে, দেশের যে আমাদের শাসনতন্ত্রের মধ্যে যে মৌলিক জিনিস রয়েছে সেটাকে মেনে নিয়েই করতে হবে বলেই বিশ্বাস করি। আমি আইনজীবি নই, আপনারা আইনজীবি আপনারা ভালো বুঝেন, আপনারা বুদ্ধিজীবি, আপনারা ভালো বুঝেন। আমি আইনজীবি কোন দিন হতে পারি নাই, তবে আসামী হওয়ার সৌভাগ্য আমার যথেষ্ট হয়েছে জীবনে। আপনাদের কাছে সেটি আমার অনুরোধ থাকবে দেশের শাসনতন্ত্রকে যাতে উপযুক্ত ব্যবহার করা হয়, সেদিকে আপনারা নজর রাখবেন। কারণ সে ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে আপনাদের দেওয়া হয়েছে। যে আইন শাসনতন্ত্রের নাকচ করার অধিকার আপনাদের রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে যায়। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমি আপনাদের এ্যাডভাইজ দিতে চাইনা, আপনারা এ জিনিসটা আমার চেয়ে অনেক ভাল বুঝেন, আপনারা করবেন, আপনাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ কোনদিন হস্তক্ষেপ করবে না আপনাদের অধিকারের উপরে। সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এবং যতটা তাড়াতাড়ি হয় আমরা চেষ্টা করব যাতে জুডিশিয়ারী সেপারেটভাবে কাজ করতে পারে।
দ্বিতীয় কথা, আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে ইংরেজী ভাষায় অনেক কিছু আমাদের চলছে। ইংরেজী ভাষা আমাদের রক্তের মধ্যে কিছু কিছু আচর করেছে সন্দেহ নাই এবং ইংরেজী ভাষা আমাদের পরিভাষার প্রয়োজন সেটাও বুঝি, কিন্তু এ পরিভাষার জন্য যদি চিন্তা করি, হয়ত বাংলা ভাষা হবে না। সে জন্যই আমরা শাসনতন্ত্রে কোন ভাষা মিডিয়া রাখি নাই, যে পাঁচ বৎসরে দশ বৎসরের মধ্যে বাংলা থেকে ইংরেজীতে পৌঁছতে হবে। আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুণ। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে। আমরা আর পরিভাষা কমিটি করার কথা চিন্তা করছি না। তাহলে জীবনে আর ভাষা হয় নাই। অনেক পরিভাষার ইতিহাস রয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি সাহেব, বেয়াদবী মাফ করবেন। এইটা আমাদের, যা আমি দেখেছি, অনেক দেশে ঘুরেছি যারা তাদের অক্ষর পর্যন্ত নাই, তারা নিজের ভাষায় কথা বলে, নিজের ভাষায় লেখে এবং জাজমেন্ট দেয়।
অল্প কথায় লেখুন, যতটুকু পারা যায়, লেখা যায়, আমরাও চেষ্টা করতেছি, আমাদেরও অসুবিধা হয়ে যায়, আমরাও মাঝে মধ্যে অসুবিধা ফিল করি, এই যে ফিল করি বলে বললাম, হয়ে যায়, আমাদেরও হয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতেছি আর কিছু না পারি যখন ইংরেজী লেইখা নিয়া আসে এইটা বাংলায় সাইন করে দেই। যে বাবা বদলায় নিয়া আসো, ঐটা আমরা করছি, তাই আমরাও আশা করব যে, আপনাদের হাইকোর্টে, সুপ্রিম কোর্টের যেখানে আপনারা লেখতে আরম্ভ করেছেন। অফিস-আদালতে বলেছি যতগুলি টাইপ রাইটিং মেশিন দরকার চেষ্টা করব আপনাদের পৌঁছাবার জন্য।
সহযোগীদের জন্য আমরা কাজ করতেছি, শিগগির কাজ শেষ করে যত তাড়াতাড়ি হয় তা আপনারা পাবেন। আপাদের অসুবিধা আছে সে আমরা বুঝি, সে অসুবিধা দূর করতে যতটা সাহায্যের প্রয়োজন, পয়সা নাই, অর্থ নাই তাহলে কোন কৃপনতা করবো না, আশ্বাস আপনাদেরকে দেবার পারি। কিন্তু কমিশন করে আর সময় নষ্ট করতে চাইনা, এ কাজটা করব।
কমিশন শুনলে মাঝে মাঝে নিজের কাছে ভয় পাই। বহু কমিশন ২৫ বছরে শুনেছি, এটার জন্য আমরা নিজের কাছে একটু আতংকগ্রস্থ হয়ে পরি। যদিও আমাকে মাঝে মাঝে করতে হয়। কমিশন করতে হয়, পে-কমিশন করতে হয় তাহলে আমিও আতংকগ্রস্থ হয়ে পরি। আর আপনাদের এখানে আসার সময় বিচারপতি সাহেব বারবার দেখিয়েছেন, বারের বিল্ডিংটা আমরা ঐটা এখনও হয় নাই। কাজ শুরু হইয়া নাকি বন্ধ হয়েছে। যাক, এটা যেন বন্ধ না হয়, চেষ্টা করে দেখব, কাজ যেন শুরু য় সেটা দেখব। শিগগিরই কাজ শুরু হয়ে যাবে। খতম কবে হবে বলতে আমি পারি না। তবে সময় একটু লাগবে, তবে শিগগিরই শুরু হবে যে সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকেন। আমরা চাই সেটাকে ঠিক করার জন্য, যেমন ধরেন, আমাদের কাছে যখন আমরা এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বারের থেকে বলল যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে বই কনিার জন্য। আমাদের কিছু ছিল না কিন্তু যেইটা চেয়েছেন, সেইটা আমরা আপনাদের দিয়া দিয়াছি। বৈদেশিক মুদ্রা দিয়া দিচ্ছি, বই কিনা নিয়া আসেন এই বারের লাইব্রেরির জন্য। বৈদেশিক মুদ্রা চেয়েছেন দেরি করি নাই। যা চেয়েছেন তাই দিয়েছি। যদি এরকম কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়, যখন চাবেন যতটুকু আমরা পারি নিশ্চই করব। আমি একটু ওয়াদা কম করি আপনারা জানেন, কারণ বাংলাদেশের মানুষকে দাঁড়ায়ে প্রথমেই বলেছিলাম আমি তিন বৎসর আমি কিছু দিবার পারব না। যদি কিছু পারি ভালো কথা, দেবার পারবনা বলেই আমি শুরু করি। কারণ মিথ্যা ধোকা দিয়া লাভ নাই কিছু। নাই দেশের মধ্যে কিছু। যারা বড় বড় কথা বলেন ভেতরে ঢুকলে বুঝতে পারতেন, বোধ হয় পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেরই যেতে হত। আপনাদের পাবনাতে যেতে হতো অনেকেরই। এ দেশের কি অবস্থা ছিল! যাই হউক, আপনারা আমার বেয়াদবী মাফ করবেন, আপনারা যে আমার সুযোগ দিয়েছেন আজ আমার স্বাধীন দেশের সুপ্রিমকোর্টে আমার যে সৌভাগ্য হয়েছে। সেজন্য আপনাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আইনের শাসন এদেশে হবে এবং আমাদের শাসনতন্ত্র যে হয়েছে, আমরা চেষ্টা করব সকলে মিলে চেষ্টা করব যাতে এটার যে আদর্শ দেয়া হয়েছে আদর্শকে রক্ষা করা এবং এখানে সুপ্রিমকোর্টের অনেক দায়িত্ব রয়েছে এবং আপনাদের যে সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন, আপনারা সেটা পাবেন। আপনাদের কোন কাজে আমরা ইন্টারফেয়ার করতে চাইনা। আমরা চাই যে, দেশে আইনের শাসন কায়েম হউক। তবে একটা কথা আছে, দেশের অবস্থা আপনাদের বিবেচনা করে চলা উচিত। অনেক সময় যদি বেশি আপনারা করতে যান তবে দেশের মধ্যে আইন শৃংখলার অবস্থা খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তবে যেমন আমিও কষ্ট ভোগ করব, আপনিও কষ্ট ভোগ করবেন, সেদিকে আপনাদের খেয়াল রাখারও প্রয়োজন আছে।
বেয়াদবী মাফ করবেন, যদি একটা গল্প আপনাকে বলি, ধরেণ আমরা একটা আসামী ধরলাম, আপনাদের ক্ষমতা আছে, পাওয়ার আছে হয়ত এটা পারবেন। কিন্তু সে ডাকাত তিনটা মার্ডার করছে, এখানে হাইজ্যাক করতেছে, গাড়ী ধরতেছে, লুট করতেছে, তাকে ধরে আনা হলে বন্ধুকসহ ধরে নিয়ে আসা হল। পরের দিন যে লোক খবর দিল, তাহলে তাকে আমরা গ্রেফতার করে আমরা ছেড়ে দিলাম জেলখানা থেকে। তিনি বেল পাইয়া গেলেন, যাইয়া যে খবর দিলেন তাকে গিয়ে মার্ডার করলেন, আমরা তাকে জামিন দিয়ে দিলাম, তারপরের দিন যদি আইসা হাইকোর্টের জর্জ সাহেবকে বাড়ীর থেকে আবার হাইজেক করে নিয়া যাবে তখন আইনের অবস্থা কি হয়।
সেই জন্যই আমি বলি আমাদের ওতোপ্রোতোভাবে সবকিছু জড়িত। কিন্তু দেশের অবস্থা দেশের মানসিকতা, দেশের আবহাওয়া বিবেচনা করেও চলতে হবে। তা না হলে শুধু আইন করে চলেনা কোন কিছুই। স্বাধীন দেশের প্রত্যেকটি অরগানের সাথে অন্যান্য অরগান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা চলতে পারে না, চললেও কষ্ট হয়।
সেজন্য যখন বলেন কমপ্লিট ইন্ডিপেন্ডেট, সেখানে আমি বলি না ইন্ডিপেডেন্ট। কারণ রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই এবং শাসনতন্ত্রের ভেদ কাঠামোর মধ্যেই আমাদের সবকিছুতেই চলতে হবে। এজন্যই আমাদের যার যা কর্তব্য আমাদের পালন করতে হবে।
সেজন্য আমি আবার আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে, যে সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য আপনাদের আবার আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনাদের যদি কোন ব্যাপারে কোন অসুবিধা হয় আপনারাও এদেশের সন্তান। আমি সেজন্য নির্বাচন ও দিয়ে দিয়েছি। যদি আবার জনসাধারণ যাদের ভোট দিবেন তারা আসবেন, তবে শাসনতন্ত্র যা দেয়া হয়েছে এ শাসনতন্ত্র দুনিয়ায় এত তাড়াতাড়ি কেহ দিবার পারেন নাই। এত বিপদ আপদ, এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি এজন্য দিয়েছি যে আইনের শাসনে বিশ্বাস করি এবং সেজন্যে শাসনতন্ত্র দেয়া হয়েছে। আশা করি আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আজ আমাদের শাসনতন্ত্র হয়েছে যার জন্য বহু রক্ত গেছে এ দেশের আজ আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হয়েছে। যার কাছে মানুষ বিচার আশা করে। সেই কথা বলে আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বারকে ধন্যবাদ দিয়ে, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে বিচারপতিগণকে এবং যারা উপস্থিত আমার মুরব্বি আছেন তাদেরকে, যারা আমার সহকর্মী আছেন তাদেরকে যারা উপস্থিত ভদ্রমন্ডলী, ভদ্রমহিলা আছেন তাদেরকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। জয় বাংলা।
সংগ্রহ-সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী নিউইয়র্কের সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া স্বাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু
ডেভিট ফ্রষ্ট-স্যার, সেই রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই ২৫ মার্চ রাত আটটায় আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, কিন্তু আপনি বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেপতার বরণ করলেন। কেন এই সিদ্ধান্ত?
শেখ মুজিব-হ্যাঁ, সে এক করুণ কাহিনী। সেটা বলা প্রয়োজন। সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ী থেকে বেরুবো, নাকি বেরুবো না এই নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানী বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি হয়ত কলকাতা চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব- আমি ইচ্ছা করলে যে কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? দেশবাসীর সাথে আমি সংগ্রাম করবো। মৃত্যুবরণ করবো। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল যেন তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ডেভিট ফ্রাষ্ট- আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এই ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে একটি বিশ্বাসের প্রতীকরূপে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।
শেখ মুজিব- আমি তা বলিনে। কিন্তু একথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করলো। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমার গ্রামের বাড়ি, সেখানে আমার ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন। গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতারিড়ত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি বেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।
ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনাকে ওরা ঠিক কীভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১-৩০ ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটলো?
শেখ মুজিব- ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছিল।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোনখানে ছিলেন?
শেখ মুজিব- এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর। আমি তখন শোবার ঘরেই বসেছিলাম। প্রথমে সামনের দিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপর এদিক-ওদিক, সবদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়। এগুলো সব তখন ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছ’বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দু’টি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।
ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানী বাহিনী কোনদিক দিয়ে ঢুকেছিল?
শেখ মুজিব- সবদিক দিয়ে। ওরা জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে দু’টি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেড়িয়ে আসি।
ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?
শেখ মুজিব- না, কোনো শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় ইঙ্গিত জানিয়েছিলাম। আমি দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, তোমরা গুলি বন্ধ কর। আমি তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা গুলি করছ কেন? কি চাও তোমরা? তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একজন অফিসার আমার বুক বরাবর অস্ত্র উচিয়ে ধরে। আরেক অফিসার তাদের থামিয়ে ছিল?
ডেভিট ফ্রষ্ট-একটা অফিসারই ওদের থামিয়ে ছিল?
শেখ মুজির- হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়ে ছিল। ওরা তখন আমাকে টেনে গাড়িতে উঠাল নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। আমি বললাম, তোমরা আমাকে টানছো কেন? আমিতো যাচ্ছি। আমি বললাম, আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুই ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়-জোপড়সহ একটি ছোট সুটকেস দিলেন। তাই নেয় আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল।
ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে সেদিন যখন আপনি বেড়িয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন আর কোনোদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিব-না, আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। আমি ভেবেছি, এই হয়তো শেষ, কিন্তু আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তর লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পন করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।
ডেভিট ফ্রষ্ট- শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন, যে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পার না। কথাটি কি এমন ছিল না?
শেখ মুজিব- হ্যাঁ,আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। তবেতো তার দেহ নিথর হবে, কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারবেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বা। আমি একজন মুসলমান এবং মুসলমান একবারই মরে, দু’বার নয়। আমি মানুষ। আমি মানুষকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। আমার জন্য তাদের সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছুই তাদের দেয়ার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথাভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিব- হ্যাঁ, আমার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। আলমারি, কাপড়-চোপড় সবকিছুই লণ্ঠিত হয়েছে। মিস্টার ফ্রষ্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।
ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লন্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?
শেখ মুজিব- পাকিস্তানী ফৌজ আমার সবকিছু লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী আসবাব-পত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য-সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরী ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটিরই মূল্যবান দলিল-পত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে। কেন ওরা সব কিছু লুণ্ঠন করল?
শেখ মুজিব- এর কি জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা, ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর, ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা কেউ রেহাই পেল না। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আপনি অবশ্যই দেখেছেন জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া বাড়ি, বস্তি। একেবারে গরীব, না খাওয়া মানুষ বসবাস করতো এই বস্তিতে। সেগুলোকে ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বস্তিতে আগুন দিয়েছে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের ওপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কী আশ্চর্য! ওদের ঘরে আগুন দিয়ে, ঘর থেকে বের করে খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে!
শেখ মুজিব-হ্যাঁ এমনিভাবে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কেন মানুষ মারল? তারা কেন পরোয়া করল না?
শেখ মুজিব- না তারা কোন পরোয়া করেনি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কেবল হত্যার জন্য হত্যা। যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব-ওরা জানে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ, তাই প্রত্যেককেই হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনি কি মনে করেছেন। আপনি কি মনে করেছেন মানুষ আসলেই ভালো, না খারাপ।
শেখ মুজিব- ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে এমন মানুষ আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ ফৌজগুলো মানুষ নয়, পশুর চেয়ে অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র নেই তা নয়। কিন্তু মানুষ যে পশুর অধম হয় কি করে। ওই বাহিনীতো পশুর চেয়েও অধম। কারণ একটা পশু আক্রান্ত হলেই কিন্তু আক্রমণ করে, না হয় করে না। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসিকে কেবল হত্যাই করেনি। দিনের পর দিন মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন ৭দিন ১৫ দিন নির্মম অত্যাচার করেছে আর হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সে বিচার সম্পর্কে আপনি আমাদের কিছু বলুন।
শেখ মুজিব- ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। এদের মধ্যে ৫ জন ছিল সামরিক অফিসার, বাকীরা ছিল বেসামরিক অফিসার।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনলো তারা?
শেখ মুজিব- অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পাকিস্তানের ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ, আরো কত কি। বারো দফার অভিযোগ। এর ছটাতে একেবারে ঝুলিয়ে ফাঁসি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন উপায় ছিল?
শেখ মুজিব-সরকারের পক্ষ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই। দেখলাম যে এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বললামঃ জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান শাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমোদনের কর্তাও তিনি। এই আদালত গঠন করেছেনও তিনি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-তার মানে তার হাতেই ছিল সব।
শেখ মুজিব- সে ছিল দন্ডমুর্খের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।
ডেভিট ফ্রষ্ট-তার মানে আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন।
শেখ মুজিব- আরতো কোন উপায় ছিল না, আমিতো ছিলাম বন্দি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-হ্যাঁ তাতো বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তো কোন মূল্যে ছিল না। ওরা কি বিচার শেষে সরকারীভাবে কোন রায় তৈরী করেছিল।
শেখ মুজিব- ৪ ডিসেম্বর ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান হয়ে উঠেন সব কিছুর বিচারক। যথা- লেফটেন্যান্ট, কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার, এদের সবাই’কে পাঠায় রাওয়ালপিন্ডিতে রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ওরা ঠিক করলো ওরা আমাকে ফাঁসি দিবে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আর তাই জেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওরা আপনাকে ওখানেই কবর দেবে?
শেখ মুজিব- হ্যাঁ আমি আমার চোখের সামনে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম : আমি জানি এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে কোন পরোয়া নেই, আমি প্রস্তুত আছি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা কি বলেছিল, ওটা আপনার কবর?
শেখ মুজিব-ওরা তা বলেনি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিব- ওরা বলল, না না তোমার কবর নয়। ধরো যদি হঠাৎ বম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে সেল্টার নিতে পারবে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-সে সময় আপনার মনের চিন্তা কী ছিল? আপনি কি সারাটা সময় অর্থাৎ এই নয় মাস কি মৃত্যুর চিন্তায় কাটিয়েছিলেন।
শেখ মুজিব- আমি জানতাম ওরা যে কোন সময়েই আমাকে শেষ করে দিতে পারে। কারণ ওরা অসভ্য বর্বর।
ডেভিট ফ্রষ্ট-এমন অবস্থায় আপনার কেমন করে সময় কাটতো? আপনি কী প্রার্থনা করতেন?
শেখ মুজিব-এমন সময় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি। আমার পৌঁনে আট কোটি মানুষের উপর আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে ভাইয়ের মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জেগেছে? আপনার দেশের কথা, না আপনার পুত্র-পরিজনের কথা?
শেখ মুজিব-আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আত্মীয় স্বজনদের চাইতেও আমি দেশকে সব সময় বড় করে দেখেছি। আপনিতো দেখেছেন তারা আমাকে কত ভালবাসে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-হ্যাঁ একথা আমি বুঝি, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা।
শেখ মুজিব- জনগণই আমার সব। আমিতো জানি আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। সবাকে-ই একদিন চলে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস মানুষ মরবে সাহসের সঙ্গে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কিন্তু ওরাতো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কিন্তু কে আপনাকে রক্ষা করেছিলেন বলে আপনি মনে করেন।
শেখ মুজিব- আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিল। একি যথার্থ?
শেখ মুজিব-ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল। কতকগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। আমার মনে হয় আমার তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের উপর পড়েছিল। আমার উপর তার অনেকটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তবা যে অফিসার এমনো বুঝতে পেরেছিল যে ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ রাত তিনটায় আমাকে সে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিয়ে তার নিজ বাংলোয় আমাকে আশ্রয় দিল। দু’দিন আমার উপর কোন সামরিক পাহারা ছিল না। দু’দিন পর ওই অফিসার আবার আমাকে একটি আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার পাঁচ কিংবা ছ’দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ডেভিট ফ্রষ্ট-শেষ মুহুর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব-হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিলঃ মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেয়া।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!
শেখ মুজিব- হ্যাঁ, ভুট্টো একথা আমায় বলেছিল এবং আরো বলেছিলেন ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে।’ কিন্তু তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি ভুট্টো।
ডেভিট ফ্রষ্ট- ভূট্টো কি জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব- হ্যাঁ বলেছিল।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কি বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিব-ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন-‘না, আমি তো তা হতে দিতে পারি না। তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের একলাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙ্গালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সঙ্কটজনক। ভুট্টো একথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর কাছে আমি অবশ্যই এজন্য কৃতজ্ঞ।
ডেভিট ফ্রষ্ট-শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সাথে আপনার স্বাক্ষাৎ ঘটে তাহলে আপনি কী করবেন?
শেখ মুজিব- ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দি করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কি করবে? আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিব- মিস্টার ফ্রষ্ট, আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কি ঘটেছে। শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে ওরা হত্যা করেছে। ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘর-বাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলোকে ওরা ধ্বংস করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ, একথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?
শেখ মুজিব- আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনো আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি। সংখ্যা হয়ত একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লাখের কমতো নয়ই।
ডেভিট ফ্রষ্ট-কিন্তু এমন হত্যাকান্ডতো নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা।
শেখ মুজিব- হ্যাঁ, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তি প্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে, যে গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়তো কিছু জানতো না। সে গ্রামে পাকিস্তানি ফৌঁজ ঢুকে পাখি মারার মতো গুলি করে এই মানুষকে হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট- আমারও প্রশ্ন কেন এমন হলো?
শেখ মুজিব-না, আমি জানি না। আমি বুঝি না। এ রকমটা পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। ওরা নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই বলে। অথচ ওরা নির্যাতন ও হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনো অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পুত্রের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন! আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রোধ করতে পারিনা। এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কী ভাবে? এরাতো পশুরও অধম। মনে করুন, আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন প্রাক্তনমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাকে নির্যাতন করে করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথমে তার এক হাত কেটেছে। তারপর তার আর একটা হাত কেটেছে। তারপর তার কান কেটেছে। তার পা কেটেছে। ২৪ দিন ব্যাপী চলেছে এম নির্যাতন। (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন) কিন্তু এতো একটা কাহিনী। আমাদের কতো নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারী কর্মচারিকে জেলখানায় আটক করে সেখান থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘওতো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা কী চেয়েছিল?
শেখ মুজিব- ওরা চেয়েছিল, আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনিতো জানেন মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙ্গালি পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙ্গালি সশস্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙ্গালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙ্গালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র-সকলকে হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব-হ্যাঁ, স্যারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৫০ জন। সারাদেশে ৩০০ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিক্যাল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এই সব মানুষকে হত্যা করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-মানে-কারফিউ জারি করে খবরা-খবর বন্ধ করে হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব-হ্যাঁ, তাই করেছে।
ডেভিট ফ্রষ্ট-শেখ সাহেব, আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া খান দূর্বল চরিত্রের লোকক, যাকে অন্যরা সবাই খারাপ বলছে, না সে নিজেই একটা দস্তর মত খারাপ লোক?
শেখ মুজিব-আমি মনে করি, ও নিজেই একটা নরাধম। ও একটা সাঙ্ঘাতিক লোক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন জন-সাধারণ নেতা হিসাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময়েই আমি দেখেছি।
ডেভিট ফ্রষ্ট-সে আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাই না?
শেখ মুজিব- সে আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে কি করতে যাচ্ছে। তবে আমি আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং আঘাত সে পেয়েছিল।
ডেভিট ফ্রষ্ট- বন্দি হওয়ার পরে আপনি কি ওকে দেখেছিলেন?
শেখ মুজিব-না, না।
ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টোর এখন কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব-আমার মনে হয় ওর প্রকাশ্যে বিচার হওয়া উচিত।
ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি কি মনে করেন ভুট্টো তা করবে?
শেখ মুজিব-তাঁর করা উচিত?
ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টো সম্পর্কে এখন আপনার ধারণা কি? আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একদিন তিনি মুক্ত ঢাকায় আসবেন? তিনি কি কখনো আলোচনার জন্য এখানে আসবেন?
শেখ মুজিব-আমি জানি না। তবে আগে সে বর্তমান বাস্তবতা অনুধাবন করুক, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ তার ভূ-খন্ড বলে চেঁচিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওরা যদি এক পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকে, তবে এটা জানুক যে, আমি হচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আমি দাবি করতে পারতাম আমি হচ্ছি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসক, এবং গোটা পাকিস্তান আমার এলাকা। আমি জাতীয় সংসদের সভা ডেকে গোটা দেশের নাম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি এবং তাদের বলতে পারি পশ্চিম পাকিস্তান হচ্ছে আমার এলাকা। আমি ভুট্টোকে বিদায় নিতে বলতে পারি এবং তাঁকে জানাতে পারি যে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের গভর্ণর আমি নিয়োগ করছি। আমি তাকে বলতে পারি এটা আমার ভূখন্ড এবং আপনি বিদায় হোন, নতুবা মিত্র বাহিনীসহ আমি আবার সৈন্য পাঠাব ও পশ্চিম পাকিস্তান দখল করবো। তবে আমি এই গন্ডগোল চাই না। আমার কোনো ভূখন্ড নেই। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে খুশি থাকুক। যদি তারা পশ্চিম পাকিস্তান নাম ব্যবহার করতে চায় তারা সেটা করুক। আমার কোনে আপত্তি থাকবে না। আমি বাংলাদেশে আমার জনগণকে নিয়ে সুখি হতে চাই। আর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এটা আমার এবং আমার সাত কোটি জনগণের দেশ।
সংগ্রহ-ফাদার অব দ্য নেশন
১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম রাষ্ট্রিয় সফরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
মহান নেতা শ্রীমতী গান্ধী, আমার ভাই ও বোনেরা,
আপনাদের আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহণ করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহণ করে এনেছি। আপনারা জানেন যে, সাত কোটি বাঙ্গালি কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানের নরপশুর দল, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দল, আমার সাত কোটি মানুষের উপর যে অত্যাচার করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোন জায়গাতে তার তুলনা হয় না। আজ আমার গ্রামে গ্রামে গৃহহারার আর্তনাদ। আজ আমার গ্রামে গ্রামে সর্বহারার আর্তনাদ। আজ আমার মানুষ পথের ভিখারী। আজ আমার মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার ১ কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। সেদিন যদি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আপনাদের মহান নেতা, ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিম বঙ্গের জনসাধারণ, ত্রিপুরার জনসাধারণ, মেঘালয়ে জনসাধারণ, আসামের জনসাধাণ তাদের স্থান না দিতো, তাদের খাওয়া না দিতো, তাদের আশ্রয় না দিতো, তাদের সান্তনা না দিতো, তাদের অবস্থা কি হতো, আমি যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাহলে শ্রীমতী গান্ধী, অন্যায় করা হবে। আমি আপনাদের শ্রদ্ধা জানাতে পারি এর বেশি জানাতে পারি না। আপনাদের এই দান কোন দিন আমরা শোধ করতে পারব না। স্বাধীনতা পেয়েছি, বড়ো রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এতো রক্ত কোন জাতি, কোন দেশে কোন দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা ৪০ খানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কার্ফূ আইন জারী করে আমার জ্ঞানী-গুণী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার ১ কোটি লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সহকর্মীরা আপনাদের দুয়ারো এসেছে, আপনাদের কাছ থেকে জানের সংগ্রাম করার জন্য। সংগ্রাম তারা করেছে। মানুষের মতো সংগ্রাম করেছে। আমি তাদের যাওয়ার সময় অস্ত্র দিতে পারি নাই। আমাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় আমি জানতাম না আমি মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারব কিনা। কিন্তু আমার মানুষকে আমি বলে গিয়েছিলাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য, আমার কথা তারা রেখেছে। গত ৭ই মার্চ তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের উপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা ঘরে ঘরে দূর্গ তৈরি করো। আমি বলেছিলাম যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করো। আমি বলেছিলাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার লোকেরা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলে সংগ্রাম করেছে। সে সংগ্রামে কামিয়াব হতে পারতাম না যদি ভারতের জনসাধারণ, ভারতের সরকার, ভারতের সামরিক বাহিনী শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্বে এগিয়ে না আসত। আমি আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমার দেবার মতো কিছুই নাই। শুধু আমি এইটুকু দিতে পারি নিঃস্ব রিক্ত আমি আমি, দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালবাসা, দিলাম শুধু তাই।”
ভায়েরা আমার, আমাদের এ সংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। কলকাতার কথা বলছি। এই জায়গায় আমি লেখাপড়া করেছি। এই মাটির সঙ্গে আমার সম্বন্ধে বহু দিনের ছিলো। কিন্তু আমরা যদিও দু’দেশ হয়েছিলাম কিন্তু এমন একটা চক্রের হাতে পড়েছিলাম যে, আপনাদের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধে রাখতে পারি নাই। তারা শুধু আমার স্বাধীনতার হরণ করে নাই, তারা আমার মাতৃভাষার ওপর আঘাত করেছিল। তারা আমার সংস্কৃতির উপর আঘাত করেছিল। তারা শুধু তাই করে নাই, শোষণ করে বাংলাকে সর্বশান্ত করেছিল। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। বার বার মোকাবেলা করেছি। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আপনাদের জানা আছে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালে যখন ঢাকা পৌঁছি কলকাতায় কয়েক মিনিট আমি ছিলাম তা জানত, তার কয়েক ঘন্টা পরেই ঢাকা শহরে আমি গ্রেফতার হই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করেন পাকিস্তানে। এই আইন করা হয়েছিল বাংলাকে শোষণ করার জন্য, এই আইন করা হয়েছিল বাংলাকে কলোনি করার জন্য। এই সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল বাংলার মানুষকে পথের ভিখারী করার জন্য। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ভায়েরা জীবন দিয়েছিল। আমরা কারাবরণ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষ আপনারা খবর না পেলেও বাংলার মানুষ মাথা নত করে নাই। তারা সংগ্রাম চালিয়েছিল এবং সংগ্রাম চালিয়েছিল ১৯৬২ সালে। আমার ছেলেদের ওপর গুলি চালালো। ১৯৬৬ সালে আমার ছেলেদের, মা-বোনদের ওপর গুলি চালায়, ১৯৭০ সালের অপর ইতিহাস আপনারা জানেন। আপনাদের কাছে কী বলবো। এসংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই, বহুদিন থেকে শুরু হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের তিনটা আদর্শ ছিল, সে আদর্শ এ সভ্য জগতে চলতে পারে না। কী ছিল তাদের আদর্শ? ভাগ করেছে দুটো দেশ হয়েছে। তাদের একমাত্র শ্লোগান ছিল, “সব নেতা এ খতমে মে হায়। কাশ্মীর কো ফতে করনে পড়ে গা, হিন্দু হামারা দুশমন হায়।” আর কোন শ্লোগান নাই, আর কোন আদর্শ নাই, মানুষ না খেয়ে মরছে তার কথা বলবে না। কতোটা মানুষ পথের ভিখারী হচ্ছে তার কথা বলবে না। দুঃখী মানুষের গায়ে কাপড় নাই তার কথা বলবে না। হিন্দুস্থান আমার দুশমন। হিন্দুস্থান কেন আমার দুশমন হবে? ভারতবর্ষ কেন আমার দুশমন হবে? তারাতো আমার ভাই। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা ভাই হিসাবে বাস করবো। এরই মধ্যে বাংলায় প্রতিবাদ উঠেছে। কিন্তু আমরা, আপনারা জানেন যে তেইশ বছর পর্যন্ত শতকরা ৫৬ জন লোক আমাদের। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হতো। বাঙ্গালিদের সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হতো না। কারণ বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তাদের উপায় ছিল না। তাই বাঙ্গালিকে অস্ত্র দেওয়া নিষেধ ছিলো। আমার মতো মানুষের যদি একটা বন্দুক লাইসেন্স করত, নিতে হতো, তো দশবার ঘুরে একটি লাইসেন্স করতে হতো। মনে করেছিল বন্দুক দিয়েই বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখবে। আহম্মকের দল জানে না যে জাতি একবার জাগে উঠে, যে জাতি মুক্তিপাগল, যে স্বাধীনতাকে ভালবাসে যে জাতিকে বন্দুক কামান দিয়ে দাবায়ে রাখা যায় না। আহম্মকের দল তারা জানে না। ইতিহাসে তারা পড়ে নাই। ভাইরা আমার, তাই আপনারা জানেন যা কিছু সামান্য আমার পুলিশের লোক ছিল তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শতকরা ৬০ ভাগ বাঙ্গালি পুলিশকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যা কিছু আমার শিক্ষিত লোকছিল তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রাস্তা বাংলাদেশে নাই শেষ করে দিয়ে গেছে। শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যাবার আগে কতগুলো খাবার গুদাম ছিলো যার মধ্যে আটা ময়দা চাউল ছিলো, তা পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কী অবস্থায় আমাদের ফেলে গেছে তারা। আমি নিশ্চয়ই মোবারকবাদ জানাব স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধীর সরকার এবং ভারতের জনসাধারণ আমাদের সাহায্য দিয়েছেন যাতে অন্ততঃপক্ষে আমার লোকগুলো দাঁড়াতে পেরেছে। তবে একথা সত্য আমার লোক না খেয়ে সংগ্রাম করেছে। আমার লোক এক এক করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমার লোকের একতা আছে এবং একতাবদ্ধভাবে যদি আমি সংগ্রাম করি আমার দেশকে গঠন করার জন্য আমি বিশ্বাস করি সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ আবার হেসে ওঠবে। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলার মাটি বড়ো সুন্দর মাটি, বাংলার মাটি পলি মাটি, বর্ষাকালে বাংলার মাটি বড়ো নরম হয়ে যায়।
আমি একবার এই বক্তৃতা করেছিলাম পল্টন ময়দানে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুমিয়ার করে দিয়ে বলেছিলাম যে, ভুলে যেও না এ বাংলা তিতুমীরের বাংলা, ভূলে যেওনা এ বাংলা সূর্যসেনের বাংলা, ভুলে যেওনা এ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বাংলা, ভুলে যেওনা এ বাংলা ফজলুল হকের বাংলা। ভূলে যেওনা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা। এ বাংলা যেমন পলিমাটির বাংলা, চৈত্রে বিচুর্ণ হয়ে যায়।
তারা আমার কথা মানে নাই। তারা বার বার আমাকে, একবার আমাকে করল আগরতলা মামলার আসামী, আমাকে ফাঁসি দেবে, দিতে পারল না। বাংলার মানুষ আমাকে কেড়ে আনল ওদের কয়েদখানা থেকে। এবার আপনাকে মোবারকবাদ জানাই বেশী করে শ্রীমতী গান্ধী। আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়েছিল আমাকে ফাঁসি দেবার জন্য, তারা সমস্ত কিছু ঠিক করে ফেলেছিল। আমি জানি, আপনি দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। আপনি দেশে দেশে ঘুরেছেন, আমার দুঃখী মানুষের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। সেজন্য আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার দুঃখ ছিল না, আমি মরবার জন্যই প্রস্তুত হয়ে হুকুম দিয়েছিলাম। মৃত্যু স্বাভাবিক। বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমার বাংলাদেশের মানুষকে পশ্চিমা শোসকগোষ্ঠী এবং দানব গোষ্ঠী দাবায়ে রাখতে পারবে না। দুনিয়ার অনেক দেশ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের জনসাধারণ, লন্ডনের জনসাধারণ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছেন এবং তাদের সাংবাদিকরা আমাদের অনেক সমর্থন করেছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু আমেরিকার সরকারকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই না। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না। ভারত এগিয়ে এলো আমার জনসাধারণকে সাহায্য করার জন্য যখন আমার বাংলার গ্রামে গ্রামে হত্যাকান্ড চলছিল, যখন দুধের বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল আমেরিকার গভর্নমেন্ট কি জানতেন না সে খবর। তার মেশিনারী আমার বাংলায় ছিল তারা জানতেন। কেমন করে তিনি অস্ত্র দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীর হাতে। কেমন করে তিনি ভারতবর্ষের সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। ভারত জনসাধারণও দুঃখী জনসাধারণ। তাদেরও কষ্ট আছে। তারাও তাদের মুখের গ্রাস ভাগ করে আমার বাংলার মানুষকে খাইয়েছেন। সেই সময় তাদের সাহায্য বন্ধ করার অর্থ কি? সাত কোটি লোকের বাজার রাখার জন্য? আপনাদের দালালেরা পশ্চিম পাকিস্তানের দালালেরা বাংলাদেশকে বাজার রাখবে-এই উদ্দেশ্য? আমি আমেরিকার সরকারকে, আমি তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। তবে এটুকু বলতে চাই আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞা প্রকাশ করতে পারলাম না। আর আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন। মুখে মুখে, মেহেরবাণী করে গণতন্ত্রের কথা না বলে গণতন্ত্র যাতে চলে সেদিকে একটু খেয়াল রাখুন। দুনিয়ায় সামাজ্যবাদীর দিন চলে গেছে। ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশে সামাজ্যবাদী খেলা চলবে না। এ বিশ্বাস আমার আছে।
ভায়েরা আমার. নীতির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। আজ আমার দেশ সার্বভৌম। বিশ্বাস করেন পশ্চিম পাকিস্তানের গরীব ভাইদের বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নাই। আমি চাই তারা সুখে থাকুক। আমি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করিনা। কিন্তু তারা যদি মনে করে থাকেন এখনো বিদেশে ঘুরে ঘুরে বলেন যে, বাংলাদেশ তাদের অংশ। তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হবে তাদের পাগলাগারদ ছাড়া আর কোন জায়গায় স্থান নাই। আমরা ছিলাম সংখ্যায় বেশি। আমরা ঘোষণা করেছি আমার দেশ স্বাধীন। তুমি কোন জায়গার মাতবর হয়ে পড়লা, তুমি বলছ সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়! বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। তোমার ক্ষমতা নাই বাংলার স্বাধীনতা হরন করার। বিনা অস্ত্রে যদি আমার বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারে, আজ বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও, আর কোন খেলা খেলতে চাও, মনে রেখো-সাত কোটি বাঙ্গালির একটা প্রাণ থাকতে বাংলার মাটিতে ঢুকবার ক্ষমতা তোমাদের নাই।
“নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
কান্তির ললিত বানী মোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।”
আমার বাঙ্গালীরা প্রস্তুত আছে। নাগিনীদের আমরা চিনি। ভয় নাই আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়া ঘুরে আপনার জন্য মুক্তি কামনা করেন। আর বাংলার স্বাধীনতা সমর্থন করেন ব্যাপার কি? আমি বরি ব্যাপারটা পরিস্কার এবং সোজা। আপনি যদি বুঝতে চান বুঝবার চান না বলেই বুঝেন না। এটা হলো নীতির মিল। এটা হলো আদর্শের মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের, তিনি বিশ্বাস করেন গণতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, তিনি বিশ্বাস করেন সমাজতন্ত। আমি বিশ্বাস করি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট। আমি বিশ্বাস করি জাতীয়তাবাদ। তিনি বিশ্বাস করেন জাতীয়তাবাদ। এটা নীতির মিল, এটা আদর্শের মিল। সেইজন্যে হয়েছে আমাদের বন্ধুত্ব। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কেউর ক্ষমতা নেই আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারে।
ভায়েরা আমার, আমার দেশে সাম্প্রদায়িকতা, বাংলার বুকে নাই আপনারা দেখেছেন। ভারতের জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ করবো যে ভারতের বুকে যেন সম্প্রদায়িকতার বীজ আর না আসে। কারণ এটা মনুষত্ব্যের বাইরে। এটা মানবতার বাইরে। এটা যে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে। সেই জন্যেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে বলা হয়, পুরাপুরি তা আপনাদের লালন করতে হবে।
আমি আপনাদের কোন রকম advise দিতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, কারণ আমরা অনেক সময় দেখেছি, যখন আমি বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছি তখন মাঝে মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্ব বাংলায় চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে। তার ফল হয়েছে ভারতবর্ষে যাতে আমার আন্দোলন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আর সেই জন্যই আপনাদের কাজে আমার আবেদন থাকবে, আর আমি আপনাদের আশ্বাস দিবার পারি যে বাংলাদেশ চারটি স্তম্ভের উপর চলবে-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর মধ্যে কোন কিন্তু ফিন্তু নাই। এর মধ্যে কেউ হাত লাগাতে পারবে না। এটা সোজাসুজি আমরা করব। আর আপনারা জানেন আমি সোজা মানুষ, সোজা কথা বলি, যা বলি যেটা বলি, যেটা বুঝি এবং সেটা করি। এরমধ্যে আমি ভয়ও করি না কাউকে এবং করবও না। আমার সোনার বাংলা সত্যি সোনার বাংলা, তাই আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করেছি-“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় বড়ো ভালবাসি। তাই আমি আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবার সময় বলে যাই আমাদের বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষয় থাকবে। আপনারা আমার সঙ্গে শ্লোগান দেন জয় ভারত, জয় ভারত, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় শ্রীমতী গান্ধী, জয় শ্রীমতী গান্ধী।
আমি যদি বলি বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী আপনারা বলবেন অমর হোক বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী ........
বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী ........
আমি আপনাদের আবার ধন্যবাদ জানাই।
বিশ্বাস করেন বক্তৃতা করা আমি সত্যি ভুলে গেছি। এই জন্য ভুলে গেছি। আমি জানতাম না যখন আমি পশ্চিম পাকিস্তানে জেলে থেকে আমার বাংলায় এতো সর্বনাশ হয়েছে। এমন কোন বাড়ি নাই, এমন কোন সংসার নাই, যে সংসারে এটি দুটো মানুষকে খুন করা হয় নাই। ঘরে ঘরে যারা জোয়ান যুবক ছিল, ছাত্র ছিলো, যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে হত্যা করেছে এই পাষন্ডের দল। দুনিয়া দেখে নাই, দুনিয়া জানত, কে এগিয়ে এসেছিল, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের জনসাধারণ, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের সরকার, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের সামরিক বাহিনী, এগিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা স্টেট, মেঘালয়, আসামের ভায়েরা। আমি আমার সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। জয় বাংলা।
[ক্যাসেটে ধারণকৃত ভাষণের অনুলিপি]
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আজ আমার প্রিয় বোনদের উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে দুটি কথা বলার জন্য আমি আনন্দিত। আপনারা আমার ডাকে সারা দিয়েছিলেন বলে মহাঘাতক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী আপনাদের বাধ্য করেছিল বাংলার শান্তির নীড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে। আমি জানি ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী আপনাদের বিষয় সম্পত্তি লুট করেছে। হত্যা করেছে আপনাদের বাপ-ভাই সন্তানদের। ইজ্জত নষ্ট করেছে আমার মা-বোনদের। কিন্তু দেশের ডাকে তবুও আপনারা আনন্দচিত্ত্বে সারা দিয়েছেন। নিজেদের অপিরসীম ক্ষয়-ক্ষতির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি। আপনারা চরম ক্ষতির স্বীকার হয়েছেন, চরম মূল্য দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। দেশবাসির পক্ষ থেকে তাই আমি আপানদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
আপনারা জানেন আমাদের দূর্দিনে ভারতের সুযোগ্য প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধি তাঁর সরকার ও ভারতের জনসাধারণ নিবেদিত বাংলার জনসাধারণকে অপ্রকাশিত সাহায্য দিয়েছেন। তারা আপনাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আহার যুগিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, সান্ত¦না দিয়েছেন, রোগে যাতনায় শুশ্রুসা করেছেন। আমি তাদের আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাদের জন্য সম্ভব সবকিছু করেছেন। তাদের এই মহানুভবতা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ৬০ লক্ষ শরণার্থী বাংলার মুক্ত মাঠ, ঘাট আপনাদের দু’বাহু বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। আমার সর্বস্বঃ অনুরোধ আপনারা দেশে ফিরে আসুন। নিজেদের ঘর আবার ঘরে তুলুন। বাংলার বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনঃগঠিত করুণ। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, আমি আপনাদের সাথে গিয়ে দেখা করার কিন্তু সময় বড় সংক্ষিপ্ত। এখন প্রধান কাজ হল দেশ গঠন ও আপনাদের পূনঃর্বাসন করা। আর আপনারা যে যার ঘরে ফিরে যান, সেখানেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করব। আপনাদের শুভ কামনা করে আমি বাংলাদেশের শ্যামল জনপদে আপনাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার, আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতেই প্রথম দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখ থেকে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুরু হয়না, সে আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকারের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন।
১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে ঐ সংগ্রাম শুরু হয়ে ৫২ সালে এ সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনিত হয়। সেদিন আমার দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিলাম, শহীদ হয়েছিল বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য। সেদিন শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিলনা। তারা রক্ত দিয়েছিল শুধু ভাষার জন্য নয়, তার সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধীকার, মানুষের মতো বাঁচবার অধিকারের সংগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেন নাই যে বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে। বাংলার মানুষকে দাবায়া রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের চরম সংগ্রাম। বছরের পর বছর এই দিনটি আমার দেশের ভাই ও বোনেরা, কৃষক শ্রমিক, ছাত্র জনতা পালন করেছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বারবার এই দিনটির উপর আঘাত হেনেছে। এই দিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারি নাই। কারণ শাষকগোষ্টি এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখত। এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করেছে। এমনকি যে সামান্য একটি শহীদ মিনার গড়ে উঠেছিল তার উপর বারবার এই ষড়যন্ত্রকারীরা এবং শোষক শ্রেণীরা আঘাত হেনেছে। তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাই বোন, অনেক জনসাধারণ জীবন দিয়েছে। স্বাধীকারের আন্দোলনে, স্বাধীনতার আন্দোলনে তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার। তারা চেয়েছিল যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈচাশিক শক্তি তা কোনদিন মানতে চায় নাই। হত্যা করেছে আমার মা বোনদের, হত্যা করেছে আমার ভাই বোনদের, আঘাত হেনেছে আমার সংস্কৃতির উপর, আঘাত করেছে আমার অর্থনীতির উপর। ধর্ষণ করেছে আমার মা-বোনকে। পথের ভিখারী করেছে বাংলার জনসাধারণকে। কিন্তু বাঙ্গালী জাত, যে জাত রক্ত দিতে জানে, যে জাত মরতে শিখেছে-সে জাতকে যে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না, পাকিস্তানীরা তা বুঝে নাই। তাই তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে। আজ স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য কিন্তু বড় রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। এত রক্ত কোন দেশে, কোন জাতি তার দেশের জন্য দেয় নাই। রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি এদেশের মানুষের মুখে আমরা হাসি ফুটাতে না পারি, যদি করতে হয় তাহলে এদেশের মানুষের মুখে আমা হাসি ফুটাতে না পারি, যদি এ দেশের মানুষ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারে এবং তা যদি করতে হয় তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ এবারে শপথ নিবে যে আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারব না। যদি শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এজন্য জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, দল মত নির্বিশেষে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক সংঘবদ্ধভাবে দেশ পুনঃর্বাসনের কাজে অগ্রসর হবে এটি আমরা আশা করি। এই দিনের শপথ আমাদের হবে-‘যে স্বাধীনতা এনেছি রক্ত দিয়ে, দরকার যদি হয় এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করব, যদি প্রয়োজন হয় আরো রক্ত দিয়ে। যদি প্রয়োজন হয় এদেশের মানুষকে গড়ে তোলার জন্য আরো রক্ত দিতে হয় তাও করব। কিন্তু করতে হবে আজ এই দিনে শহীদী রক্তের কথা মনে করে। যারা মারা গেছে, তাদের কথা স্মরণ করে, তাদের নামে শপথ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, বাংলার মাটিতে, আমার বাপ মার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে হবে এবং এদেশের মানুষ যাতে আর দুঃখ কষ্ট না পায়, আর কোনদিন অত্যাচার নীপিড়ীত না হয়, এইটাকেই স্মরণ করে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি বিশেষ করে আমার যুব সমাজ ভাইদের, কৃষক শ্রমিক ভাইদের-সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যান। আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই, নতুন করে গড়তে হবে। আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে উঠাই। একটা শোষণহীন সমাজ তৈয়ার করি। শহীদ স্মৃতি অমর হউক। জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পাবনা জেলার নগরবাড়ির জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু মুসলমান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অস্ত্র ধরেছিল এক পৈচাশিক শক্তির বিরুদ্ধে। তারা মানুষ নয়, তারা অমানুষ। তারা পশুর চেয়ে খারাপ। দুনিয়ার ইতিহাসে কোনদিন দেখা যায় নাই যে নিরীহ মা-বোনদের উপর অত্যাচার করে হত্যা করে। বৃদ্ধ-বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় রাস্তায় গর্ত করে স্তুপ করে রেখে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখি নাই যে মা-বাপের সামনে থেকে ধরে নিয়ে তাদের গায়ের সমস্ত রক্ত, হত্যা করে নদীতে মেরে ফেলে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই চামড়া উচিয়ে ফেলে দিয়েছে। তাজা মানুষের চামড়া উঠিয়ে ফেলে দিয়েছে তারপর নুন মেরে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই যে একদিন, দুই দিন, তিন দিন, চারদিন, মাসের পর মাস অত্যাচার করে আমার দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে। দুনিয়ার ইতিহাসে নাই এক কোটি লোক ঘর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমার বাংলাদেশের এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, জ্বালায়া দিয়েছিল। এদেশের আড়াই কোটি তিন লক্ষ মা-বোন আমাদের কাছে এসেছে এ পর্যন্ত। যাদের ঘরে ঘরে গিয়ে পাষবিক অত্যাচার করেছে। আমার আজকের ত্রিশ লক্ষ লোক, আমার বাংলার কৃষক, আমার বাংলার যুবক, আমার বাংলার শ্রমিক, আমার বাংলার ছাত্রদের হত্যা করেছে। আমি কল্পনা করতে পারি না। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কেন বেঁচে এলাম? আমার এই দেশকে দেখার জন্য! এদেশে আমার মানুষ আজ সর্বহারা, এদেশে আমার মানুষ আজ গৃহহারা, এদেশে আমার মানুষ আজ না খাওয়া। আজ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বেকার। পাটের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে দিয়েছে। কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে, পোর্ট নষ্ট করেছে, আমার সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করে দিয়ে চলে গেছে। এত রক্ত কোন দেশ কোন জাতি দেয় নাই যা আমার বাংলাদেশের ভাইয়েরা বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। খালি হাতের এই সরকার আমাকে নিতে হয়েছে। আমার দলকে নিতে হয়েছে। আমার শতকরা ৭০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে। আমার ই.পি.আরে শতকরা ত্রিশ জন চল্লিশ জন পঞ্চাশ জনকে করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমার ভালো ভালো কর্মচারীদের নিয়ে হত্যা করেছে। আমার বুদ্ধিজীবী কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, যারা যোগ্য লোক, যারা সাংবাদিক তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে কার্ফিও দিয়ে। দুনিয়ার মানুষ আশ্চর্য হয়ে যায়, যখনই খবর পায়, আমি আমার সহকর্মীদের বলি, ওরা আমায় বক্তৃতা করেত বলে। সত্যি আজকে আর আমি বক্তৃতা করতে পারি না। আমি আর সেই মুজিবর রহমান এখন আর নাই। আমার মুখের থেকে সে আগুন যে চলে গেছে। আমি যেন ভেঙ্গে পড়ি। আমি যখন চিন্তা করি, চারদিকে দেখি বাংলার গ্রাম শেষ, দেখি কৃষকের ফসল নাই, দেখি তাদের ঘর বাড়ি নাই, দেখি আমার পুলিশ বাহিনী নাই, দেখি তাদের পোষাক নাই, দেখি আমার শ্রমিক ভাইদের ত্রাণ দিতে পারি না, আমার কৃষক ভাইদের দুঃখি ভাইদের খাবার দেবার পারি না। আর আমার যে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ভাই বোনেরা এতিম হয়েছে, মা হয়েছে পুত্র হারা, স্ত্রী হয়েছে স্বামী হারা, ভাই হয়েছে ভাই ছাড়া-এদের আমি কি দিয়ে শান্তনা দিব? এদের কোথা থেকে আমি সাহায্য করব? কি করে এদের মুখে অন্ন দিব, কি করে এদের আমি পানি খাওয়ার বন্দোবস্ত করব? দস্যুর দল যাবার পূর্বে আমার মানুষদের শুধু হত্যা করে নাই, আমার সম্পদকে শেষ করে দিয়ে গেছে। আমার মুক্তি বাহিনীর ভাইয়েরা, তোমরা সংগ্রাম করেছ, জীবন দিয়েছ, তোমাদের কাছে আমার জাতি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সমস্ত জাত তোমাদের একটি অংশ। আমি তোমাদের, যাতে দেশ গড়তে, তোমরা কাজ করতে পার সেজন্য ক্যাম্পে এসে কার্ড জমা দিয়ে তোমাদের নাম রেজিষ্ট্রি করতে বলেছি। রেজিষ্ট্রি করার পরে যারা বাংলাদেশ রক্ষী বাহিনীতে যেতে চায়, যতদূর সম্ভবপর সেখানে নেয়া হবে। কিছু সংখ্যক নেয়া হবে পুলিশে। যারা ছাত্ররা, যারা যুদ্ধ করেছে, তারা লেখা-পড়া করার জন্য স্কুল কলেজে ফিরে যাবে। তাদের জন্য যতদূর সম্ভব সাহায্য সহযোগিতার বন্ধ্যোবস্ত করা হয়েছে। যারা মাঠে আছে তারা সার্টিফিকেট নিয়ে ২৯ তারিখের মধ্যে ক্যাম্পে গিয়ে আপনারা যার যার গ্রামে ফিরে যান। কাস্তে কোদাল হাতে নেন। যখন সময় আসবে, নিশ্চই আপনাদের আমি দেখব কি করে আপনাদের একটা ব্যবস্থা করা যায়। আপনাদের ভূললে চলবে না যে, ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে, তাদের সংসার রয়েছে, তাদের আমি কি দিতে পেরেছি? আপনাদের অন্তত এক মাসের খাবারের বন্দ্যোবস্ত করতে পারি না। কিন্তু ত্রিশ লক্ষ লোক যাদের মা ভাই বোন মারা গেছে তাদের আজ পযন্ত এক প্যাকেট খাবার দিতে পারি নাই। এক আনা পয়সাও দিতে পারি নাই। আমি করতেছি কোন রকমে ইষ্ট বেঙ্গলে এই ত্রিশ লক্ষ লোক যাদের মারা গেছে ভাই-বোন, তাদের সাহায্য করতে পারি কি না? যে বোনেরা আমার বিধবা হয়েছে, যে বোনেরা আমার বলতে পারিনা বুক ফেটে যায়, ধর্ষিতা হয়েছে তাদের আমার ক্যাম্পে রাখতে হয়েছে। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে লঙ্গরখানায় এনে তাদের আমি দিয়েছি, যাতে তাদের সংসার টিকে থাকতে পারে। যুবক ভাইয়েরা আমার, যে বোনোরা, আমার যে মেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বরদের কাছে ধর্ষিতা হয়েছে, তারা ইচ্ছে করে উজ্জত দেয় নাই, তাদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। তারা আমার মা, তারা আমার বোন, তারা আমার কন্যা।
তোমাদের যারা ত্যাগ দিয়ে তোমরা যুদ্ধ করেছ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, এই ত্যাগ নিয়ে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই মেয়েদের তোমাদের অনেকের বিবাহ করতে হবে। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যুদ্ধ শুধু অস্ত্রই নিতে পারো নাই মা বোনের ইজ্জতও যেন এগিয়ে দিতে পেরেছ। তারা ধর্ষিত হয়েছে তাদের দোষে নয়, স্বাধীনতার সংগ্রামে। যেমন তোমাদের উপরে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে তাদের উপরও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যারা আমার ভক্ত, তোমরা যারা আমার কথায় শহীদ হয়েছ, তোমরা যারা আমার কথায় সরকার করেছ। তোমাদের কাছে আমার বড় ভাই হিসেবে, তোমরা আমাকে আদর করে মুজিব ভাই বল, এই হিসেবে তোমাদের কাছে আমার এই আবেদন রইল-তোমরা জেলায় জেলায় লিষ্ট কর, যারা ধর্ষিতা কন্যাদের সাদী করতে চায়। তাদের জন্য আমি সব ব্যবস্থা করব যা আমার তওফিকে কুলায়।
যারা আমার কথা শুনে না, যারা আমার হুকুম মানেনা, তারা মুক্তি বাহিনী নয়, তারা বদর বাহিনী, রাজাকার। আর আজকে কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু ছেলে, যারা বদর বাহিনী, রাজাকারে ছিল ১৬ তারিখের পরে জামা বদলাইয়া মুক্তিবাহিনী হয়েছে। তারা লুটতরাজ করে, মা-বোনদের উপর অত্যাচার করে, তারা অন্যের সম্পত্তি লুট করে আর গাড়ী দখল করে, বাড়ী দখল করে। আমি পরিস্কারভাবে বলে দেবার চাই এ রকমের যে অত্যাচার অবিচার করবে, আমি পুলিশ ব্যবহার করতে চাইনা, পুলিশ দিয়ে আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম করি নাই- আমি করেছি সাড়ে সাতকোটি লোক দিয়ে। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তাদের প্রতিরোধ করো, তাদের দাবাও।
আজকে এই গ্রামে-গ্রামে শহরে শহরে যারা দেশকে ভালবাসে, তারা গুন্ডা বদমাইশদের শাসন করো। শুধু মনে রেখো কোন লোক নিরাপরাধ লোকের উপর যেন অত্যাচার না হয়। আমার মুখের উপর যেন কালি না পরে। দ্বিতীয় কথা আরেকটা কথা বলে দেবার চাই, নেতৃবৃন্দের রিকমান্ড করা বন্ধ করে দেন। সাত কোটি মানুষের নেতা আমি। সাতকোটি লোকের টাকা। সাতকোটি লোক আমাকে ভালবাসে, আমি তাদের ভালবাসি। আমার চোখে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। আপনারা রিকমান্ড করা বন্ধ করেন। যার যা শক্তি আছে, যতদূর যার বুদ্ধি আক্কেল আছে, সেভাবে সরকারী সুযোগ সুবিধা পাবেন। তার উপরে আমার দলের মন্ত্রী হন অন্যদলের নেতা হন, প্রাক্তন নেতারা হন, যুক্তফ্রন্টের ভাইরা হন, তারা মনে রাখবেন দলের লোকরে খুশি করার জন্য রিকমান্ড দিবেন না। আর যে লোককে রিকমান্ড দিবেন, আমি আমার সরকারকে হুকুম দিয়ে দিয়েছি, তার চাকুরী কোনদিন জীবনে হবে না। একগ্রামে বাস করইন্যা ছেলে তোমাদের কাছে যেতে পারে না। শহরের লোক তোমাদের বাড়িতে বাড়িতে যাবে, তোমরা দরখাস্ত করবে। আমি ক্রমিক নং বসাইয়া দেবো। সে ক্রমিক নং অনুযায়ী ইন্টারভিউ হবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী তার চাকুরী হবে। কোন সুপারিশ এদেশে চলবে না। তবে যারা মুক্তিবাহিনীতে সংগ্রাম করেছে, যারা সার্টিফিকেট পেয়েছে, তারা ২৯ তারিখে ক্যাম্পে ছেড়ে চলে যাবে, তাদের জন্য একটা প্রভিশন রাখা হয়েছে-যাতে তাদের প্রতি প্রথমে সুবিচার করা হয় এবং তাদের জন্য দরকার হলে একটা কোটা করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য আমার কাজ করতে হবে। পৃথক সুযোগ-সুবিধা নেয়া উচিৎ হবে না।
ভাইয়েরা আমার, আমি বলেছি আমি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছি। ফাঁসির কাষ্ট থেকে আসছি আমি শুধু খালি হাতে নয়, খালি হাত হলেও ভাল হয়। খালি হাত থেকেও খারাপ অবস্থায় এই সরকার ক্ষমতা নেয়। টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা যা ছিল চুরি কইরা লুটের দল বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়া গেছে। আমাকে দিন-রাত ভিক্ষা করতে হচ্ছে যে আমারে চাল দাও, আমারে ঔষধ দাও, আমারে কাপড় দাও, আমারে ডাল দাও, আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমি পারিনা, সত্যি আমি পাগল হয়ে যাই। জেল থেকে বের হয়ে আইস্যা নামার পর থেকে আজো পর্যন্ত একটা দিন কেমন করে ভালো বিশ্রাম করতে হয়, তা আমি জানি না। আমি বিশ্রাম চাইনা, আমার প্রয়োজন নাই। যতদিন বেঁচে আছি কাজ করে যাব, তারপরে আমি বিদায় হয়ে যাব।
সংগ্রামে নামছিলাম মরবার জন্য। বেঁচে যে আছি আপনাদের দশ জনের দোয়া। এছাড়া বাঁচবার আমার কোন উপায় ছিলনা। আপনাদের কাজ করতে হবে। কিচ্ছু নাই আমার। যদি কেউ বলেন এটা দেন ওটা দেন, আমি বলি কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু দেবার পারব না। চেষ্টা করছি আনার জন্যে যদি আসে পাবেন। যদি না আসে আমি পারব না। আমি আমার স্বাধীনতা বিক্রি করতে পারব না। আমি আমার লোকদের গোলাম করতে পারব না। আমি সাহায্য চাই। আমরা সাহায্যের জন্য স্বার্থ ছাড়ব না। আমি দুনিয়ার খেলা বুঝি। আবার যদি আমি আপনাদের গোলাম করে যাই, মরে গেলেও আমি আর শান্তি পাবনা। বহু রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা এনেছি, আপনারা এনেছেন। এ স্বাধীনতা রাখতে হবে। শান্ত হন, কষ্ট করতে হবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল হয়না। আর সাত কোটি মানুষের গাছ, গাছকে পথের ভিখারী করে দিয়ে গেছে। তাঁকে বাঁচাতে হলে কি প্রয়োজন আপনারা তা বুঝেন। আমি কি করব? আমার কৃষক খাজনা দিবার পারে না। আমি বলে দিলাম, গভঃর্ণমেন্ট বলে দিল বকেয়া খাজনা সুদসহ সব মাপ। কি বলে মাপ পাইছেন না। তাহল গভঃর্ণমেন্টের টাকা আসবে কোত্থেকে। মাপতো কইরা দিছি। নুনের উপর ট্যাক্স মাপ, গভঃর্ণমেন্ট কোন ট্যাক্স পেল না। এ রকম করে গরীবের যা ছিল, সেগুলো মাপ কইরা দিছি। ২৫ বিঘা যাদের জমি আছে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা, মনে আছে আপনাদের বলেছিলাম, এখানে আগে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাপ হয়ে যাবে। মাপ কইরা দিছি আর খাজনা দিতে হবে না। শুনেন ট্যাক্স দিতে হবে, না হলে জমির মালিকানা থাকা কষ্টকর হবে। যদি দেন অন্যান্য যে ট্যাক্স আছে তা দিতে হবে, না হয় সরকার চালানো যাবে না। যাতে আপনাদের সহজ সরল পাইয়া এনের টাকা হেন দিয়া, হেনের টাহা ওনে দিয়া দুই টাহা পাঁচ টাহা নিয়ে দৌড় না পারতে পারে সেজন্য ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাপ সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে এই যে কুড়ালি পয়সা যদি আমার থাকত আমি বলতাম দিলাম পয়সা, খুড়াও কুড়াল, পয়সা নাই বলে আমি বলছি। আমিও কুড়াল মারি, তোমরাও মার। ইনভেষ্টমেন্ট যত রাস্তা খাল এগুলো আপনাদের কাটতে হবে। তাছাড়াও কিছু কিছু জায়গাও ব্যাক্তিগতভাবে আপনাদের দিছি। এরমধ্যেও দিয়া ফেলেছি, তাই আল্লাহর মর্জি আপনাদের দোয়ায় দুনিয়ার ৪৫ টি দেশ বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা ঐ পশ্চিশ পাকিস্তানের নেতারা যে লাগছে, সে দাবা খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমার ভাই ভুট্টো সাহেবের হারাধনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সুখে থাক। তোমাদের কাছে মাপ চাই, আর না। তোমরা যা করে গেছ, তা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মা-বোনেরা জানত, তাহলে মনে হয় সে দেশেও আগুন জ্বলে উঠত।
তবে একথা সত্য আমার চার লক্ষ বাঙ্গালী আছে পশ্চিম পাকিস্তানে, সরকারী কর্মচারী আছে, সামরিক বাহিনীর লোকেরা আছে, আমি চাই তোমার লোক তুমি নিয়ে যাও, আমার লোক আমাকে দিয়ে দাও। তবে মনে রেখ, যারা আমার বোনকে হত্যা করেছে, যারা আমার ভাই বেরাদরকে হত্যা করেছে, যারা আমার মা-বোনকে পথের ভিখারী করেছে, যারা আমার নিরাপরাধ দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে-সে হিসাব বাংলার মাটিতে দিতে হবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকে। আর যারা দালালী করেছে, পশ্চিমারা দালালী করেছে, যারা পশ্চিমাদের রাস্তা দেখাইয়া দিয়া আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়াছে। যারা আমার ছেলেদের ধরাইয়া দিয়া গুলি করে মেরেছে। দল ওদের গ্রেফতার কর। কিন্তু নিরাপরাধ কোন লোকের উপর যেন হাত না চলে, দেশের বদনাম হবে। আল্লাহ বেজার হবে। আমি সবিনয় অনুরোধ করছি, স্কুলে-কলেজে আশ্রয়ে যারা আছে। যারা যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা আমার বাহিনীর ছেলেরা এবং যারা গরীব তাদের জন্য আমি কার্ড সাহায্যের বন্দ্যোবস্ত করে দিয়েছি। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। আজ স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার সোনার বাংলা গড়ে না উঠে। স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার ছেলেরা কাজ না পায়, কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। আপনাদের থেকে আসবে না যে, আমি তাড়াতাড়ি আপনাদের সবকিছু করে দেবার পারব। আপনাদের সহ্য করতে হবে, কাজ করতে হবে, খাটতে হবে। আর আমি বলেছি কৃষি বিপ্লব। আমার দুনিয়ার কাছ থেকে খালি থেকে খালি খাবার কিনতে হবে-পারব না। খাবার তৈরি করতে হবে। আপানাদের গ্রামে গ্রামে খাবার উৎপাদন করতে হবে। আমি জানি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু পয়সা কোথায়? চেষ্টা করতেছি। সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রাখতে হবে। এই দায়িত্ব যেমন সরকারের এই দায়িত্ব তেমনি জন সাধারণের। আপনারা সকলে যেমন নষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানীদের, টিক্কা ইয়াহিয়া খানদের, তারিয়ে ছিলেন, তেমনি করে গুন্ডা পান্ডা বদমইশদেরও তাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহর মর্জি মদ খাওয়া পাকিস্তানে ছিল। ওরা ইসলামি রাষ্ট্র, বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। ওটা ছিল ইসলামী রাষ্ট্র সেজন্য ওখানে মদ খাওয়া হতো। আল্লাহর মর্জি এখন এদেশে একদম বন্ধ। এদেশে মদ খাবে কেন? হারাম, বন্ধ করে দিলাম। আপনারা সেদিকেও খেয়াল রাখবেন, রাত্রিবেলা যেন পলাইয়া পলাইয়া মদ খাবার না পারে। এই মদ খাইলেই মাতলামি করে, মাতলামি করলেই বদমাশি করে, বদামাশি করলেই গুন্ডামি করে। এই মদ বন্ধ করতে হবে। আপনারা কাজ করেন, আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, আপনারা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। সেচ্ছাসেবক লীগ গঠন করেন। সেচ্ছাসেবক বাহিনী করেন। আর আমি রক্ষিবাহিনী গঠন করেছি, যারা আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে, পুলিশ বাহিনীতে তাদের নিয়েছি। আপনারা আজ আমাকে কথা দিন সবাই মিলে আপনারা কাজ করবেন কিনা। কোনে পুকুর নাই পুকুর কেটে দাও, কোনে রাস্তা নাই, রাস্তা কেটে দাও। যেখানে গরীব কাজ করতে পারে না, কাজ দিয়ে দাও। সকলে মিলে মিশে আপনারা কাজ করবেন কিনা আমি জানতে চাই। জয় বাংলা।
সংগ্রহ-সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমরা আজ শহীদ দিবস পালন করছি, লক্ষ লক্ষ ভাই বোনের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। খেলায় রাখবেন এই স্বাধীনতা যেন বৃথা না যায়। আজ যে আর্দশের জন্য আমার ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল সে আদর্শ সেদিন পূরণ হবে, যে দিন বাংলাদেশের মানুষ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারবে। আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল যে, আজ প্রতিজ্ঞা করুণ, যে পর্যন্ত না শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন না হবে, সে পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আমাদের চারটি আদর্শ। এই চারটি আদর্শ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে পর্যন্ত আমরা এই বাংলাদেশকে এই চারটি স্তম্ভের উপর গঠন করতে না পারব। সে পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
আমার দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা আজও চেষ্টা করছে আমার স্বাধীনতাকে নসাৎ করার জন্য। মনে রাখবেন ষড়যন্ত্র বন্ধ হয় নাই। আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। দল মত নির্বিশেষে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-একাত্ববোধ হয়ে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হন। আমার দেশের মানুষ দুখী, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আপনাদের সরকারের এমন কিছু নাই মানুষকে পেটভরে ভাত দেবার পারে। আপনারা গ্রামে গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে এগিয়ে যান এবং দেশের মানুষকে সুখী করেন। সেদিন এই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাবে। সুখে-শান্তিতে বাস করবে। বেকার সমস্যা দূর হবে। ছাত্ররা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। সেজন্য বলছি আমি, শহীদ স্মৃতি অমর হউক। জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ৬ মার্চ রাশিয়া থেকে সফর শেষে ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
বাংলাদেশের ভাই ও বোনেরা, ৫ দিনের সফর শেষে রাশিয়া থেকে আমি আমার মরুভূমিতে ফিরে এসেছি। যে ভালবাসা রাশিয়ার সরকার এবং জন সাধারণের কাছ থেকে আমি এবং আমার সহকর্মীরা পেয়েছি, সে ভালবাসা শুধু আমাকে দেখানো হয় নাই, সাড়ে সাত কোটি বাংলার জন সাধারণকে দেখানো হয়েছে। আমার এ সফর অত্যন্ত সাফল্যমন্ডিত হয়েছে এবং দুই দেশের মঙ্গলের জন্য নয় বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মঙ্গলের জন্য আমাদের বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষয় হয়ে থাকবে। সোভিয়েতের জনসাধানণ, তার সরকার যে কয়দিন ছিলাম লেলিন সাহেব, তাসখান মস্কোতে যে আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং তারা আমাদের যে দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম করেছে, যে রক্ত দিয়েছে, যে ত্যাগ স্বীকার করেছে সে খবর তারা জানে এবং প্রত্যেক রাশিয়ার জনগণ তা জানে। রাশিয়ার জনসাধরণ আমার বাংলার জনসাধারণকে সে জন্য শ্রদ্ধা করে। এজন্য শ্রদ্ধা করে যে রাশিয়াও রক্তের মাধ্যমে সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লবের মাধ্যমে তার দেশকে মুক্ত করেছে। সেজন্য তাদের সঙ্গে সাতকোটি বাংলার মানুষও রক্ত দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে, স্বসস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তার সাতে সাত কোটি মানুষকে মুক্ত করেছে। সেজন্য তাদের সঙ্গে আমাদের অনেকটা নীতির মিল রয়েছে। আপনারা আমাদের এই বন্ধুত্ব সোভিয়েত রাশিয়া অত্যন্ত, আমার এই ভ্রমনটা এবং আমি সেখানে গিয়েছিলাম সেটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে এবং আমাদের এইভাবে আলোচনা আরো ভবিষ্যতে চলতে থাকবে এবং দুনিয়ার শান্তি রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সোভিয়েত রাশিয়া পাশাপাশি কাজ করবে, এতে কোন সন্দেহ নাই।
আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের পক্ষ থেকে সোভিয়েতের সরকার বিশেষ করে তাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের প্রেসিডেন্ট এবং তাদের কমিউনিষ্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল কার্ণেভ বেজনাবকে এবং তাদের জনসাধারণকে সাড়ে সাতকোটি মানুষের পক্ষ থেকে, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তারাও আমাদের এই দুখী মানুষের পাশে দাড়াবেন বলে যে কথা তারা দিয়েছেন, সেজন্য তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আমি এও তাদের জানিয়েছি, যেদিন এই সংগ্রাম শুরু হয়, রাষ্ট্রদ্রোহী সংগ্রাম শুরু হয় সেদিন পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী আমাদের দেশেরর জনসাধারণের উপর অত্যাচার শুরু করে। আমার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জনসাধারণকে নির্যাতন করে। যেদিন এক কোটি লোক বাংলা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল সেইদিন ভারতের জনসাধারণ মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এবং তিনি নিজে আমার এক কোটি লোককে স্থান দিয়েছিলেন, এজন্য আমরা সোভিয়েত রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারের নিকট চিরকৃতজ্ঞ এবং আমাদের এই বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষুন্ন থাকবে এবং বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ফিরে এসেছি, আমি আপনাদের পক্ষ থেকে তাদের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ করেছি, এদেশে আসার জন্য। প্রাইম মিনিষ্টার কেসিগানকে এবং কমিউনিষ্ট পার্টির সেক্রেটারি বেজনভকে এবং তাদের সভাপতি মডারিকে এবং তাদের বৈদেশিক মন্ত্রী-ফরেন মিনিষ্টার, বিশেষ করে আমার সোনার বাংলাকে সাহায্য করেছিল মিঃ গোমিকোকে ও দাওয়াত করেছি সরকার ও জনসাধারণের পক্ষ থেকে। তারা সুযোগ পেলেই বাংলাতে আসবে বলে ওয়াদা করেছেন। আমরা সেই প্রতিক্ষায় রইলাম। আসলে তাদের আমরা সাদর সম্বর্ধনা জানাব-জয় বাংলা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ সম্পর্ক অটুট হউক। জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন মারফত জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দান করেন, তার পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হল ঃ
আমার প্রাণপ্রিয় বীর বাঙ্গালী ভাই বোনেরা, আমরা আজ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূতি উৎস পালন করছি। এই মহান দিনে স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে লক্ষ লক্ষ বীর শহীদ হয়েছেন তাঁদের জন্য গভীর বেদনাপ্লুত মন নিয়ে আমার শোকাতুর দেশবাসীর সাথে পরম করুণাময় আল্লাহ-তায়ালার দরবারে মাগফেরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে গৌরবোজ্জ্বল ও অন্যান্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি মুক্তিবাহিনীর সকল অঙ্গ দল তথা বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বেঙ্গল, রেজিমেন্ট, বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যবৃন্দ, নির্ভীক যুবক, ছাত্র, কৃষক, মজুর, বুদ্ধিজীবি আর আমার সংগ্রামী জনসাধারণকে অভিনন্দন জানাই। তাঁদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও একনিষ্ঠ আত্মদান অনাগত কালের, ভাবী বাঙ্গালীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা ও সম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তি পাগল জনতার চেতনাকে উদ্ভাসিত করবে।
আমার প্রিয় দেশবাসী, বিগত পঁচিশ বছর ধরে আপনারা ক্ষুধা, বঞ্চনা, অশিক্ষা এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সম্রাজ্যবাদী শোষকেরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটা নিকৃষ্টতম উপনিবেশে পরিণত করেছিল। দুঃসহ ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। পিষ্ট হচ্ছিলাম শোষণের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে। দারিদ্র্যের ও অনাহারের বিষপাণে যখন আমরা আকুণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের কষ্টার্জিত তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়ে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে মত্ত ছিল। ন্যায় বিচার দাবী করায় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ আমাদের উপর নেমে এসেছিল। সমসাময়িককালে নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, আর তিন কোটি মানুষ সর্বস্বান্ত। এসব কিছুই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধূসর পান্ডুর, জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্থ পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি এদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এসব মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা। আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে, আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যতে বংশধরদের সুখী ও উন্নতর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
পর্বততুল্য সমস্যাঃ
আজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য সমস্যা উপস্থিত। মহাসংকটের ক্রান্তিলগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিদেশ ফেরত এক কোটি উদ্বাস্তু, স্বদেশের বুকে দু’কোটি গৃহহারা মানুষ, বিধ্বস্ত কর্মহীন চালনা-চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়, নিশ্চল কারখানা, নির্বাপিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, অসংখ্য বেকার, অপরিমিত অরাজকতা, বিশৃংখলা বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থা, ভাঙ্গা সড়ক, সেতু ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, খাদ্র্যভাব, দ্রব্যমূল্যেও ঊর্ধ্বগতি এবং অকর্ষিত ভূমি এ সবকিছুই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। জনগণের গভীর ভালবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস ও অতুলনীয় ঐক্য এগুলোকে সম্বল করেই আমার সরকার এই মহা সংকট কাটিয়ে উঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।
আমি আশা করব, অতীতে আপনারা যেভাবে দূর্জয় সাহসে বুক বেঁধে ইয়াহিয়ার সামরিক যন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন, গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের জীর্ণ ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে নতুন সমাজ গড়ে তুলবো।
প্রশাসন কাঠামোঃ
ভাই ও বোনেরা, আপনারা জানেন হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের বাংলাদেশ রাইফেলস্ ও পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে হত্যা করেছে। আইনের শাসন কায়েম ও শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনের অভাব বিপ্লব বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
নতুন নিযুক্তির মাধ্যমে আমরা পুলিশ বিভাগেকে সংগঠিত করছি এবং ইতিমধ্যে যে সব সমাজ বিরোধী দুস্কৃতিকারী স্বাধীনতা উত্তর সুযোগ সুবিধাদির অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের দমন করে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তা বোধ ফিরাইয়া আনার কাজে হাত দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পর্ণ অনুপযোগী একটি প্রাদেশিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা ঔপনবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তারা এখনও বনেদী আমলাতান্ত্রিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। আমরা তাদেরকে স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি, তাদের পশ্চাদমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। আমার সরকার নব রাষ্ট্র এবং নতুন সমাজের উপযোগী করে সময় প্রশাসনযন্ত্রকে পুর্নঃগঠিত করবে। প্রস্তাবিত প্রশাসনিক কাঠামোতে জনগণ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের সমগ্র মহকুমাগুলোকে জেলা পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা তৈরি করছি।
শাসনতন্ত্রঃ
বিশেষজ্ঞরা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং খসড়া শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৪ টি বন্ধু রাষ্ট্র এ পর্যন্ত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক বন্ধু রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতিদান রাষ্ট্রপুঞ্জের নতুন সদস্যকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে।
উদার সাহায্য কামনাঃ
উদ্বাস্তুদের পুনঃর্বাসন ও অর্থনীতিতে পুনঃর্গঠনের জন্য আমরা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে উদার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে ভারত আমাদের সুদিন ও দূর্দিনের প্রতিবেশী। সম্প্রতি মহান ভারতের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এই শুভেচ্ছা সফরের প্রাক্কালে আমরা শান্তি, বন্ধুর ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এই চুক্তি দুই দেশের মেহনতী মানুষের শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং সংহতির বন্ধনকে মজবুত করবে। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দূর্বোদ্ধময় মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি সোভিয়েত রাশিয়া সফল করে এসেছি। সেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথিয়েতা পুনঃর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহার্য্যরে আশ্বাস দিয়েছেন। এই বাংলাদেশের পুনঃর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহার্য্যরে আশ্বাস দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমি পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এবং অন্যান্য বন্ধ রাষ্ট্রসমূহ যাঁরা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি জোট বহিঃর্ভূত ও সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করবো। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিঙ্কন্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সম মর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করবেন না, এটাই আমাদের কামনা।
বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনতে হবেঃ
দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের শাসকরা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছেন না। তাঁরা পাঁচ নিরীহ বাঙ্গালীকে দূর্দশার মধ্যে আটকে রেখেছেন। আমি বিশ্বব্যাপী বিবেক সম্পন্ন মানুষ, বিশেষ করে মিঃ ভূট্টোর দৃষ্টি আকর্ষণ। করছি- তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হউক। এই ইস্যুকে কোনক্রমেই যুদ্ধ বন্দীদের সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যা, অপরাধে অপরাধী। তারা মানবিকতাকে লংঘন করেছে এবং আন্তজাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের বিচার হবে। পাকিস্তানের সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের কাছে আমার আবেদন- নুরেনবার্গ মামলার আসামীদের থেকেও নিকৃষ্ট ধরনের এই অপরাধীদেরকে তারা স্বজাতি বলে ডাকবেন না।
উদ্বাস্তু পুনঃর্বাসনঃ
যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছে। সাহায্য, পুনঃর্বাসনের জন্য আমরা কার্যকরী কর্মসূচী গ্রহণ করেছি। বিনামূল্যে ও ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্যে কিছুটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ছিন্নমূল মানুষের মাথা গুঁজবার ঠাঁই করে দেয়ার জন্য অস্থায়ী বাসগৃহ তৈরির কাজে হাত দেয়া হয়েছে। বিধবা, অনাথ ও নির্যাতিতা মহিলাদের পুনঃর্বাসন পরিকল্পনাকে সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে গেছে, তাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃরুদ্ধার করতে দশ বছর সময় দরকার। আমাদের বিপ্লবী সরকার আশা করছে ৩ বছর সময়ের মধ্যে কাজ সমাধা করবে।
মজুতদাররা হুঁশিয়ারঃ
বিপুল খাদ্য ঘাটতি আমাদের জন্য এক দুঃসহ অভিশাপ। কিন্তু আমি কাউকে না খেয়ে মরতে দিতে চাই না। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আশা করি ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনতে পারবো। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ১০ লক্ষ টন আমদানী করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সামনের কয়েক সপ্তাহ আমাদের জন্যে ঘোর দূর্দিন। আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী আপনারা ধৈর্যধারণ করুন, উচ্চতম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাদ্য ঘাটতি পুরণের চেষ্টা করা হবে। এ প্রসঙ্গে আমি মজুতদার, চোরা কারবারী ও গুজব বিলাসীদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি তারা যেন মানুষের মুখের রুটি নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
জাতীয়করণঃ
আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্তি নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলয়ে সম্পদের সামাজিকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লেখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।
১। ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে)
২। সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ, (বিদেশী বীমা কোম্পানির শাখাসমূহ বাদে)
৩। সকল পাটকল।
৪। সকল বস্ত্র ও সুতাকল।
৫। সকল চিনিকল।
৬। আভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বহুদাংশ।
৭। ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তদূর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ষ ও অনুপস্থিত মালিকানাভূক্ত সম্পত্তি।
৮। বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।
৯। সমগ্র বহিঃবাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহিঃবাণিজ্যের বৃহদাংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে বাঙ্গালী প্রতিভাবান ব্যক্তিদের আমি দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সরকারী সেক্টরে কাজ করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। শীগগিরই সেক্টরে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। শীগগিরই যে শিল্পনীতি ঘোষণা করা হচ্ছে, তাতে এসব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হবে। যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে বাঙ্গালীদের মালিকানার স্বার্থ সরাসরি জড়িত সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাবেক মালিক অথবা প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নেন, আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, সেগুলো সবদিক থেকে বিপ্লবাত্মক এবং জনসাধারণকে অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারী ক্ষেত্রে মাঝারি ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের নীতির সুনিদিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সরকারি নীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ ন্যায্যভাবে চালানোর জন্যে উৎসাহ দেয়া হবে।
আর শ্রমিক মালিক বিরোধ নয়ঃ
আমি এমন এক নীতি নির্ধারণ করতে চাই, যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবেন। এই বলিষ্ঠ শ্রেণীর কর্তব্যবোধের উপর আমরা অনেকখানি নির্ভর করছি। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমানকাল ধরে যে পরপর বিরোধিতা রয়েছে, তা আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ থেকে অনেকখানি বিলুপ্ত হবে। শ্রমিক কর্মচারীকে আর সর্বদা মালিকের সাথে বিরোধে লিপ্ত থাকতে হবে না। কেননা, বর্তমানে তাদের মালিক হলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যারা মালিক ও ম্যানেজারদের হাতে বিশ্বাস করে নিজেদের সম্পত্তি জমা রেখেছে।
আমি খুব শিগগিরই শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা করছি। সেই সভায় শ্রমিক সংক্রান্ত সরকারি নীতি এবং আমাদের বিপ্লবী নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করতে তাদের যে পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছানোর পরে আমি আশা করবো যে, শ্রমিক নেতারা আমার সরকার ও আমার সাথে একযোগে কাজ করবেন এবং এই বিপ্লবী নীতি সমূহ সরাসরি শিল্প এলাকার কার্যকরী করবেন। তদুপুরি শ্রমিকদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষা কমিশনঃ
আমার ছাত্র ভায়েরা যারা মুক্তি সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা যেন আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাদের কাজ করে যেতে থাকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব সাধনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ সহ আমি একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করতে চলেছি।
কৃষি ব্যবস্থাঃ
আমাদের সমাজে চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে। সম্পদের স্থূলতা থাকা সত্ত্বেও আমরা চাষীদের সবল্প মেয়াদী সাহায্য দানের জন্যে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ২৫ বিঘার কম জমি যাদের আছে তাদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে সমস্ত বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়েছে। তাবি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হচ্ছে এবং ১৬ কোটি টাকা টেস্ট রিলিফ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। লবণের উপর থেকে কর তুলে দেয়া হয়েছে।
সারা বছর ধরে সেচের কাজ চালানো উন্নতমানের বীজ বপণ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং প্রতিটি চাষীকে পর্যাপ্ত ঋণ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভূ-মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চাত্যের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মালিকানার পরিধি কমিয়ে এনে পরিবার পিছু একশ বিঘার আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই উচ্চ সীমা আরও কমিয়ে আনা যায় কিনা সেটা বিবেচনা করে দেখা যাবে। ছোট ছোট চাষীদের অবশ্যই উৎপাদনক্ষম করে তুলতে হবে। একথা মনে রেখে আমরা পল্লী এলাকায় সমবায় ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। এর ফলে চাষীরা কেবলমাত্র আধুনিক ব্যবস্থার সুফলই পাবে না বরং সমবায়ের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও দ্রুত ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে। এই সাথে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন ও স্বল্প জমির অধিকারী চাষীদের জন্যে ব্যাপক পল্লী পুনঃর্গঠনের কর্মসূচী গ্রহণ করা। কাজ করলে খাদ্য এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ১ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া টেষ্ট রিলিফের অধীনে পল্লীর কর্মসংস্থানের জন্য নগদ ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়ে গেছে।
কুটির শিল্পঃ
আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে বেকার সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। জনসাধারণের নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনের চাহিদার সাথে সমন্বয় রেখে এটা গড়ে তোলা হবে। আমাদের কৃষি ও শিল্পান্নয়নের এটা হবে সহায়ক। এই সরকার নগর ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেই সব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যাঁরা পাট চাষীদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন তাঁদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫শ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বন্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভাগে, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে। আমার প্রিয় দেশবাসী, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের লাল আন্তরণে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমি জীবনেও কোন দিন কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেই নাই। শত্রুরা বাংলাদেশের সব কিছু ধ্বংস করে গেছে। কিছুই রেখে যায় নি। কি করে যে এ দেশ চলবে, সত্যিই চিন্তা করলে আমি শিহরীয়া উঠি।
সোনার বাংলা গড়তে হবেঃ
শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেত-খামার, কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন, সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রীয়া সংস্থার সদস্যাবৃন্দ আমার বোনেরা, ভাইদের কথা নাই বা বললাম, আমার ছোট ছোট মেয়েরা। ভাইদের কথা বললাম না এইজন্য, তারা সব সময় আমাকে চারদিকে ঘিরে রাখে, মুখে মুখে বলে সবাইর সমান অধিকার, কিন্তু ছাড়তে চায়না অধিকার কাউরে। আমি আপনাদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ পেয়ে এবং আপনাদের কাছে আসতে পেরে সত্যিই খুব আনন্দিত। আর আপনারা যে আমাকে সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য আপনাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা যে সংগঠন করেছেন, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের দেশে এ রকম সংগঠনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে এবং আপনারা একে ভালো করে প্রতিষ্ঠিত করুণ। সমস্ত বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মহকুমা, জেলায় এ সংগঠন গড়ে তুলুন। আমি আপনাদের শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি কাউকে কোন ওয়াদা করি না, কারণ ওয়াদা করার মতো শক্তি আমার নাই। শুধু এটুকু বলতে পারি আমার দিক দিয়ে যত রকম সাহায্য এবং সহযোগিতা আপনারা পাবেন। আমি ছোট বোনদের, আমি আমার ছোট বোনদের প্যারেড দেখে সত্যিই খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আমি আশা করি ভবিষ্যৎ বংশধর, স্বাধীন বাংলাদেশের বংশধর ছেলে এবং মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলবে। যাতে দুনিয়ার সভ্যরা, যেন বাঙ্গালীরা দেখতে পারে। অন্ধ সংস্কারের আমাদের জাতীয় একটা অর্ধেক অংশকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলাম। আমরা ধর্মের নামে মিথ্যা কথা বলে আমার মা-বোনদের আমরা দাসি করে রেখেছিলাম। আপনারা নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারেন এই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাই-বোন সমান পরিচয়ে পরিচিত হবে এবং হচ্ছে। আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। ছোটবোনেরা লেখাপড়া শিখ। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ প্রথম স্বাধীনতা দিবস।
সত্য কথা বলতে পারি নাই। আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি নাই। কি করে হাসব বুলন? স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দরকার। বাংলার মানুষ আজ দুঃখী। লক্ষ লক্ষ মা-বোন আজ অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। পাকিস্তানের দস্যু বাহিনীরা ইসলামের নামে যে প্রচন্ডতম অত্যাচার আমার বাংলার বুকে করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে তার তুলনা নাই। আজ আমার দুই লক্ষ বোন নির্যাতিত, আজ আমার ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। আজ আমার তিন কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার গুদামে চাল ছিলনা। আমার ব্যাংকে টাকা ছিলনা। আমার বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। যাবার সময় সর্বস্ব ধ্বংস করে চলে গেছে। ধ্বংস স্তুপের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। আমি আমার বাংলার মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। জনসাধারণ আজ কষ্ট পাচ্ছে। তারাও বুঝে যে এই সরকারের হাতে কিছু নাই। ভীক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে আজ ঘুরতে হচ্ছে। আপনারা জানেন স্বাধীনতা আমার বৃথা হয়ে যাবে, ত্যাগ আমাদের বৃথা হয়ে যাবে, শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে যদি সাতকোটি লোক প্রাণভরে না হাসে, আর সাতকোটি মানুষ যদি পেট ভরে ভাত না খায়। এই বাংলাদেশ শোষণহীন সমাজ হিসেবে গড়তে হবে। ভাইদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গড়তে হবে। ভাইদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোনদের এগিয়ে আসতে হবে সেই সংগ্রাম, জাতি গঠনের জন্য।
বিশ্বাস করেন, আপনাদের কাছে কি বলব আমি। আজ বোধহয় আড়াই মাস হলো আমি জেল থেকে বেড়িয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। কি এসে পেয়েছিলাম আমি আপনাদের কাজে কিছুই বলতে পারব না। কত কঙ্কাল, কত আর্তনাদ, কত হাহাকার। করে যে ওদের মুখে হাসি ফুটাতে পারব জানি না। শুধু এতটুকু জানি, বাংলার মানুষের ভালবাসা যেন আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। সেই আশীর্বাদ আপনারা করেন। আমি যদি বুঝতে পারি যে বাংলার মানুষ যে ভালবাসা আমাকে দিয়েছে, সে ভালবাসা থেকে যদি এতটুকু দূরে সরে যাই, আপনারা বিশ্বাস রাখতে পারেন, সেদিন আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আমি থাকব না। প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য আমি এই স্বাধীনতার সংগ্রাম করি নাই। আপনারা অনেকেই জানেন প্রধানমন্ত্রী আমি হতে পারতাম অনেকবার। আমি চেয়েছিলাম সুখী সমৃদ্ধশালী শোষণহীন বাংলাদেশ। আপনারা আমার দেশের ভাইয়েরা যারা মৃত্যুবরণ করেছে, শহীদ হয়েছে তাদের রক্তের কথা মনে করে, দুঃখী মানুষের কথা মনে করে আমার বোনেরা আপনারা এগিয়ে চলেন। দেশকে নতুন করে গড়ে তুলি। দেশের মানুষ আবার হাসুক, দেশের মানুষ আবার শান্তি পাক, দেশের মানুষ আবার পেটভরে ভাত খাক, দেশের মানুস আবার সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করুক।
এখনো দুস্কৃতিকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার পুলিশের শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ রাইফেলসের শতকরা ৫৬ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার কৃষকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছোট ছোট বোনদের, দুধের বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করেছে। এত বড় পশু দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় নাই। যে কাজ করে গেছে, এরমধ্যে পেপারে দেখলাম টিক্কা খান বলেন যে-মাত্র, আমি মাত্র ত্রিশ হাজার লোক মেরেছি। টিক্কা খান, আমি যদি তোমার দেশের ত্রিশ হাজার মা-বোনদের মারতাম। তোমার মনে কেমন লাগত। পশুত্বের একটা সীমা থাকা দরকার। এতে বড় বেহায়া মানুষ কি করে হয়, আমি জানিনা। বলে মাত্র ত্রিশ হাজার লোক মেরেছি। তুমি পশ্চিম পাকিস্তানে আছ বলে তুমি রক্ষা পেয়েছ। বাংলার বুকে থাকলে তুমি কোনভাবে রক্ষা পেতে না। যুদ্ধের সময় তোমার পশ্চিম পাকিস্তানের নামধারী সৈনিকরা আমার বোনদের ধরে নিয়ে ব্যাঙ্কারে রেখেছে। হাজার হাজার মহিলাকে আমরা উদ্ধার করেছি। কত বড় পশু তোমার লোক। না মানুষ না মানুষের বাইরে। তোমরা অসভ্য। তোমাদের গালি দেবার ভাষা বাংলা ভাষায় নাই। উর্দূ ভাষায় থাকতে পারে। তাই আমার ছোট বোনেরা, আমার মেয়েরা, আমি বিশ্বাস করি কাজ করে যাবেন। ঘরের একটা আলোর অংশ নারী। আমি দেখেছি আমার জীবনে, যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই। আপনারা এমনভাবে গড়ে উঠুন যে, আপনারা এমন মা হবেন, এমন বোন হবেন যা আপনাদের আদর, আপনাদের ভালবাসা, আপনাদের মনের যে স্বতস্ফুর্ততা তা দিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের গড়ে তুলবেন। আমি জীবনে অনেক দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনদিন আমার স্ত্রী আমাকে বাঁধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনে দশ এগার বছর আমি জেল খেটেছি, জীবনে কোনদিন মুখ কালা করে প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে আমার জীবনে অনেক বাধা আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গিয়েছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলে মেয়ের কাছে। আমার জীবনে তার অবদান অনেক রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে অনেক লেখা হয়, মহিলাদের নাম লেখা হয় না। সেজন্য আইজকা আপনাদের কাছে একটু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা কোন রকমে সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন, তাদের মনে রাখা উচিৎ, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান দিতে হবে। এজন্যেই আজ আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা যে সুযোগ আমাকে দিয়েছেন এই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আপনাদের সকলকে আমি শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নেবার আগে বলে যাই যে, আপনারা জানেন স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনী কষ্টকর। অনেক শত্রুরা খেলছে কিন্তু আমি বাংলার মানুষকে জানি আর বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি, বাংলার মানুষও আমাকে ভালবাসে। ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, বাংরার স্বাধীনতা হরণ করার শক্তি তাদের নাই। ইন্শাল্লাহ আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। যে মন প্রাণ দিয়ে আপনারা স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মন-প্রাণ দিয়ে এই বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী এবং শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্য আপনারা এগিয়ে যান-এই কথা বলেই আমি বিদায় নিচ্ছি।
আপনাদের সংস্থাকে আমার বক্তগত পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি, যতটুকু প্রয়োজন সাহায্য করতে আমি চেষ্টা করব। কিন্তু আপনারা মনে রাখবেন বাক্স কিন্তু আমার খালি। তার মধ্য থেকে যা পারা যায়-তাই করা হবে। আবার ধন্যবাদ। জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল ঠাঁকুরগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
মাননীয় সভাপতি সাহেব,
আমার ঠাঁকুরগাঁওয়ের ভাইয়েরা ও বোনেরা, আমার মনে পড়ে গণ আন্দোলনের পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম। কসাগাওয়া থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত অনেক সভায় আমি বক্তৃতা করেছিলাম। আমাকে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের জালেমরা ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে নিয়ে যায়। আমি তখন জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না আমার সোনার বাংলাকে আবার আমি দেখব। আমি জানতাম না আমার বাংলাদেশের সোনার মানুষের মুখ আমি দেখব। যে বাংরার মাটিকে আমি ভালবাসি, আর যে বাংলা মাটি আমাকে ভালবাসে, যে বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি, যে বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, আমি জানতাম, আমার আত্মবিশ্বাস ছিল ফাঁসি কাষ্টের আসামী হিসেবেও জেলের মধ্যে কবর খোড়া সত্ত্বেও আমি জানতাম যে আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে এবং দুশমনের হাত থেকে আমার বাংলাকে রক্ষা করবে।। আমি আমার সাত কোটি লোককে যাবার বেলায় কিছুই দিয়ে যাবার পারি নাই। তাদের হাতে আমি অস্ত্র দিয়ে যাবার পারি নাই। তাদের দিয়েছিলাম নীতি, তাদের দিয়েছিলাম আদর্শ, তাদের দিয়েছিলাম নির্দেশ। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, দল মত নির্বিশেষে আমার পুলিশ বাহিনী, আমার পুরানো ইপিআর, আমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা, আমার বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক-কৃষকরা বিনা অস্ত্রে সেই পাঠানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু বড় রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা পাওয়া গেছে। এত রক্ত দুনিয়ায় কোন দেশে কোন জাত স্বাধীনতার জন্য দেয় নাই, যা আমার বাংলার মানুষ দিয়েছে। মানুষ যে এতো পশু হতে পারে, মানুষ যে এতো অসভ্য হতে পারে, মানুষ যে এতো অমানুষ হতে পারে যা পশ্চিমা খান সেনাদের মতো দুনিয়ার কোথাও এ রকম পয়দা হয় নাই। আমার লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে, আমার লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়িকে জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার দুধের বাচ্চাকে হত্যা করেছে, আমার ধানের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার পোর্ট গাড়ির রাইন ভেঙ্গে দিয়েছে, আমার টাকা আত্মসাৎ করেছে, আমার বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। আমার মানুষকে ধরে ধরে নির্দয়ের মতো অত্যাচার করে হত্যা করেছে। দুনিয়ার মানুষ দেখে নাই যে কি অত্যাচার আমার দেশের উপর করেছে। কিন্তু টিকতে পারে নাই খান সেনারা, টিকতে পারে নাই পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠি, তেইশ বছর, চল্লিশ বছর পর্যন্ত আমার বাংলার পাটের টাকা, আমার বাংলার কৃষির টাকা, আমার বাংলাদেশের মানুষের খাজনার টাকা-আমার বাংলাদেশের মানুষের যা কিছু ছিল সব লুটপাট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলেছে। এর বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বারবার। এর বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়িয়েছি। বাংলার মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে। বেঈমানদের কাছে তবু মাথা নত করি নাই। যাতে আমার বাংলার মানুষ দেখে তাদের নেতা মরতে পারে। সে মরলে সরাসরি মরবে, মাথা নত করে মরবে না। আমি যদি স্বাধীনতা না দেখে যাই, তারা আমার যে ত্রিশ লক্ষ ভাই বোনকে হত্যা করেছে, তারা এই স্বাধীনতা দেখে নাই। তারা জীবনে আর মায়ের কোলে ফিরে আসবে না। আপনারা জানেন আমার মনের অবস্থা কি? আমি যখন সকাল বেলা বের হই তখন আমার ছেলেহারা মা, পুত্রহারা বাপ, স্বামীহারা মহিলারা আমার কাছে এসে বলে- ‘বাবা আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে, বাবা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। বাবা আমি বিধবা বিপর্যস্ত।
ত্রিশ লক্ষ লোক! একজন দুইজন নয়। এক পয়সার একবেলা খোরাকি পর্যন্ত তারা বাংলার মাটিতে রেখে যায় নাই। বৈদেশিক মুদ্রা না হলে দুনিয়ার কোথা থেকেও কোন জিনিস কেনা যায় না। বিশ্বাস করেন যেদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরা আইস্যা আমার ইচ্ছা ছিলনা যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি হবে আমার? যে দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ জান দিয়া ভালবাসে একটি লোককে। তারচেয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব কি বড় হতে পারে?
আমি দেখলাম যে এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রা নাই, কোথা থেকে আমি খাবার আনব? কি করে আমার মানুষের মুখে খাবার দিব? কোথা থেকে আমি জিনিস পত্র কিনে আনব? কি দিয়ে আমি ঠাই দেব? কোথা থেকে আমি অর্থ পাব? যা দিয়ে আমি আমার মানুষকে সাহায্য করব, আমার কাছেতো এমন কিছু নাই। আমার কাছেতো আলাদিনের চেরাগ নাই। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সব নিয়ে গেছে। আমি বললাম আমার কাপুরুষ হলে চলবে না। আমাকে এদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদের যদি মৃত্যু হয়,তবে আমারও মৃত্যু হওয়া প্রয়োজন। ওদের দুখে আমি দুখী, ওদের সুখে আমি সুখী। ওরা আমার ভাই, আমি ওদের ভাই। দেখি কি করা যায়? চল দু’হাত তুলে চেষ্টা করে দেখি। আমার চিন্তা হয় বাংলার মানুষ সেদিন এককোটি লোক এই বাংলাদেশ ছেড়ে, ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। একজন দুইজন নয়, এক হাজার দুই হাজার নয়, এক লক্ষ দুই লক্ষ নয় এক কোটি লোক বাংলা ছেড়ে, মাতৃভূমি ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। ভারতের জনসাধারণ তাদের সাহায্য করেছিলেন, তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের খাবার দিয়েছিলেন, তাদের স্থান দিয়েছিলেন। আমরা বাঙ্গালীরা অকৃতজ্ঞ নই, নিশ্চই তাদের আমরা সাধুবাদ জানাব।
স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৫ লক্ষ টন খাবার দিলেন-তিনি কিছু টাকা দিলেন যা দিয়ে সরকার চালানো শুরু করা হলো। তিনি কিছু মালপত্র দিলেন, যা দিয়ে কারখানা চালানো আরম্ভ করা হলো। তিনি কিছু লোক দিলেন যা দিয়ে রেল লাইনগুলো চালু করা হলো। বলেনতো তার কাছে অকৃজ্ঞ কেমনে হই। আমি মানুষ। বাঙ্গালী নেমক হারাম নয়। যখনি এবার আসলেন ঢাকায়। আমি তখনই তাকে বললাম-শ্রীমতি গান্ধি, তুমিতো আমাকে পাঁচ লক্ষ টন খাবার আমাকে দিচ্ছ, কিন্তু আমার যে আরো খাবার দরকার, আমি কোথা থেকে আনব? তুমি কি আমাকে আরো খাবার দিতে পার না? কাইল যখন আমি খুলনা থেকে ফিরে আসলাম, আমি তার কাছ থেকে চিঠি পেলাম যে, তোমাকে আমি আরো দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টন খাবার আমি দিব। আমি আপনাদের পক্ষ থেকে ভারতের জনসাধারণকে এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে মোবারকবাদ জানাই। জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমি যখন দেখলাম এদেশে কিছু নাই, ওদের যদি খাজনা আদায় করতে যাই ওরাতো শেষ হয়ে যাবে। আমি বললাম যাও ওদের বকেয়া খাজনা সব মাফ করে দিলাম। মানুষ গরু ছাগল কিনতে পারে না। কোথায় পাবো? দাও দশ কোটি টাকা? যেখান থেকে পারি, আমি ভিক্ষা করে আনব। দিয়ে দাও, সবকিছু তছনছ করে নিয়ে গেছে। খাজনা না দিলে সরকার কি দিয়ে সরকার চালাবে? কে দেবে? কোত্থেকে দেবে? সব মাফ করে দিয়েছি। পয়সা কোত্থেকে আনবে? পার্ট চালান দিব। আমার যেগুলো পোর্ট আছে চট্টগ্রাম চালনা পোর্ট। জাহাজ আসতে পারে না ভালোভাবে। জাহাজগুলো ডুবাইয়া দিয়ে গেছে নদীর মুখে, যাতে জাহাজ না আসতে পারে?
না খেয়ে মরে যাবো তবু গোলামের গোলামী করব না। ভূলে যান! তোমরা পারলে প্রায়চিত্ত্ব করো। জীবনভর প্রায়শ্চিত্ত্ব করো। কিন্তু মনে রেখো যারা আমার বাংলাকে, যারা আমার মা-বোন হত্যা করেছে। যারা আমার মা-বোনকে পাশবিক অত্যাচার করেছে। তাদের বিচার হবে বাংলার বুকে।
আমি যাবো রাশিয়া। ভিক্ষা দাও। আমি যাবো ভারতে, ভিক্ষা দাও। আর চোরের দল এদেশ থেকে বর্ডার পার করে দেয়। আপনারা আমার জন্য খুন হয়েছেন। আমার জন্য ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন। আমার কাছে ওয়াদা করেন যে, চোরের গোষ্ঠি নিপাত করে দিতে হবে। রাজী আছেন কিনা? আর জিনিসের দাম বাড়াবা না, তোমাদের বলে দিচ্ছি আমি, মুজিবর রহমান। ভালো মানুষ-সত্যি কথা, নরম দেল সত্যি কথা। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেললে মেশিনগান চালাইয়া দেবার হুকুম দেবার জন্য এক মুহুর্তে দেরী করিবো না। আপনারা মেহেরবাণী করিয়া জিনিসের দাম কমান। জিনিস যদি পাওয়া যায়, তবে দাম বাড়বে কেন? আমি তাতো বুঝিনা। আপনারা দেখছেন যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনেছি। ৩০ লক্ষ লোকের রক্ত কিনতে কত টাকা লাগে! তাই বাবু কইয়া দেরে কার কাছে যাবো। আজ আড়াই মাস হলো। আড়াই মাস। আমি একটা দিন বিশ্রাম নিতে পারি নাই। বিশ্রাম কারে কয় আমি জানি না। আমি চিন্তা করছি, চিন্তা করলে আমি শিহরিয়া উঠি। কি করে আমার দুঃখী মানুষের, মা বোনের মুখে হাসি ফুটাবো? আর চোরা কারবারী, বদমায়েশি, বাংলার বুকে বইসা বছর বছর দাম বাড়াইয়া দেয়।
আমার সংগ্রামী ভাইয়েরা, আমার বাংলার জনসাধারণ, আমার ঠাকুরগাঁয়ের জনসাধারণ তোমরা আমাকে ভালবাসো কিনা? যদি ভালোবাস তবে এই চোরাকারবারীদের শেষ করতে হবে। যেমনী আমার কথায় অস্ত্র ধরেছিলা, দরকার হলে তোমাদের আবার আমি লাঠি ধরতে বলব। চোরাকারবারীর গোষ্ঠি আমি বাংলা থেকে নিপাত করে দিব। ঠিক মনে ধরেছে, আপনারা সাহায্য না করলে পারব না। আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে মাইরা থুইয়ে গেছে। আমার শতকরা ৬০ জনের মতো, আমার বাংলাদেশ রাইফেলের জোয়ানদের মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। আমি মিলিটারি দিয়ে দেশ শাসন করতে চাইনা। আমি পুলিশ দিয়ে দেশ শাসন করতে চাইনা। আমি চাই বাংলার জনগণের সাহায্য নিয়ে দেশ শাসন করতে। ওরা থাকবে, ওরা বাংলার সন্তান। কিন্তু আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে আগে। আপনাদের কাজ করতে হবে। আরে, দুনিয়ায় আমি এমন এমন মানুষ দেখি নাই। আশ্চর্য হয়ে যাই! মানুষেরতো একটু বোঝা উচিৎ যে এত রক্তের পরে স্বাধীনতা এসেছে। আজ চোরাকারবারীরা, ঠাঁকুরগাঁয়ের ভাইয়েরা, আজ একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে। যারা অন্যায় করেছে নিশ্চই তাদের সাজা হওয়া উচিৎ। কিন্তু যারা নিরাপরাধ তারা যেন সাজা না পায়। আপনাদের ঠাকুরগাঁয়ে একটা প্রবলেম হয়ে গেছে, কিছু লোক এখানে এসে বাসিন্ধা হয়েছিল। আমি জানি কিছু খান সেনাদের সাথে মিশে আপনাদের অত্যাচার করেছে। তাদের বিচার করা হবে। তাদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু যারা নিরাপরাধ, ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে চলে গেছে, তাদের থাকতে দিতে হবে-রাজি? এভাবে না, হাত তুলে বলতে হবে। আমি কি করে তাদের খাওয়াব? যাইয়া হেহী চাপাই নবাবগঞ্জে ৫০ হাজার উদ্বাস্তু। একটা শহরে যদি ৫০ হাজার লোক আইসা বসে! সে দেশের লোক কি বাঁচবে? সেখানে ৫০ হাজার লোক চইলা গেছে। তারা আমার কাছে আইসা কান্দে-আমরা কি করে খাওয়াব? আমরাইতো না খেয়ে মরছি। তাদের থাকতে দিতে হবে। আর যারা বদমাশি করছে, তাদের আমি বলে দিচ্ছি-ঐ জেল পুড়লেও আমি তাদের আরেকটা জেল করে, তাদের ভরতে হবে। কোন চিন্তা করবেন না। যারা অন্যায় করছে, তাদের ফল ভোগ করতে হবে। আপনারা নিরাপরাধ ও নিরাশ্রয় যারা তাদের, তাদের আপনার ভাই মনে করে মার্জিতভাবে আশ্রয় দিবেন।
ভাইয়েরা বোনেরা, দেশ শুধু একজনের নয়। আপনাদের কৃষির উন্নতি করতে হবে। সাত কোটি লোক, দশ কোটি টাকার বেশী টাকা দিব। ওর মধ্যে কষ্ট টষ্ট করে চালাইতে হবে। দেবার পারব না। আপনারা মুজিবর রহমানকে চিনেন, মিথ্যা কথা দেয়না। মিথ্যা ফাদ আমি চাই না। আমি মিথ্যা কথা বলে মানুষকে ধোকা দিতে পারব না। যা অবস্থা খান সেনারা বাংলায় করে গেছে! সে জায়গা ফিরে আসতে আমার কমছে কম দশ বৎসর সময় লাগতো। কিন্তু আমি আশা করি তিন বছরে সে জায়গায় ফিরে আসতে পারব। এই তিন বৎসর আমি কাউরে কিছু দেবার পারব না। যদি পান, মনে করবেন, কিছুমতের জোড়ে পাইছেন। যদি বলেন দিতে হবে, আমি বলব আসসালামুয়ালাইকুম। আমি দেবার পারব না। আমি খাজনা মাপ কইরা দিচ্ছি। যা আমার হাতে আছে সেটা মাপ কিন্তু যা নাই দেবার পারব না। স্বাধীনতার অর্থ বিশৃংখলা নয়। যুবক ভাইরা শৃঙ্খায় থেকো। যুবক ভাইয়েরা গ্রামে গ্রামে যাও। লেখা-পড়া শিখ। তোমাদের ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ভবিষ্যতে তোমাদের বড় বড় চাকুরী করতে হবে। দেশ তোমার, তাকে গড়তে হবে। লেখাপড়ার দিকে একটু মনোযোগও দাও।
আপনারা জানেন যে এই যে বড় বড় ব্যাংক যা বাংলাদেশে ছিল-আজ তা বাংলার ছয় সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। এখন আর দু একজনের সম্পত্তি না। যাকে বলে ব্যাংক জাতীয়করণ। এখন এই ব্যাংকগুলো যার মধ্যে চাবি। যা নিয়ে ভুড়িওয়ালা আরো ভুড়ি পয়দা করে আর গরীব আরো গরীব হয়। এই জায়গায় আমি প্রথম আঘাত করেছি। তারা কিন্তু বসে থাকবে না। এটাকে বানচাল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করবে। আপনাদের হুশিয়ার হতে হবে। আমি আপনাদের সাথে, আপনারা আমার সাথে থাকবেন। যদি ভুড়িওয়ালারা রাত্রে, পয়সা দিয়ে অতি বিপ্লবী কথা কয়, তাদের কেমন করে দমন করতে হয়-তা বাংলার মানুষ জানে। জানেন না? একটু ভালো করে রেডি হয়ে থাইকেন। আমি হুকুম দিয়ে বসতেও পারি তা বলা যায় না। আমি লোকটা একটু সোজা মানুষ।
আমার বড় বড় কল-কারখানা। ব্যাক্তিগত সম্পত্তি যত ছিল, সেগুলোকে জাতীয়করণ করে সাতকোটি লোকের সম্পত্তি করেছিল। যতগুলো চটকল ছিল, সব এখন বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের সম্পত্তি। আমি জাতীয়করণ করে বাংলার মানুষকে দিয়েছি। ফসল উৎপাদন করেন, চেষ্টা করেন। আমাকে বলে যে পাম্প নাই। আমি বললাম যে পাম্প নাই সত্যি নাই। গর্ত করো। পানি উঠাও। কাজ করো-ফসল উৎপাদন করতে হবে। ভিক্ষুকের জাত হয়ে আমি বাঁচতে চাইনা। আমি মাথা নত করে আরো কাছে ভিক্ষা চাইনা। আমি চাই আমার মানুষ, ভবিষ্যৎ বংশধর সুখী হউক।
ভাইয়েরা আমার, আপনাদের ধন্যবাদ জানাই, অনেক রৌদ্রের মধ্যে কষ্ট করেছেন। আসুন আমার সঙ্গে হাত মিলান। একটা মোনাজাত করেন। যে সব ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করেন (বসেন আপনারা)
ভাইয়েরা আমার, অনেক রক্তের বিনীময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ওদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেটিই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। সেদিনের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম হবে দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাংলার মানুষ যদি পেটভরে ভাত খায়। বাংলার মানুষ যদি শান্তিতে বাস করে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি দূর্নীতিতে ভরে যায়। বাংলায় যদি শোষণহীন সমাজ গঠন না হয়। তাহলে আমি বিশ্বাস যারা শহীদ হয়ে মারা গেছে-ওদের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ যে, আপনারা সকলে কাজ করেন, দেশকে গড়ে তোলেন। আমি বলে দিচ্ছি পরিস্কার কথা-কিচ্ছু আপনারা আশা করবেন না যে তিন বৎসরের মধ্যে আমি দেব। আপনাদের নিজেদের কাজ করে খেতে হবে। আমি ভিক্ষা করে এনে যা পারি আপনাদের পৌঁছাবো। ডাকাতেরা যাতে না খেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আবার আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে ঠাকুরগাঁ ভাইদের ধন্যবাদ দিয়ে, জানি আমি ঠাকুরগাঁয় অপরাধ হয়ে গেছে। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। খোদা হাফেজ।
সংগ্রহ-সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার। আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন। আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ আজ সার্বভৌম স্বাধীন দেশ। কিন্তু দুনিয়ায় কোন দেশ, দুনিয়ার কোন জাতি এত রক্ত দেয় নাই, যা আমার বাঙ্গালীরা দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে এই বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য। এমন একটা অসভ্য দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানকে এখন পাকিস্তানবলা হয়। তাদের সামরিক বাহিনীর লোকেরা প্রচন্ড লুণ্ঠন, তারা আমার লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে। তারা আমার ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেছে। তারা আমার সামরিক বাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার রক্ষী বাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার ই.পি.আরকে হত্যা করেছে। তারা আমার কৃষকদের হত্যা করেছে। তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে। তারা আমার রাস্তাঘাট ধ্বংস করেছে। তারা আমার চাউলের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আমার সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তারা আমার পোর্ট বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তারা আমার রেল লাইনকে নষ্ট করেছে। তারা আমার পোষ্ট অফিসকে ধ্বংস করেছে। তারা আমার বৈদেশিক মুদ্রা চুরি করেছে। তারা আমার স্বর্ণ লুট করে নিয়ে গেছে। তারা আমার টাকার নোট জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এমন একটা দেশ, যে দেশ আমি পেলাম। আমি এসে দেখলাম, আমার উপর ক্ষমতা দিল। আমি দেখলাম, একটা ধ্বংসের স্তুপ। আমি জানি না এদের কি করে আমি বাঁচাব। আমি জানিনা এদের কি করে আমি ভাত দেব? আমি জানি না কি করে এদের আমি কাপড় দেব। আপনারা জানেন আপনাদের দেশের অবস্থায়। আপনারা জানেন কি সর্বনাশ হয়েছে এই বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য কিন্তু কিছুই পাই নাই, আমি চিন্তা করে কূল পাই নাই। কেমন করে আমি বাংলাদেশের লোককে বাঁচাব। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গেছে মায়ের কোল খালি হয়েছে। বোন বিধাব হয়েছে। সব সর্বশান্ত হয়েছে। আড়াই কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পশুর দল। মনে করেছে আর একদল বাঙ্গালী রাজাকার, আল বদর নামে পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগদান করে আমার বাংলার গরীব দুঃখীদের হত্যা করেছে। রাজাকাররা মনে করেছে যে তাদের ক্ষমা হবে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন রাজাকার, আলবদর, যারা খুন করেছে, তাদের ক্ষমা হবে না। তাদের বিচার হবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনারা। আপনারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন বিচার হবে না, বিচার হবে, ভাল করে বিচার হবে। যে সমস্ত বিগ্রেডিয়ার কর্ণেল আমার বাংলার মা-বোনকে হত্যা করেছে, তাদের এই বাংলায় বিচার হবে।...
আমি মিথ্যা ওয়াদা করতে পারি নাই। আমি মিথ্যা ওয়াদা জীবনে কোনদিন করি নাই। আমি আপনাদের ভোট নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ই মার্চ তারিখে-‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আপনারা...। ২৫শে মার্চ তারিখে আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আমি আপনাদের কাছে অস্ত্র দিবার পারি নাই। আমার যারা সিপাই ছিল তাদের কাছে থ্রি নট থ্রি গান ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আর যারা জনসাধারণ ছিল তাদের কাছে কিছুই ছিল না। থ্রি নট থ্রি দিয়ে এই সামগ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছে আমার ছেলেরা, আমার বোনেরা। ফায়ারগুলি আজ দেখেছে, বাঙ্গালিরা কাপুরুষ নয়, বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে পারে। বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে জানে। বাঙ্গালী মরতে জানে, বাঙ্গালী মারতেও জানে। আপনাদের কাছে আমি কি বলব, আমি আড়াই মাস হলো জেল থেকে এসেছি। আড়াই মাস। আমাকে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে হয়েছে। কারণ আমি যে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো স্বাধীনতাকে নসাৎ করার চেষ্টা করছে। ত্রিশ লক্ষ লোক যদি স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য জান দিয়ে থাকে। যদি কেউ বলে আপনাদের এই করব, ওই করব, এই করব। যা সর্বনাশ করেছে জানেন আপনারা চট্টগ্রাম। আল্লাহর মর্জি আমি গিয়েছিলাম, সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে মুখের মধ্যে, জাহাজ সহসা আসতে পারে না। একটা চ্যানেল আছে যা দিয়া জাহাজে আসে। জাহাজে যদি মাল পাঠাতে না পারি, আর মাল আনতে না পারি। আপনাদের কোত্থেকে আমি দেবো, আমি কিছুই তিন বছর আপনাদের দেবার পারব না, রাজি আছেন? ও হবে না, হাত তুলে দেখাতে হবে, রাজী আছে কিনা। হ্যাঁ দেয়া হবে। কোন মানুষ এদেশে আমার বাংলায় না খেয়ে থাকবেনা সে বন্দোবস্ত আমি করেছি। আমার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতরাষ্ট্র শ্রীমতি গান্ধী ৫ লক্ষ টন খাবার আগে দিবেন কয়ে গিয়েছিলেন, পরে আবার আমাকে খবর দিয়েছিলেন, আরো আড়াই লক্ষ টন খাবা দিবেন। আমি বার্মার থেকে চাল কিনেছি। রাশিয়া আমাকে খাবার দেয়ার জন্য বলেছেন। জাপান থেকে কেনার বন্দোবস্ত করতাছি। জাতিসংঘ আমাকে খাবার দিবে বলে ওয়াদা করেছেন। ইনসাল্লাহ্ যদি একবার আমার সমস্ত কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, খাবার অভাব হবে না। তবে চুরি করে যদি কেউ খায় তার নাড়ী কেটে ফেলে দিতে হবে।
একদল লোক জিনিসের দাম বাড়ায় দিয়েছে। তেলের দাম, কাপড়ের দাম, সাবান। আজকে আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমি আগে করি নাই। আমি আস্তে আস্তে চাবাই। এই বাংলাদেশে যত ডিষ্ট্রিবিউটর আছেন। যত হোল সেলার আছেন। যত এজেন্ট আছেন, তেলের, নুনের, সাবানের, কাপড়ের যা কিছু হউক, যদি সাত দিনের মধ্যে দাম না কমে, সমস্ত ডিলার আমি ক্যানসেল করে দেব। সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্টকে আমি ক্যানসেল করে দিব। প্রত্যেক ইউনিয়নে ইউনিয়নে একটা করে আমি প্রপার ডিলক্টের করব। তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম, কিন্তু বাংলার মানুষকে আমি লুট করতে দেই নাই। তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি যদি জিনিস পাওয়া যায় তবে কেন জিনিসের দাম বেশী হবে? ক্যানসেল হয়ে গেছে। কেরোসিন তেল আছে, অমনি বোতলে কমাইয়া দিয়া দাম বাড়াইয়া দেয়, এ এজেন্সি ক্যানসেল হয়ে যাবে। মুজিবর রহমান বলে দিচ্ছে, এ এজেন্সি ক্যান্সেল।
এই বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। বাংলার মানুষ জীবন বাজী রেখে আমাকে ফাঁসির কাষ্ট থেকে নিয়ে এসেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হই নাই প্রধানমন্ত্রীত্ব করার জন্য। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি এদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। ভূলে যান। আমি ভূড়িওয়ালাদের পেট কাইটা দিছি। ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানী, বড় বড় পাটের কল, সব পাটের কল, সব কাপড়ের কল, সব চিনি কল, আজ প্রায়......। যত বকেয়া খাজনা ছিল সুদসহ সব মাপ কইরা দেয়া হয়েছে। ২৫ বিঘা জমির মালিক আপনারা হবেন। ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাপ কইর দিয়াছি।
আমরা শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার শতকরা ৬০ জন যুবকের ছিল না রাইফেল। এদের ইষ্ট পাকিস্তানরাইফেল বলা হতো। আমরা বলি বাংলাদেশ বিডিআর,তাদের শতকরা ৬২ জন লোককে হত্যা করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেরা যারা বাংলাদেশে ছিল। তাদের শতকরা ৬৫ জনকে হত্যা করেছে। আইন-শৃংখলা, আমি বলেছি যে তোমরা আমার কাছে অস্ত্র জমা দাও। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক আমার কাছে অস্ত্র জমা দিয়েছে। চোর-ডাকাত-গুন্ডা কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছে সামান্য সামান্য, তাদের আমি বলেছি- সময় থাকতে ভদ্র মানুষের মতো, ভাল মানুষের মতো জমা দিয়ে দাও, না হলে উপায় থাকবে না। আর যদি গ্রামে গ্রামে চুরি ডাকাতি করে বন্দুক নিয়া। আমি তাদের বলে দিয়েছি, পুলিশকেও বলে দিয়েছি যারা বন্দুক নিয়ে গুলি চালাইয়া ডাকাতি করবার চেষ্টা করবে সোজা গুলি চালায়া দিয়া হত্যা করবে আমার আপত্তি নাই। ময়মনসিংহের ভাইয়েরা, পুলিশ দিয়া হবে না। বদর ফদর বাহিনী যা পাবে এদের ধইরা এরেস্ট করবা। ওদের আমি বিচার করব। তবে একটা কথা আছে, নিরাপরাধ মানুষ যেন নিজের সঙ্গে শত্রুতামি আছে বলে সাজা না পায়। আর যারা অন্যায় করেছে তাদের আপনাদের সাজা দিতে হবে। আমি নিরাপরাধ মানুষের সাথে তা করতে চাই না। আমি এখনও মাঝে মাঝে, আচ্ছা আপনারা কাসিম দেখছেন, কাসিম, কাসিমের মতো মাথা বার করে, ওরা আপদ বিপদ দেখলে পেটের মধ্যে মাথা নিয়ে যায়। আর যেই দেখে মানুষ নাই অমনি মাথা বাহির করে।
তাই আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি যে, আপনারা গ্রামে গ্রামে আমার ভাইয়েরা পুলিশের উপর নির্ভর করে আমি সমাজ রক্ষা করতে চাই না। আমি জনগণের সাহায্য চাই। জনগণকে নিয়েই আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। আজ জনগণকে নিয়েই আমি সংগ্রাম করতে চাই, দেশ গড়ার সংগ্রাম। এভাবে যেন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আপনারা রাজী আছেন কিনা? আপনারা রাজী আছেণ? গ্রামে গ্রামে চোর ডাকাত ধরবেন? আরেকটা কথা রয়ে গেল......।
আমি বলে দিয়েছি আপনারা বর্ডারে বর্ডারে আপনারা গণ কমিটি গঠন কুন। আওয়ামী এবং ভলান্টিয়ার বাহিনী থাকবে, আমি বাংলাদেশ রাইফেলের লোককে পাঠিয়ে দিয়েছি তাদের সাহায্য সহযোগিতা করবেন।
মনে রাখবেন, সেদিনের সিপাই নয়। এরাও এদেশের মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্য বন্ধুক না নিয়েও বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক ভাই আমার শহীদ হয়েছে। আমি তাদেরও বলব যে রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতা তোমরা রক্ষা কর, জনগণের সাথে তোমরা শরীক হয়ে যাও। তোমাদের কাছে এটাই আমার আবেদন ও আবদার।
ভাইয়েরা আমার, সরকারী কর্মচারী ভাইদের আমি বলব, পুরানো মদ পুরানো সঙ্গ ছেড়ে দেন। বিপ্লবের মাধ্যমে যেখানে দেশের স্বাধীনতা আসে। সেখানে অনেকে দেশে অনেকের চাকুরী করার সুযোগ থাকে না। আমি আপনাদের অনেকের চাকুরী এখানে রেখে দিয়েছি। আমি চাই, আপনারা এই মায়ের, বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে বাংলা মায়ের সেবা করে যান। আমরা বলব আপনারা শাসক নন। আমি আপনানের আবেদন করব। আমি আপনাদের রিকোয়েষ্ট করব, আমি আপনাদের অনুরোধ করব। এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভাই, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার বাবা, সরল জ্ঞানে তাদের সেবা করতে হবে।
সেবার মানসিকতা নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে। আমাকে আপনারা সোজা মনে করবেন না। আমি লোক অত সোজা মানুস নয়। রাগ আমার আছে, দরকার হলে আপনারা জানেন মেশিন গানের সামনে আমি প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এ আপনারা দেখেছেন এবং অনেকবার দেখেছেন, মৃত্যুভয় আমি করিনা, কিন্তু প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে ভালবাসা আমাকে দিয়েছে, যে ভালবাসা ওদের কাছ থেকে পেয়েছি। দুনিয়ার কোন কোন দেশে কোন নেতা তা পায় নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাইনা, আমি চাই ভালবাসা। তাই ভালবাসা নিয়ে আমি মরতে চাই, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ .....
...তারপর দেশকে আমাকে গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ করার টাইম নেই। ১০ টা পাঁচটা ভুলে যান। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করি। আমি আমার জীবনের যৌবন দিয়ে কাজ করছি। আমার ১৮ বৎসরে স্কুল ছেড়েছি। কিন্তু আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করছি। আমার সহকারীরাও করছে। আপনাদেরও কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করুণ। আপনাদের যে পয়সা/বেতন দেয়, এই জনগণে দেয়। আমি যদি খবর পাই, আইন আমার হাতে আছে, আমি আইন ব্যবহার করতে চাইনা। আমার লাগবে খালি একটা খরম....। আপনার চাকুরী আর দরকার নাই, বাড়ী যেতে হবে। মেহেরবানী করে আপনারা কাজ করেন। জনগণকে বলব আপনাদেরও সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত মিলিয়ে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি... টাকা দিয়েছি....। সোজাসুজি কথা, এই জনগণের জন্য তাই করা হবে। যদি কেহ এই টাকা আত্মসাত করার চেষ্টা করে, সে আমার দলের লোক হইক তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তা আপনাদের সামনে। আমি চাই না, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ করবেন, ঘুষ দূর্নীতি আল্লাহর ওয়াস্তে মাপ করেন আমারে। মেহেরবানী করে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেন। এই জমি পবিত্র জমি। এই জমির এমন কোন জায়গা নাই যেখানে আমার দেশের মা বোনের রক্ত নাই। এ জমির এমন কোন মহাকুমা নাই যেখানে আমার দেশের মা বোনের কবর নাই। এ জমির এমন কোন জমি নাই যেখানে আমার দেশের ছেলেদের আত্মা নাই।
তাদের কথা মনে করে, তাদের আত্মার কথা মনে করে। তাদের রক্তের কথা মনে করে আমি আমার জনগণকে, আমি সরকারী কর্মচারীকে, আমি ব্যবসায়ীকে, আমি শ্রমিককে, আমি কৃষকদের আবেদন জানাই-দেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করুন। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। দেশের মানুষ আজ দুঃখী, দেশের মানুষ আজ না খাওয়া। আজ দ্বারে দ্বারে ঘরে ঘরে গৃহহারা সর্বহারা আর্তনাদ। আজ গ্রামে গ্রামে দেখি মানুষের ঘরবাড়ি নাই। মা মা করে তারা কান্দে বাংলার মানুষ কোথায় থাকবে? এদের কথা চিন্তা করে আমি ঘুমাতে পারিনা। আমি আপনাদের কাছে চাই, যার ঘর আছে, তার পাশের বাড়িতে গৃহহারাদের ঘর বাড়ির ব্যবস্থা করবেন। যার খাবা আছে, তারা অন্যকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন-এটা হলো মনুষ্যত্ত্ব জাগরণের লক্ষণ, খামাকা জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে হবে না। বাংলার মানুস যাতে সব পায়, বাংলার মানুস যাতে সুখী হয়, বাংলার মানুষ যাতে শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা পায়।
সমাজতন্ত্র আমি করব, সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে হবে। শোষণহীন সমাজ বাংলাদেশের হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করছি এবং আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি জানি বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমিও বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমি বাংলার মাটিকে ভালবাসি, বাংলার মাটিও আমাকে ভালবাসে। আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে পারতাম না। আমার মনে হয় এদেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া আর এই মাটির টানে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে, যেখানে আমার জন্য কবর খোড়া হয়েছিল তার কাছ থেকে আমি আসতে পারতাম না। এই মাটিকে আমি ভালবাসি।
আমি চাই, আমার বাংলার মানুস হাসুক, আমার বাংলার মানুস পেট ভরে ভাত খাক। আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক, আমার বাংলার মানুষ নির্যাতিত না হউক, আমার বাংলার মানুষ সুখী হউক। আমার বাংলার মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করুক। লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে আমার দেশে। চাকুরীর বন্দোবস্ত আমি করতে পারছিনা। চাকুরীর বন্দোবস্ত করতে হলে কল-কারখানা করতে হবে। সরকারী চাকুরীতে চাকুরী হয় না। আমি তোমাদের বলে দিতে চাই, আমি এমন এক অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই- শোষণের জন্য অর্থনীতি আমি গড়ে তুলতে চাই না। এখানে নীচের থেকে শুরু হবে উন্নয়নের অর্থনীতির ধারা এবং এটা করতে হলে সকলের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি আজ আপনাদের কাছে, আপনারা জানেন, যে দেশে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে, যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি, আমার সহযোগিতায় যারা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়েছেন। তারা হত্যাকান্ড চালাতে দেন নাই। আমি চাই না নির্দয় অসহায় মানুষ বিপদে পড়ুক, তা আমি চাই না। তার মানে এই নয় যে আমাদের দূর্বলতা আছে। আমাদের দূর্বলতা নাই। মাপ করেন। মন প্রাণ দিয়া কাজ করেন। পয়সা খাওয়া ছেড়ে দিন। লোভ ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা আবারও বলে দিচ্ছি-সাত দিন সময়। ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্সি, তেলের এজেন্সি, চালের এজেন্সি, দুধের এজেন্সি বিসমিল্লাহ করে সাত দিনের পর আমি ক্যান্সেল করিয়া দিব-যদি না করেন। আপনারাতো জানেন আমি মুজিবর রহমান যা বলি তা করবার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়া কত তেলাইছে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য। প্রধানমন্ত্রী ফদানমন্ত্রী আমি হবার চাইনি, আপনারা জানেন। আমি মরতে গিয়েছিলাম কিন্তু বাংলার সাথে বেঈমানি করি নাই। আর এখনও বলছি, আমি মরতে পারি কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে আমি বেঈমানি করতে পারব না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সংঘবদ্ধ হইয়া থাকেন। একদল লোক রয়েছে, এটা হলনা, ওটা হলনা, ওটা হলনা, এটা হলনা। কিচ্ছু দেবার পারব না। আমি বলেছি কিচ্ছু আমার কাছে নাই। আমি দুনিয়ার কাছে ভিক্ষা করে আনতেছি, ভারতবর্ষ আমাকে সাহায্য না করলে আমি দেশ চালাতে পারতাম না। একদল লোক আপনাদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছেন। আমি সাবধান করে দেবার চাই, ভারতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চুক্তি হয়েছে। আমি একটা স্বাধীন দেশ, ভারতবর্ষ একটা স্বাধীন দেশ। দুই স্বাধীন দেশের সাথে বন্ধুত্ব। এখানে কোন গোলমাল টোলমাল নাই। আমার স্বাধীনতা কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, আমিও তোমাদের ক্ষমতার হস্তক্ষেপ করবো না। কিন্তু যারা আমার বন্ধুত্বের হরণ করার চেষ্টা করবেন তারা মনে রাখবেন, তারা জানেন না, আমি হাত বাড়াইয়া, একবার হাত বাড়াইলে আমি কোনদিনও ফিরাইনা, এটা ইয়াহিয়া খানও জানে, আইয়ুব খানও জানে।
তাই বন্ধুরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যাই কিছু করেন। আমি কিছু দেবার পারবনা। তিন বছর পরে, তিন বছর ধরে যদি যুদ্ধ চলত, আপনারা যুদ্ধ করতেন না? আপনারা না খেয়ে যুদ্ধ করতেন না? ধরেন আরো তিন বৎসর যুদ্ধ করতে হবে। যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তা ঠিক করতে আমার পঞ্চাশ বৎসর সময় লাগত। কিন্তু আমি মনে করি ইনশাল্লাহ তিন বৎসরের মধ্যে পারব। কিন্তু আপনাদের সহযোগিতা করতে হবে। একলা কেউ কিছুতে চলতে পারে না। তাই আপনারা, আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা দোয়া করবেন। ভালবাসা আপনারা আমাদে দিয়েছেন, আমার জীবনের ওটাই যেন পাথেয় হয়ে থাকে।
ইন্শাল্লাহ সোনার বাংলা আবার জাগবে, যদি শোষণহীন সমাজ গড়তে পারি। তবে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের কাছে আমার আরেকটা অনুরোধ হলো যে, দূর্ণীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করতে রাজী আছেন কিনা? দূর্ণীতি আর ঘুষ, রাজী আছেন? হ্যাঁ, খোদা হাফেজ-জয় বাংলা।
সংগ্রহ সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ বেতারে দেশ আমার মাটি আমার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু র বক্তৃতা
আজকে কি? আজ আমাদের কি অবস্থা? আজ আমাদের পপুলেশন, আজকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আজ আমরা শ্রমিক আন্দোলন করব। কি বরব? কারখানায় কাজ হবে না। কারখানায় প্রোডাকশন না বাড়াইয়া ভীক্ষুকের জাতিতে উন্নীত হবো। দুনিয়ায় জীবনবরে ভীক্ষা-পাওয়া যায়? স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সে জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। কাজ করব না ফাঁকি দিব, অফিসে যাব না, ফাঁকি দিব। ফ্রি ষ্টাইল। ফ্রি ষ্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়। অফিসে দশটার আগে যাওয়ার কথা বললে বারোটার আগে যাব না। রাস্তায় কাজ করব না। কারখানায় কাজ করব না। আমার কৃষক খারাপ না। আমার শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। আমার কৃষক উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে গেছে। আমরা বাঁধার সৃষ্টি করি, আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরাই যেন ধোক দেই, আমরাই যদি লুট করে খাই। আমরাই যদি দখল করে নিয়ে যাই, আমরা যারা বড় বড় এখানে আছি, তারাই প্রশ্ন করে। তারা কারা? তারা এদেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। এদেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ, যাদের পেটের মধ্যে দুই অক্ষর বুদ্ধি ঐ বাংলার দুঃখী মানুষের টাকায় শেখা। আমি কি পেলাম, আমি বারবার বলেছি আজকে আমার আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। আজকে আমাদের আত্মবোধ প্রয়োজন, আজকে আমার আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। না হলে দেশকে ভালবাসা যায় না। দেশের জন্য কাজ করা যায় না এবং দেশের হিম্মত করা যায় না। কলে-কারখানায়, ক্ষেত-খামারে আমার প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না। কি করে আপনি করবেন? যদি পারেন ২০ লক্ষ টন খাবার যদি বৎসরে প্রয়োজন হয়, কত হয়? ৪৫০ লক্ষ মন। কে দেবে? প্রত্যেক বৎসর লোনের থেকে এই তিন বৎসরে বহুরাষ্ট্র সাহায্য দিয়েছে। লোন দিয়েছে, আনতাছি। কতকাল ধরে, কতদিন ধরে, মানুষ বাঁচবে না। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক আমার নতুন নতুন বাড়ে। আজকে আমাদের পপুলেশন প্লানিং করতে হবে। পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর ২৫ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোক হয়ে যাবে। ষোল হাজার স্কয়ার মাইল, বাঁচতে পারবেন না। যেই ক্ষমতায় থাকুক বাঁচার উপায় নাই। একটা পপুলেশন কন্ট্রোল আমাকে করতেই হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে হবে, না হলে মানুষ বাঁচতে পারবে না এবং বাঁচার জন্য তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। বিশৃঙ্খল জাতি কোনদিন বড় হতে পারে না। উশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিরাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আর যাকে এ্যারেস্ট করবে-বলে যে, অমুক পার্টির লোক। খবরের কাগজে বিবৃতি। জিনিস এক জায়গায় একশ দশ টাকা হলে একদিন হঠাৎ এক জায়গায় কিছু দাম বাড়লে খবরের কাগজ চাপাইয়া দিল সমস্ত বাংলাদেশে বেড়ে গেল। যেখানে সমস্ত কিছুর অভাব, যেখানে দুনিয়া থেকে সব কিছু কিনতে হয়। আমরা কলোনি ছিলাম। আমরা কোন জিনিসে সাফিসিয়েন্ট না। আমরা কাগজে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না । আমরা তেলে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমরা খাবারে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমাদের রড সিমেন্টে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। কোন বিষয়ে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানীদের। আমাদের যা কিছু করতে হবে, সব কিছু আনতে হবে। কোথায় পাবেন বিদেশী মুদ্রা ছাড়া? দু হাতে কাজ করতে হবে, ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতিকে প্রশ্ন করতে আমি চাইনা। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হউক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে।
তাই আত্মসমালোচনা করেন। আত্মশুদ্ধি করেন, তাহলেই হবে। সমাজ ঘুনে ভরে গেছে। এ সমাজকে আমি টালমাটাল করতে চাই। এমন আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আপনাদের সমস্যা নাই। আমি জানি আপনাদের সদস্যা আছে। কিন্তু একটা কথা, এই দেশ নতুনভাবে সাজাতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমূখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভূল কইরেন না। আপনাদের জমি আমি নেব না। ভয় পাইবেন না, জমি নিয়া যাব তা নয়। বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভ জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার আওতায় থাকবে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ। যে মানুষ কাজ করতে পারে। তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আলটিমেটলি প্রত্যেকটি ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা যাবে। তাদের কাছে পয়সা যাবে। কাছে বেতন যাবে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল....। তা না হলে দেশ এগুনো যাবে না। এজন্যই ভিলেজে কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে, পাঁচ বৎসর মেয়াদি প্রত্যেকটি গ্রামে কয়েক হাজার লোক পাঁচশ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্বলসারি কমিউনিটি হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নিবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভ, ঐ অংশ গভঃর্ণমেন্টের হবে। দ্বিতীয় অংশ থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।
(অংশ বিশেষ)
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, সভা শুরু করার পূর্বে আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল সভায় আমরা প্রস্তাব করতেছি, যে সমস্ত ভাইয়েরা স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং যুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীসহ বাংলাদেশের যেসব কৃষক যে সব বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, বিডিআর, সেনা বাহিনীর লোকেরা যারা শহীদ হয়েছেন, প্রথমে আমরা তাঁদের জন্য প্রস্তাব করছি এবং শোকসংসপ্ত পরিবারের জন্য শোক প্রস্তাব করছি এবং আপনারা তাদের আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করে আমরা মোনাজাত করছি।
(মোনাজাত)
দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, উপস্থিত অতিথিবৃন্দ আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করেন। গত কাউন্সিল সভায় আপনারা যোগদান করেছিলেন। সেবারে আমরা যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম এবং যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তা কার্যকর করতে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের আমার বড় ভাই এবং সহকর্মী যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, যাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ ২৩/২৪ বৎসর কাজ করেছি, সে অনেক কর্মী এবং অনেক নেতা আজ আমাদের মধ্যে নাই, তারা শহীদ হয়েছেন। শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা, সরকারী কর্মচারীরা, সৈনিক বাহিনীর ভাইয়েরা, পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, শ্রমিক ভাইয়েরা, ছাত্র ভাইয়েরা, বিশেষ করে যাকে আমরা বিডিআর বলি, বাংলাদেশ রাইফেলসের কর্মীরা। ওদের ফিরে পাবনা। ওরা আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসবে না। ওদের ডাক দিয়েছিলাম সংগ্রাম করার জন্য, দেশকে মুক্ত করার জন্য, ওরা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইতিহাস বেশী আমি তর্জ্জমা করতে চাইনা তবে কিছুটা ইতিহাসের প্রয়োজন আছে। হঠাৎ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় নাই। স্বাধীনতার শুরু হয়েছে অনেকদিন পূর্বে এবং সকল সময়ে সকল কথা বলা যায় না। আন্দোলনের মধ্যে থেকেই বুঝে নিতে হয়। এটা আপনারা জানেন এবং বুঝেন। সহকর্মীরা জানতেন এবং বুঝতেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে তাদের জীবন বাজী রেখে নৌকা চালাতে হয়েছে। কোনদিন তারা ভাটিতে নৌকা চালাতে পারেন নাই- কয়েক মাস ছাড়া। আওয়ামী লীগের কর্মীদের ত্যাগ তীতিক্ষার স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই জন্য এখন লেকা থাকবে যে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। লেখা থাকবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস। যারা শহীদ হয়েছে স্বাধীনতার জন্য। কর্তব্য রয়েছে দেশবাসীর, কর্তব্য রয়েছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না হলে রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে যায়। ইতিহাস, ছয় দফার পিছনেও ইতিহাস ছিল। আওয়ামী লীগ জন্মের পর থেকে স্বায়ত্ত্বশাসনের ইতিহাস-সে ইতিহাসের পিছনেও অনেকটা ইতিহাস ছিল। এ কথা সত্য যে শুধু শহীদ এই সংগ্রামেই হয়েছে তা নয়। বাংলার মানুষ বার বার শহীদ হয়েছে। ১৯৫২ সালে শহীদ হয়েছে বাংলার ছেলেরা, ১৯৫৪ সালে হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ও শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগের অন্যান্য দল ব্যান্ড হওয়ার পরেও সেখানে অনেকের জান দিতে হয়েছিল। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পরেও অনেকের জান দিতে হয়েছিল এবং অনেকে জেল খেটেছিল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ফলে ১৭ই জুন তারিখে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফার আন্দোলনে ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দেরা সেখানে গিয়ে তাদের সহযোগিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যায়, তখন অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাস শুধু যে রক্তের ইতিহাস তা নয়, বাংলার ইতিহাস শুধু যে নির্যাতনের ইতিহাস তা নয়। বাংলার ইতিহাস শুধু যে আন্দোলনের একবারেই আমরা সংগ্রাম করেছি তা নয়, এ সংগ্রাম শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই। শুধু জনগণের খালি আওয়ামী লীগের সংগ্রাম হলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে এটা জনগণেরও সরকার, সাড়ে সাত কোটি মানুষ-মানুষেরও সরকার। এটা সম্পর্কে পরিস্কার থাকা দরকার। আপনাদের কাজ করতে হবে। বিরোধী দলে থাকা এক রকমের পন্থা। আর সরকারী পক্ষে রাজনীতি করাও অন্য রকম পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজ দিয়ে মূলত এগিয়ে যেতে হবে। অত্যাচার-অবিচার যেন না হয়। জুলুম যেন না হয়। লুটতরাজ যেন না হয়। দেশের মানুষকে ভালবেসে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম দিনের উত্তাপ হারাম, আমাদের দুঃখী মানুষের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে।
ভাইয়েরা আমার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে চাইলে অনেক বার যেতে পারত। ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করে নাই। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলুন। আমাদের নীতি বিপরীত। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না। সেই জন্য জীবনে নীতির সঙ্গে আপোষ করতে পারি না। দরকার হলে দলের লোকজন যদি বেঈমানী করে তার সঙ্গেও আমি আপোষ করতে রাজী নই। নিয়মের উর্ধ্বে উঠতে হবে। নিয়ম যেখানে ধ্বংস সেখানে একবার যদি কেউ নীল হয়ে যান, সে জীবন কোন দিন আর মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবেন না। শুধু আপনার মুখে কালী দেবেন, কালী দেবেন এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে। যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীন হয়েছে। সে আওয়ামী লীগের মুখ কালি হয়ে যাবে। দেশের মানুষের মুখ কালি হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের দায়িত্ব যথেষ্ট রয়েছে। এই দায়িত্ব থেকে তারা রেহাই পেতে পারেন না।
আমরা শৃঙ্খলা রাখতে চাই, আমরা গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্র মানে উশৃঙ্খলতা নয়। গণতন্ত্র মানে সেখানে গোপনে পোস্টার দিয়ে ষড়যন্ত্র নয় এবং আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে সেটাও নয়। সেখানে সরকারের একটু শক্ত হতে হবে এবং শক্ত হবে, ভাল হইতে হবে সন্দেহ নাই এবং সেটাও আমরা করতে চাই না। জনগণই করবে সে বিশ্বাস আমার আছে। আর জনগণকে আমি চিনি, জনগণ আমাকে চিনে। জনগণ আমাদের ভালবাসে, আমরা জনগণকে ভালবাসি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার এবং তা মেনে চলে। নিরপেক্ষ ইনডিপেনডেন্ট ফরেন পলিসি। আমাদের ফরেন পলিসি, বৈদেশিক নীতি পরিস্কার। আমরা কোন যুদ্ধে সংঘাতে বিভ্রান্ত হতে চাই না এবং কবর না। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাস করতে চাই, আমরা সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা সামাজ্যবাদ, আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমরা দুনিয়ার দুঃখী মানুষ যেখানে সংগ্রাম করবে, তার পক্ষে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। কারণ আমরা দুঃখী, আমরা কষ্ট সহ্য করেছি। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়েছি। আমরা যেখানে দুনিয়ার সকল মজলুম মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। আমরা তার পাশে গিয়ে দাড়াব।
(অসমাপ্ত)
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
ভদ্র মহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আপনারা আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনারা আমাকে প্রধান অতিথি করেছেন, আমার ব্যক্তিগত পক্ষের থেকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মতের যেখানে মিল আছে, মনের যেখানে মিল আছে। আপনাদের কাছে আমি দু’চারটি কথা বলতে চাই, আপনাদের কাছে ইতিহাস বলে লাভ নাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন যেমন মুক্তির শর্ত, অর্থনৈতিক মুক্তি করাও তেমনী শর্ত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যায় যদি এদেশের দুঃখী মানুষের জন্য কিছু না করা যায়। এদেশে শোষণহীন সমাজ যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একমাত্র পথ বলে আমরা বিশ্বাস করি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বাঁচে, যেদিন লেখা হবে অনেক দুঃখের ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হয় কারণ শোষণ এবং শোষক শ্রেণী হুঁশিয়ার ছিল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ওদের স্বাধীনতা ভোগ করেন আর আমরাও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু সে স্বাধীনতা যে এই স্বাধীনতা হবে ১৯৪৭ সালে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এ স্বাধীনতা মিথ্যা, এ স্বাধীনতা বাংলাদেশকে লুট করার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষের চিরদিনের মতো গোলাম করার ষড়যন্ত্র। কেন্দ্রে বসে নেতারা স্বাধীনতা ভোগ করেন। বাংলাদেশকে ভাগ করেন। বাংলাদেশকে ভাগ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা বাংলাদেশকে শাসন করার চেষ্টা করেন। তারা শোষণ করতে চেয়েছিলেন আমার সংস্কৃতির উপর আঘাত করে। আমরা ভাষার উপর আঘাত করে। আমার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আঘাত করে। সামাজ্যবাদী শক্তি যেমন একটা কলোনীকে তার নিজস্ব স্বাধীকার থেকে বঞ্চিত করে। শোষণ করার ষড়যন্ত্র করে ঠিক একইভাবে আমাদের এই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণীরা এই বাংলার মানুষকে শোষণ করার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তরা কলোনিতে পরিণত করেছিল।
আমার ছোট ছোট ভাই ও বোনেরা, এই স্বাধীনতার আন্দোলন গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৭ সালের জুন মাসে, যখন ঘোষণা হয় তারপর থেকে। আমাদের অনেক এদিক দিয়ে, ওদিক দিয়ে, এপাশ দিয়ে, ওপাশ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো মেনুয়াল করে চলতে হয়েছে এবং সেজন্য আমাদের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ আন্দোলন শুরু না করতে পারলে দেশের বিপ্লব করা কষ্টকর হয়ে যায়। এজন্যই আমরা জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের দিকে বেশী এগিয়ে পড়েছিলাম। এজন্যই সে সময় আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবরা আমাদের অনেক সময় আমাদের এই প্রোগ্রামকে মানতেন না বা সমালোচনা করতেন। তারা ভুল বুঝতেন। তারা আমাদের উদ্দেশ্যের উপর কটাক্ষ করতেন কিন্তু আমরা জানতাম যে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে, অনেক সময় জাতীয়তাবাদ আন্দোলন তার সঙ্গে যদি একটা পরিস্কার কর্মপন্থা না থাকে। তখন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আন্দোলন আমরা সাথে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তখন এই যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এর পরে সমাজ থেকে অর্থনীতি করতে আমাদের কোন দিন দ্বিধা বা কষ্ট হতে পারে না। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা....।
সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে রুখে দাঁড়ানো বড় কষ্টকর ছিল। আমাদের দেশের মানুষ ছিল ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মের নামে শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে নেয়া বড় সোজা। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল এই ধর্ম। নিজেরা কিন্তু কোনদিনও ধর্ম পালন করতেন না কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করতেন। এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যেটা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি, তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল সেটাকেই ফলো করতে চেষ্টা করতেন।
আপনারা ইতিহাস জানেন, ইতিহাস বলতে চাই না, আপনারা জানেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস, আপনারা জানেন ৫২ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৫৮ সালের মার্শাল ল, আপনারা জানেন ৬২ সালের ইতিহাস। আপনারা জানেন ৬৪ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৬৯ সালের ইতিহাস। আপনারা জানেন এই সরকারকে।
স্বাধীনতা পেয়েছেন, আপনারা ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন। ত্রিশ লক্ষ লোক শুধু রক্ত দেয় নাই, প্রায় দুই কোটি আড়াই কোটি লোকের ঘর বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই করে নাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। বড় বড় সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমনে বাংলাদেশের পুলিশ বাংলাদেশের ইপিআর (তখনকার ইপিআর, বর্তমানের বিডিআর, বাংলাদেশ রাইফেল্স) সামরিক বাহিনীর লোকদের হত্যা করা হয়েছে। তারা প্লান করেছিল, সে প্লান অনুযায়ী যা চলেছিল, এদেশে যারা কথা বলার মতো মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো ছিল-তাদের সবাইকে হত্যা করে শেষ করে দাও। আমরাও জানতাম, আমরাও বুঝতাম। তারাও সময় নিচ্ছিল, আমরাও সময় নিচ্ছিলাম। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব বলতেন নির্বাচন করনা, আমরা নির্বাচন বয়কট করলাম। আমি বললাম না নির্বাচন করব। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যে আমার এই প্রোগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণ এবং সেটা পরিস্কারভাবে দেখা গেছে যে সেটা আমাদের যে একটা শক্তি ছিল। যদি বেঈমানী করতাম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভে। তাহলে ইলেকশনের রেজাল্ট ফেজাল্ট নষ্ট হয়ে যেতো কিন্তু নির্বাচন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। আমি ইলেকশনের পূর্বের ঘোষণা করেছিলাম এটা আমার গণভোট, স্বাধীকারের গণভোট, যদিও সাথে সাথে এই শ্লোগানও ছিল-এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাকে বন্ধু-বান্ধবরা বলতেন ঘোষণা করে দাও। আমি বলি ঘোষণা করে আমি নিশ্চয়ই দিয়েছি কিন্তু ঘোষণা করার কায়দা আছে। দস্তকে বেকায়দায় ফেলতে হয়, দস্তকে নিয়ে বেকায়দায় পড়তে নাই। ওটা একটা যুদ্ধ। ওটা এটা আন্দোলন, আন্দোলন না করলে আন্দোলন শিখা যায় না। বই পড়ে আন্দোলন হয় না, ও থিয়োরিশিয়ান হয়ে যায়, চৌকস হয়ে যায় নেতৃত্ব করে তারাই জানে আন্দোলন কি জিনিস। আন্দোলন কি ভাবে করতে হয়। বই পড়া থিয়োরিশিয়ানরা জীবন ভরে বই পড়েই খালি খবরের কাগজে লিখেন কিন্তু প্যাকটিকাল জিনিস কিভাবে আন্দোলন পরিচালিত করতে হয় সে শিক্ষা তাদের হয় নাই। মাঝে মাঝে সেজন্য ফাউল প্রিন্ট করে ফেলে। আন্দোলনের একটা ধারা আছে। যেটার মাধ্যমে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয় মানুষকে। মানুষকে এমন কিছু বলতে নাই, যেটা দেখলে মানুষ চমকে উঠে। এমন কিছুতে মানুষকে এগিয়ে নিতে হয় যেখান থেকে মানুষ ফেরত আসতে পারে না এবং শত্রুকে খেলতে দিতে হয় না।
ভাইয়েরা আমার, স্বাধীনতা আপনারা পেয়েছেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। দস্যুর দল বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। দস্যূর দল বিতাড়িত হয়েছে সত্য কিন্তু ২৪ বৎসর যে বন্ধু ছিল সে বন্ধুকে বিতাড়িত করতে পেরেছেন আপনারা? পারেন নাই। তাদের বন্ধত্ব রয়েছে, তাদের বন্ধু রয়েছে, তাদের সঙ্গে যাদের সম্পর্কে তারা রয়েছে, তাদের সঙ্গে যারা পয়সা লুটত তারা রয়েছে। তাদের সঙ্গে আতাত করে যারা প্রমোশন পেয়েছে তারা রয়েছে। স্বাধীনতা পেলেও এদের হাত থেকে এখনও আমরা রক্ষা পাই নাই। তারা আমার কাছে, আমার এক ছোট ভাই সেদিন বলল, যে এত তাড়াতাড়ি না করলেও তো হতো। এত তাড়াতাড়ি ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ন্যাশনালাইজ করলেন কেন? এখন পর্যন্ত ভসিমভূত একটা দেশ- পয়সা নাই, অর্থ নাই, টাকা নাই, ল্যান্ডিং করতে পারছেন না। তা আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে কেমন করে আপনারা এ জিনিসটা করতে যাচ্ছেন। কি হবে? সর্বনাশ হতে পারে এদেশের। আরে সর্বনাশের কিছুই বাকী নাই। সর্বনাশের উপরে আরেকটু সর্বনাশ করে ভবিষ্যৎ বংশধরদের উপর একটা পথ দেখিয়ে দিয়ে যান।
তাই যদি হয়, কারণ তারাও চেষ্টা করেছিল যে দেরী হয়ে গেলে দূর্বলতায় আসলে তারাও নড়ে উঠলে দাড়ালে এবং সমাজতন্ত্র অর্থনীতি পিছনে আঘাত করতে পারে। আমার সহকর্মীরা এবং আমি এ সম্বন্ধে খুবই হুশিয়ার। প্রায় সাড়ে সাত কোটি লোক ৭৪ হাজার বর্গমাইল। এত অল্প জায়গায় এত বেশি লোক কোথাও বাস করে না দুনিয়ায়। জমি আমাদের নাই বলতে গেলে। যা আছে তাতে কয় পার্সেন্ট লোকের জায়গা হয়। শিল্প-কারখানা যা আছে তার মধ্যে আমাদের কত লোকের বেকার সমস্যা দূর হয়। অর্থনীতি এমনভাবে ২০০ বছর ইংরেজ, চব্বিশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণী বাংলার অর্থনীতিকে ভেঙ্গে চুরে চুরমার করে দিয়ে গেছে। আমিতো কোনদিন আপনাদের কাছে মিথ্যা ওয়াদা করি নাই। আমি তো একথা বলি নাই আপনাদের যে স্বাধীনতা পেয়েছেন এখন এই পাবেন, কই পাবেন, ওটা পাবেন এটা দেয়া হবে, ওটা দেয়া হবে চাকুরী দেয়া হবে। আমিতো পরিস্কার বলি, তিন বৎসরের মধ্যে কিছু দিবার পারিবনা। যদি বলেন পারিব-আমি বিদায় নিতে রাজী আছি। যদি কেউ বলেন, এগিয়ে আসেন, আমার আপত্তি নাই। আমি ছেড়ে দিতে রাজী আছি ক্ষমতা। কিন্তু যারা সত্যিকারের প্রগতিশীল, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যারা পড়ে পড়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে না, তারা নিশ্চয়ই আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে-এ সম্বন্ধে বিন্দু মাত্র সন্দেহ আমার নাই।
কিন্তু যারা সমাজতন্ত্রের বই পড়ে কথা বলেন, যারা সমাজতন্ত্রের অর্থ বুঝেন না। যাদের উদ্দেশ্য অন্যদিকে। যারা অতি বিপ্লবের কথা বলে বেড়ান এবং অতি বিল্পবের সমর্থনে কথা বলেন। যারা আমার দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই বোন যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম করতেছিল, তখন যারা পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন, তারা আবার প্রগতিশীল বলে দাবী করেন। তারা আবার বক্তৃতা করেন। এই আমি বক্তৃতা করতে দিচ্ছি বলে তারা যেন মনে না করেন, তাদের আমি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি। দরকার হলে আবার সংগ্রাম শুরু হতে পারে। আমি কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না। কোন জনগণের বিরুদ্ধে আমি নই। আমি আমেরিকার বিরুদ্ধে নই। আমি দুনিয়ার কোন মানুষের বিরুদ্ধে নই। আমি তাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং তাদের শাসনের বিরুদ্ধে। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশ, বহু দেশ দুনিয়ার, চায়না আমাকে এখনো স্বাধীনতা স্বীকৃতি দেন নাই। তিনি বন্ধুত্ব করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর শাসকদের সাথে এবং যেখানে স্যোসালিজমের নামগন্ধ পর্যন্ত নাই। তারা স্যোসালিষ্ট কান্ট্রি নিশ্চয়ই একথা তারাও বলেন আমরাও বলি। তারাও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পেয়েছিল।
বাংলাদেশের জনসাধারণ আশা করেছিল আমরা যেহেতু রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেছি নিশ্চয়ই তারা আমাদের সমর্থন করবেন। সমর্থন যদি নাও করেন আমাদের বিরোধীতা করবেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা অস্ত্র দিয়েছেন টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের কাছে। যখন বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করতে ছিল, মরতে ছিল তাদের মেশিনগানের সামনে এবং আমার ছেলেরা আমার মুক্তিযোদ্ধারা যে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে তার মধ্যে শতকরা ৬০টি অস্ত্র চায়নার, শতকরা ৪০টি অস্ত্র আমেরিকার। বলেনতো আপনারা স্যোসালিষ্ট কান্ট্রি হয়ে আপনারা মানুষের জন্য যুদ্ধবিরোধী কথা বলে, আপনারা কেমন করে, যে দেশ সমস্ত সংগ্রাম করছে, মুক্তিকামী দেশ অধিনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য কেমন করে তাদের অস্ত্র দিলেন রাতের অন্ধকারে। আমি চায়না সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি- আপনারা অনেক বোধ হয় সেকথা জানেন এবং জানেন না। তাই আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমরা যখন জয়লাভ করি এই রেসকোর্স ময়দানে, আওয়ামী লীগের সদস্যরা শপথ নিলাম। তাদের ঘুম গেল। তারা মনে করেছিল আমরা আপোষ করব ক্ষমতার জন্য। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না, সেটা আমি বারবার তাদের বলে দিয়েছিলাম। সেই দিন যখন আমরা শপথ নিলাম এই রেসকোর্স ময়দানে এম সিদের নিয়ে যে আমরা আমাদের নীতির সঙ্গে কোন আপোষ করবনা। তারপরই এক জাহাজ অস্ত্র সোয়াত নামে চট্টগ্রামে বন্দরে চায়না থেকে আসে এবং ১লা তারিখের পূর্বেই অস্ত্র আইসা পৌঁছে এবং সে অস্ত্র নামতে দেয় নাই আমার শ্রমিক ভাইরা, কর্মীরা, ছাত্ররা। ২৪ তারিখে আমাদের উপর আক্রমণ করার দিন সামরিক বাহিনীর লোকেরা এরোপ্লেনে যেয়ে বাঙ্গালী সৈন্যদের কাছে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তখন তারা মাল নামানোর চেষ্টা করে। আমি জানতাম, আমি পারতাম সে জাহাজকে ধ্বংস করতে এবং সে সামর্থ আমাদের ছিল কিন্তু করি নাই, তাহলে চট্টগ্রাম পোর্ট আমার উড়ে যায় এবং চট্টগ্রাম শহর আমার জ্বলে যায়। এত বিষাক্ত অস্ত্র তারা আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল তখন। বলেন কি করে তাদের আমি ধন্যবাদ জানাব? তবে জানাব এখন জানাতে পারলাম না। ভবিষ্যতে যদি বাংলার জনসাধারণের পাশে তারা দাড়ান তা নিশ্চয়ই তারা দাড়ান-প্রাণ খুলে জানাব, মন ভরে জানাব, দু-হাত তুলে জানাব। এখন পারলাম না, দুঃখিত।
যাই হোক আমেরিকা অস্ত্রপাতি দিয়েছেন, বিশেষ কারণে ধন্যবাদ দেই নাই। রিকোগনেশন দিয়েছেন- ভাল, সুখী হলাম, তাহলে ধন্যবাদ দিচ্ছি। মেহেরবানী করে আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইল যে আর দামবাজির খেলা আর খেইলেন না, বাংলার মাটিতে তা হবে না। আমরা সকলে সংঘাত ছাড়া বন্ধুত্ব করতে চাই। আমরা চোট দেশ, অস্ত্র দিয়ে কারো সাথে যুদ্ধ কামনা করতে পারি না। আমরা চাই একটা শান্তিপূর্ণ একটা সহ অবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করিনা। আমাদের দেশে অস্ত্রপাতি নাই। আমরা আনপ্রোডাক্ট এক্সপেনডেসার করতে চাইনা। আপনাদের মতো শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নাই। মেহেরবানী করিয়া আপনারা রিকোগনেশন দিয়েছেন, আপনাদের জনগণের সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমিও কামনা করি। আমার ভিতরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করিবেন না। তাহলে বুঝতেই পারছেন অবস্থা আবারো খারাপ হইয়া পড়িবে। যারা আমাদের রিকোগনেশন দিয়েছেন-তাদের আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই বিশেষ করে ভারত ও রাশিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভারতবর্ষ যদি আমার এক কোটি লোককে খাবার না দিত, ভারতের সৈন্যরা যদি আমার মুক্তিবাহিনীর সৈন্যদের পাশাপাশি যুদ্ধ না করত, ভারতের অধিবাসিরা তাদের ঘরবাড়ি চেড়ে দিয়ে আমাদের নাগরিকের না খাওয়াত। তাহলে আমাদের এ সংগ্রাম অনেকদিন চলত। স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আসত। কিন্তু আমাদের কি হতো বলা যায় না। এজন্য নিশ্চয়ই আমি শ্রীমতি গান্ধী, ভারতের জনসাধাণ বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়া ও আসামের জনসাধারণের ধন্যবাদ জানাই এবং তিনি আসছিলেন, আমিও ভারতে গিয়েছিলাম আপনারা জানেন আপনাদের পক্ষ থেকে কলকাতায় আমি লেখাপড়া করেছি। কেহ আপনারা জানেন কলকাতার গলি রাস্তা আমি সবই চিনি। কলকাতায় আমি রাজনীতিকর্মী ছিলাম। সাইকেল নিয়ে পথে ঘাটে ঘুরতাম। এর আগে ১৯৩৮ সালেও আমি একবার জেলে গিয়েছিলাম। যাক সে কথা। তারপরে আমরা মৈত্রি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি ভারতের সঙ্গে। কারণ ভিতরের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করিবে না। বহু রাষ্ট্রের সাথে আমরা পাশাপাশি বাস করব।
আমি সোভিয়েতে গিয়েছিলাম। সোভিয়েতের জনসাধারণ এবং সরকার, শুধু যে আমাদের সাহায্য করেছিলেন তাই নয়। যখন সংগ্রাম করতেছিল জনসাধারণ। যখন আমাকে এখান থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, মেশিন গান দিয়ে। তখন প্রথম দেশ, প্রথম দেশের প্রথম নেতা হিসেবে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে অনেক চিঠি পাঠান এবং মানুষ খুন বন্ধ করার আবেদনও করেন। সোভিয়েত রাশিয়াকে বিশেষ করে ধন্যবাদ দিব এবং যে বিশেষ সম্মান ও ভালবাসা আমাকে দেখিয়েছেন আমি মস্কোতে যাবার পরে। সেজন্য আমি তাদের আন্তুরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যে সমস্ত দেশ আমাদের ফলোআপ দিচ্ছেন তাদেরও আমি আন্তুরিক ধন্যবাদ জানাই। তবে আমার আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার আয়নার মতো। কোন কিন্তু ফিন্তু এর মধ্যে নাই। ইংরেজীতে বলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নিউট্রুয়াল ফরেন পলিসি পূর্ণ সহঅবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যে সমস্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্ত আন্দোলন করবে। বাংলাদেশের জনসাধারণ তাদের সমর্থন জানাবে। আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এটা পরিস্কার যে কারো বিরুদ্ধে আমাদের শত্রুতা নাই। আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাস করি। আমার নতুন দেশ, আমার ভস্মিভূত অর্থনীতি, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমার দেশ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ না খাওয়া, গ্রামে গ্রামে হাহাকার গৃহহারার আর্তনাদ। বেকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পয়সা নাই, ট্যাক্স ধরতে পারিনা, সরকার চালানো কষ্টকর, মানুষকে খুশী করতে পারিনা, নানা অসুবিধার মধ্যে আমরা চলছি। এই সুযোগ নিয়ে একদল ষড়যন্ত্রকারী যারা কোনদিন আমাদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে নাই। যারা আমাদের গণআন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা করছিল, যারা ছলে বলে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছিল, তারা সুযোগ নেবার চেষ্টা করছে।
আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন-ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা, আমি আশা করব যে কথা আপনাদের সভাপতি বলেছেন। তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। যারা আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা হাতে হাত মিলিয়ে গলায় গলা মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে। এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আমি সকলের কোন-অপারেশন ও সহযোগিতা চাই। সকলের কাছে যদি দরকার হয় বুদ্ধি হাওলাত নেব-তাতে আমি রাজি আছি। যদি কেউ গোপনে গোপনে আমাকে এডভাইস দিতে চান, তাতেও আমি রাজি আছি। যদি কেউ প্রকাশ্যে বন্ধ দেবার চান তাতেও আমি রাজি আছি। যারা তলে তলে গুজগুজ খুচখুচ করেন, তাদের সাথে আমি পারব না। সেটা আমার দ্বারা হবে না, আমি একগোয়া মানুষ ফট করে নেমে যাব ময়দানে, আবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আজ সুযোগ পেয়ে গেছেন, আশ্চর্য হয়ে যাই। বিপ্লবী বিপ্লবী বিপ্লবীদের উপর ঘৃণা এসে গেছে মাঝে মাঝে। এক বিপ্লবীদের নামে রাজাকার আর আল-বদর যোগ হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। বিপ্লবীদের আগে রেখে আলবদর, রাজাকার পেছনে লাইন দেছে। এটা হলনা, ওটা হলনা- তোমার বাবার মাথা হবে, আরে এখনও যে বাংলাদেশ ব্যাঁইচ্যা রইছে এও ভাগ্য ভালো। তোমাদের যে এখন পর্যন্ত আমরা যে ৭১ সালে স্বাধীনতা নিয়ে এসেছি, তারপরেও যে গুলি করে মারি নাই-এটা আমার দূর্বলতা নয়। দরকার হলে হতে পারে জনগণ করবে। আমি ঠেকাতে পারব না।
মনে করনা যে সমাজতন্ত্র করতে যাচ্ছি। সেজন্য সমাজতন্ত্র করতে যদি যে কোন পথ আমাদের অবলম্বন করতে হয়, করবই। কেউ ঠেকাতে পারবেনা। এটা আমার এবং আমার দলের বিশ্বাস এবং জনগণের বিশ্বাস।
ছাত্র ভাইদের ও বোনেরা, এক ভাই বলেছে যে শিক্ষা তিন মাসের শিক্ষা দিয়ে কি করব? স্কুল নাই, কলেজ নাই, ল্যাবরেটরি ভেঙ্গে দিছে, টিচার মাইরা ফেলে দিছে, কিচ্ছু নাই। তিন মাসের মধ্যে যে আপনারা এখানে বসে সভা করছেন আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দেন। কারণ যে অস্ত্র আপনারা নিয়ে যুদ্ধ করছেন, আমার কাছে কাগজ আছে, সে কাগজ এখন বাইর করব না, ভবিষ্যতে করব। জেনারেল ফরমান আলী খানের হাতের লেখা। এ অস্ত্র আমি অমুকের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। একটা গ্রুপ, তারা সম্মানে এখন পর্যন্ত দেশের মধ্যে আছে এবং তিনিও বলেছেন, তার হাতের লেখা পেয়েছি। সবুজ বাংলার উপর লাল রং প্রিন্ট করে দাও। তার নিজের হাতের লেখা। তাহলে বুঝতেই পারছেন ষড়যন্ত্র কিভাবে হচ্ছে।
শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। শিক্ষা হবে গণমুখি শিক্ষা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য শীঘ্রই একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে এবং সেখানে আপনাদের প্রত্যেকেরই অধিকার থাকবে আপনাদের মতামত দেওয়ার। অনেকে বলেন যে শিক্ষা কমিশনের এই প্রতিনিধি নিতে হবে, এই প্রতিনিধি নিতে হবে, তথ্য প্রতিনিধি নিতে হবে। শিক্ষক প্রতিনিধি নিতে হবে। ওমুক প্রতিনিধি নিতে হবে। এগ্রিকালচার নিতে হবে, কলেজ নিতে হবে। সব নিলেতো আর কমিশন হয়না আবার এসেম্বলি হয়ে যায়। কমিশন থাকবে, যদি আপনারা যে দল, যে মত, যে ছাত্র প্রতিষ্ঠান যা আছেন, আপনাদের মতামত দিয়ে আপনারা লেখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন-কমিশনকে সময় দেয়া হবে। আপনাদেরকে সময় দেয়া হবে। আপনাদের মত দেয়া হবে। আপনাদের সব সুবিধা দেয়া হবে। আপনারা বলেন-তারপরে কমিশন যখন রিপোর্ট সাবমিট করবে জনগণের কাছে পেশ করব। আমরাও এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করবনা। আমরা চাই গণমুখি শিক্ষা। আমরা আর ভবিষ্যতে আল্লাহর ওয়াস্তে কেরানী সাহেব পয়দা করার শিক্ষা আর চাই না। আমাদের শিখতে হবে গণমুখী শিক্ষা এবং আমাদের নিচের তলার লোক যারা গ্রামে গ্রামে বাস করে তারা যেন শিক্ষার সুযোগ পায়-সেদিক নজর রাখতে হবে। আমি আশা করি আমার বন্ধুরা তা স্বীকার করবে, যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সম্পাদক সাহেব, আশা করি তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং গ্রহণ করা উচিৎ হবে। তারপরে আমাদের বক্তব্যে আমরা বৈদেশিক নীতি বলেছি, অর্থনীতি বলেছি। গণতন্ত্র? হ্যাঁ গণতন্ত্রও বলেছি। গণতন্ত্র না হলে কেমন করে হয়। এমন দেখেন সহজে লিখেও ফেলে নাই। আমরা যে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের মৈত্রী করেছি দু’একটা পত্রিকা এও গণতন্ত্র হয়ে গেছে! সার্বক্ষণিক কটাক্ষ লেখা শুরু হয়ে গেছে এবং তারা এখানে বসে ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে একটু কিছু গরম পানি খান আর বাইরের কাছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়া দেন। তার মানে গণতন্ত্র নয়। যে গণতন্ত্র হ্যাঁ.....নিশ্চয়ই.....। কিন্তু আমরা নতুন না যে যে মাত্র তিন মাস অনধিক আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন বন্দুক নিয়ে ঘরবেন, বন্দুক নিয়ে গুন্ডামী করুক, নিশ্চই আপনারা তা চান না। নিশ্চয়ই চান না, কেউ চান না। কেউ চায় না। এটা গণতন্ত্র না। তাদের দমন করার জন্য নিশ্চয়ই আপনারা সাহায্য করবেন। এই সমাজ প্রতিরোধ এবং সেটা পুলিশের চেয়েও জনগণের বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, সুধি সমাজ এবং কৃষক সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। যাতে শান্তি দেশের মধ্যে বজায় থাকে। শান্তি বজায় না থাকলে কোন কাজই দুনিয়ায় করা যায় না।
ভাইয়েরা বোনেরা আমার, আমি আপনাদের আর মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাইনা। যে আমাকে আপনারা যে সমর্থন দিচ্ছেন এবং আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে দিবেন, এই সম্বন্ধে নিশ্চিৎ বিশ্বাস আছে। এই জন্য বিশ্বাস আছে, এটা আগেও বলেছি-আপনাদের সঙ্গে যে আদর্শ নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে আপনারা বিশ্বাস করেন এবং নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন; এ সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। তবে আপনাদের হুশিয়ার করে দিতে চাই যে, যারা এদেশকে নষ্ট করতে চায়। বানচাল করতে চায়, দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, যারা এদেশে মাঝে মাঝে গোপনে পোষ্টার ছাপিয়ে, লিপলেট ছাপিয়ে এবং বিদেশী দালাল হিসেবে কাজ করে তাদের কাছে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন- আমিতো আপনাদের সাথে আছি। নিশ্চয়ই তাদের দমন করতে হবে- এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই।
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, যে চারটি স্তম্ভের উপর বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। এই চারটি স্তম্ভের উপর বাংলা স্বাধীনতা চলবে। আপনারা জানেন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এটা আমি বিশ্বাস করি, আমার দল বিশ্বাস করে, জনগণ বিশ্বাস করে, আশা করি আপনারাও বিশ্বাস করেন। আমি আপনাদের আবারো ধন্যবাদ দিচ্ছি, তবে আমার এক ভাই প্রস্তাব দিয়েছেন যে দুই ছাত্র প্রতিষ্ঠান নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে কাজ করব কেমন করে। আমি নিশ্চয়ই আশা করব যে ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং আমি জানি ছাত্রলীগের সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম, হ্যাঁ প্রতিষ্ঠাতাও ছিলাম। আমি আশা করি নীতির সঙ্গে যেহেতু আপনাদের মিল আছে। আদর্শের যেহেতু মিল আছে-আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশে সমাজতন্ত্র গঠন করার জন্য দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে দেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে, অগ্রসর হবেন-এটাই আমি আশা করি। আপনাদের মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে যেন ভূল বোঝাবুঝি না হয়, সেটাই আমি আশা করি।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত প্রস্তাব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে আমি আজ কয়েকটি বিষয় এখানে আলোচনা করতে চাই। আজ আমরা এখানে গণপরিষদে সদস্য হিসেবে বসবার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আজকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশকে আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপরিষদে সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারছি, সে সুযোগ এ দেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয়। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ৩০ লাখ ভাই বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নিশ্চয়ই আমাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করবো এবং মনে রাখবো। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়। রক্ত দিয়েছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এদেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙ্গালী, এমনকি সরকারী কর্মচারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পুলিশ সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ার আর কোথাও নাই।
আজ তাদের কথা আমরা স্মরণ করছি, স্মরণ করতে হয় আমার সহকর্মী সভ্যবৃন্দের কথা, যারা সেই গত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের অনেককেই বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে-তাদের নাম ঐ প্রস্তাবে রয়েছে, যে প্রস্তাব আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদে পেশ করেছি।
তাছাড়া এই দেশের জানা অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। জনাব স্পীকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সাথে সাথে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরী করতে হবে। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেবো, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতের কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উচু করে রয়েছে, একটা বিরাট কর্তব্য আছে, আমি আমার বক্তৃতা বড় করতে চাই না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যে যারা সংগ্রাম করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাদের সেই ইতিহাস আজ এখানে পর্যালোচনা না করলেও চলবে। কিন্তু বিশেষ কয়েকজন নেতার কথা স্মরণ করছি, যারা গণতন্ত্রে পূজারী ছিলেন-যেমন-হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, বর্বর পাকবাহিনীর হাতে নিহত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আর কলম দ্বারা সংগ্রাম করেছেন সেই জনাব তোফাজ্জল হোসেন, আমাদের মানিক ভাই। এদের কথা শ্রদ্ধার সাথে আমরা স্মরণ করতে চাই। স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যারা জীবন দিয়েছেন, যারা কারাগারে জীবন দিয়েছেন। গণতন্ত্রকে এ দেশের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যারা সংগ্রাম করেছেন, তাদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পিছনে কারা ছিলেন।
গত বছর নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনের পূর্ব থেকেই আমাদের জানা ছিল যে, বাংলাদেশ জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের কলোনি এবং বাজার করে রাখতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত করেছিল। আমাদের নাগরিক অধিকারের উপর আঘাত করে আমাদের কলোনি করে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের সংগ্রাম তখন থেকেই চলছিল। আমরা জানতাম সংগ্রামকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে এগিয়ে আজ চরম সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ২৫ মার্চ তারিখের ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। সেইদিন বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কোন আইন-কানুন মানে নাই। কোন সভ্য দেশে তাদের কাজের তুলনা পাওয়া যায় না। প্রত্যেক সভ্য দেশে যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। কোনরূপ ওয়ানিং না দিয়েই অতর্কিতে কাপুরুষের মতো বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে, দুধের বাচ্চা পর্যন্ত হত্যা করে তারা জঘন্য লীলায় মেতে উঠেছিল। অর্ডার দিয়েছিল আওয়ামী লীগের লোক যাকে পাও তাকেই হত্যা করো, কোনরূপ দয়ামায়া নাই। তাদের জঘন্য কাজ-কারবারের এমন সমস্ত ইতিহাস আমাদের হাত আছে, যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের হাতে একজন জেনারেলের কাছে দরখাস্ত করা কাগজ ধরা পড়েছে। তাতে আছে লুটপাট করো। এমনকি পাশবিক অত্যাচারের কথাও আছে। বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র ৭ কোটি বাঙ্গালীর উপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতো, তবে আমরা সে যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিত ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হওয়ার উপর থেকে হয় নাই। যদি কোন নির্দেশ না থাকতো, তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহুর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো?
এখন যদি আমি ভারত সরকারের বিষয়ে না বলি, তাহলে অন্যায় করা হবে। আমাদের দেশের জনগণের যখন প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, ছোট-ছেলে-মেয়ের নিয়ে পায়ে হেটে ভারতবর্ষে যায়, তখন ভারতের জনসাধারণ তাদেরকে বুকে টেনে নেয়। ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং আসামের জনসাধারণ বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কারণ, তারা আমাদের জনসাধারণকে বুকে টেনে নিয়েছেন। স্মরণ করি ভারতের সেনাবাহিনীর ঐ সমস্ত জোয়ানদের, যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করেছে। আমি স্মরণ করি রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারকে, যারা নিশ্চিতভাবে আমাদের সাহায্য করেছে। তারা প্রকাশ্যে আমাদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং বাংলাদেশ ধ্বংশলীলা করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। স্মরণ করি গ্রেট বৃটেনের জনসাধারণকে, পশ্চিম জার্মানির জনসাধারণকে, যারা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। যারা যারা সমর্থন করেছিলেন, তাদের সকলকে আমাদের এ গণপরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এমনকি জাতিসংঘে রাশিয়া তিনটি ভেটো দিয়েছিল, তা না হলে সেখানে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, তাতে বাংলাদেশের অবস্থা কি হতো তা বলতে পারি না। যে সমস্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আমাদের সমর্থন দিয়েছিল, বিশেষ করে পোল্যান্ড, তাদের প্রত্যেককে এবং তাদের জনসাধারণকে আমি এই পরিষদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং স্মরণ করতে চাই।
জনাব স্পীকার সাহেব, এসব কথা বলতে গেলে ভাষা আসে না, মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে যায়। সে জন্য এগুলো বলা আমার পক্ষেও কষ্টকর। কারণ, আমি ভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমরা দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্যে কিছুই করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তারা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন সেজন্যে তাদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আরযে সমস্ত দল আমাকে সমর্থন করেছে তাদেরকে আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।
জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একা সংবিধান দেওয়া এবং যতো তাড়াতাড়ি হয়ে, সেই সংবিধান দেবার চেষ্টা করা হবে। আমার সহকর্মী ভাইয়েরা, যারা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনার মাধ্যমে তাদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আপনার গাছতলায় বসে যুদ্ধ করেছেন, না খেয়ে যুদ্ধ করেছেন, পরনের কাপড়ও ছিল না। আমার সহকর্মীদের আত্মীয়-স্বজনের উপর অত্যাচার করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেম্বারদের যে অধিকার পাওয়ার আছে, সে অধিকার পুরোপুরি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। যদি মাইক্রোফোন বিদেশ থেকে আনবার চেষ্টা করতাম, তাহলে তিন মাস সময় লাগতো, অনেক দেরি হয়ে যেতো। এই এসেম্বলি ভবন যে অবস্থায় ছিল, তাতে মাত্র ৩০০ মেম্বার বসার জায়গা ছিল, আজকে সেখানে ৪৫০ জন বসেছেন। যদি এই এসেম্বলি ভবনও না থাকতো, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেন-এই সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি। আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার মতো ঘর নেই, আমরা কিছু দিতে পারছি না, মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই-জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন-আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরী করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসবো। শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করবো তা নয়, দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইবো। এই সংবিধান মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা গত ২৩ বছর ধরে কী দেখেছি-শাসনতন্ত্রের নামে শাসনতন্ত্র, জনগণের নিরাপত্তার নামে মার্শাল ল জনগণের দাবী আদায়ের নামে প্রতারণা। আর বাংলাদেশের কথা উঠলে, হিন্দুস্থানের দালাল এই ধরনের কথা সারা জীবন শুনে আসছি। সেসব মতে এ দেশ থেকে উঠে যায়, সে জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এই পরিষদের স্পীকার হয়েছেন। আবার আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা একটা গণমূখী সংবিধান তৈরি করতে চাই এবং সেই সঙ্গে এই আশ্বাস দিতে চাই যে, আপনি যতক্ষণ নিরপেক্ষ থাকবেন, আমাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। আপনার কর্তব্যটুকু আইন ও আপনার বিবেক অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারি কনভেনশন মেনে নিয়ে পালন করবেন এই আশা করি। আপনি কোন দল বড়, কোন দল ছোট তা দেখবেন না, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিচারও ইনসাফ করবেন। আমার দলের পক্ষে থেকে আপনাকে পূর্ণ সমর্থণ ও সহযোগিতা জানাবো।
এখানে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নজরুল ইসলাম তা পড়েছিলেন, আবার সংশোধন করে তা পেশ করা হবে। আপনার মাধ্যমে আমার সদস্য ভাইদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারপর এসেম্বলি কর্মচারীরাও রাতদিন পরিশ্রম করে এতো তাড়াতাড়ি যে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন, সেই জন্যে তাদরেকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমি জানি তারা মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে খুব পরিশ্রম করে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন। তারপর আমি ধন্যবাদ জানাই এই রিপোটারদেরকে, এখানে যারা কাজ করছেন। তারা যেন পরিস্কার, সুন্দর করে রির্পোট তৈরী করেন, তাতে ভুল ভ্রান্তি যেন না হয়, কারণ এটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই ইতিহাস যেন নষ্ট না হয়। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
জনাব স্পীকার ঃ এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব ছিল তা সংশোধনের পরে যে আকারের হয়েছে, আমি তা পড়ে শুনাচ্ছি। সংশোধিত প্রস্তাব হচ্ছে।
“বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরঙ্গণা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙ্গালীরা, সাবেক ই পি আর পুলিশ আনসার মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ স্বশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে স্বীকৃতি ও সমর্থিত একই সাথে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে।
স্বাধীনতার সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সাথেও এ পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।
এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্ধুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্যে একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
এই প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা হ্যাঁ বলবেন।
সদস্যগণঃ (সমন্বয়ে) হ্যাঁ । না কেহই বলেন না।
জনাব স্পীকার ঃ এই প্রস্তাব গৃহীত হলো।
[সূত্র ঃ বাঙ্গালির কণ্ঠ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ঃ ২৯০]
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় বিশেষ অধিকার প্রশ্ন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী)ঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে জানাচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আমার এই মাইকটি একটু উঁচু করে দেবেন, আমি মানুষ একটু বেশি লম্বা।
জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ভুললে চলবে না এবং সদস্য ভাইদের আমি বলি যে, আমরা গণপরিষদের সদস্য, সদস্যাদের একটা বিধি প্রণালী আছে; এর বাইরে প্রশ্ন করবার অধীকার নাই; এটা পার্লামেন্টারী কনভেনশন। আমি আপনার মাধ্যমে আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করবো, দেখবেন, শেখবার চেষ্টা করবেন। আমরা বহুদিন পার্লামেন্টারী কাজ করতে পারিনি, আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ১৯৫৮ সালের ‘মার্শাল ল’ জারীর পরে পার্লামেন্ট হয়নি; সেই জন্য আমরা সুযোগ পাইনি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কাকে বলে এবং গণপরিষদ কাকে বলে তা শিখবার। সেই জন্য আমাদের কিছু অসুবিধা হয়। তাই বহুদিন পর সদস্যরা এসে কথা বলতে চায়, যদিও সেটা অনেক সময় বিধি বা Rules এর বাইরে হয়। আমি আপনার মাধ্যমে অনুরোধ করব যখন একজন কথা বলেন, তখন অন্য কারো বাঁধা দেওয়া উচিৎ নয়; এরূপ নিয়ম নাই। আমি আপনার মাধ্যমে জানতে চাই যে, গণপরিষদ একটা সুপ্রিম বডি, আমাদের ব্যবহারে বাইরে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া উচিৎ নয় যাতে জনসাধারণের কাছে আমাদের উজ্জত নষ্ট হয়। আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে, যেসব রুলস, রেগুলেশন এবং বিধি আছে, তা আপনি অনুসরণ করেন। আমি আপনাকে এই হাউসের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ মেম্বারদের আর একটা বিষয় হুঁশিয়ার করতে চাই। স্পীকার যখন কথা বলেন, তখন আর কোন মেম্বরের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবাণী করে তাঁকে পরিষদ থেকে বের করে দিতে পারেন।
পরিষদ কমিটি গঠন প্রসঙ্গে
জনাব স্পীকার ঃ আমি সদস্যবৃন্দকে অনুরোধ করছি যে, আপনারা এখানে একে অন্যের কথা বলবেন না এবং সকলে স্পীকারকে সম্বোধন করে কথা বলবেন। যা কিছু বলবেন তা স্পীকারকে সম্বোধন করেই বলবেন। আর কোন বক্তৃতা নয়, বর্তমানে হাউসের সামনে আর কোন প্রস্তাব নেই। যে প্রস্তাব ছিল, তা অনুমোদিত হয়েছে, গৃহীত হয়েছে। এখন আর কোন কাজ নেই, এখন পরিষদ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সমাপ্তি বক্তৃতা করবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না, অনেকদিন পর আমরা এখানে বসার সুযোগ পেয়েছি। তাই অনেক সময় আমরা পরিষদ বিধি না মেনে অনেক কথা বলে ফেলেছি, কিছুদিন আপনাকে এটুকু সহ্য করতে হবে। কারণ সদস্যরা বহুদিন পর এখানে বসবার সুযোগ পেয়েছেন। সকলে এখন পর্যন্ত সব জিনিস দেবার সময় পান নাই- তাই মাঝে মাঝে দুই একটা কথা কেউ কেউ এদিক ওদিক বলে ফেলেছেন।
আমি আপনার মাধ্যমে গণপরিষদ সদস্যদের বলতে চাই যে, আপনারা কটাক্ষ করে কেউ কাউকে কিছু বলবেন না। কারও প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলা উচিৎ নয়। কোন সদস্য অন্য কোন সদস্যকে সম্বোধন করে কথা বলতে পারেন না। সকল মেম্বারকেই জনাব স্পীকারকে সম্বোধন করতে হবে-এটা সকল সদস্যের জানা দরকার।
আমি আবার সদস্যদের অনুরোধ করছি আপনারা কারো প্রতি কটাক্ষ করে এই পরিষদে কোন কথা বলবেন না। আমার আর একটি আবেদন এই যে, আপনারা যে গণপরিষদের সদস্য, একথা যেন ভুলে না যান। আমি আপনার মাধ্যমে সদস্যদের আরও বলতে চাই যে, পরিষদে একজন বলতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এতে পরিষদের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে এবং এর দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, আমরা পরিষদ সদস্য হবার যোগ্য নই। আমি আশা করি পরিষদের সকল সদস্য সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আপনি যেভাবে দুই দিন পরিষদের কাজ চালিয়েছেন, তার জন্য এই গণপরিষদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরিষদ সদস্যরা যেভাবে দুই দিন ধৈর্য্য ধারণ করে পরিষদের কাজ চালাতে সাহায্য করেছেন, তাতে তাঁদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির আজ যে সভা হবে, সেখানে দরজা বন্ধ করে সব বিষয় আলোচনা করতে পারবেন। আজ বিকাল ৫টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভা হবে। সেখানে পার্টির সব বিষয় আলোচনা করা হবে।
আপনারা জানেন আমাদের এখানে একজন মাত্র ন্যাপের সদস্য আছেন। তিনি কিছু বেশী সুযোগ পেতে পারেন। সে জন্য আপনারা কিছু মনে করবেন না, তাঁকে সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে নিশ্চই আরও সুযোগ পাবেন। এখানে কথা বলার অধিকার সকলেরই থাকবে। গণপরিষদে বিরোধী দল বলে কোন জিনিস নাই। এটা আফসোসের বিষয়। গণতন্ত্রের বিরোধী দল থাকা উচিৎ। নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দলের সদস্যরা অধিক সংখ্যক নির্বাচিত হতে পারেন নাই। সে জন্য দুঃখ করে লাভ নাই। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এখানে বিরোধী দল হবে। আপনারা দেখতে পাবেন। বিরোধী দল হলে আমি তাদের স্বাগত জানাব।
পরিশেষে আমি এখানকার সকল কর্মচারীকে পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সদস্যদের ধন্যবাদ দেওয়ার এখানে প্রয়োজন নাই। তবে সদস্যরা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, সে জন্য আমি সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ; খোদা হাফেজ।
১৯৭২ সালের ১লা মে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার প্রিয় শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা,
স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলার মেহনতী মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করছে, এজন্য দেশ ও জাতি আজ গর্বিত। মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক। সারা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত নীপিড়িত মানুষের বিশেষ করে আজকের এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার মেহনতী মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবক যাঁরা সম্রাজ্যবাদী শোষণ, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের জুলুম এবং ঔপনিবেশিক জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে গেলেন, তাঁদের ত্যাগ ও তীতিক্ষার কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনদিন ভুলবে না। তাঁরা আর কোনদিন আমাদের কাছে কোন দাবী দাওয়া নিয়ে আসবেন না। কিন্তু এই লাখো লাখো শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এদেশের ইতিহাসে। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ দেশ গড়ার সংগ্রামে তাঁদের কাছ থেকে পাবে প্রেরণা। তাই আজকের এই মহান দিনে আমার দেশের শ্রমজীবি মানুষদেরকে আমি শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকায় নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী
আপনারা অতীতে বারবার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে নির্ভীক সংগ্রামে কাঁপিয়ে পড়েছেন। আমার বিশ্বাস, এবারও আপনারা আমার আহ্বানে মনে প্রাণে এগিয়ে আসবেন। অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটি কয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোন শ্রেণীবিশেষের ভোগ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্তে এই সম্পদকে অপচয় করতে দেওয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই ব্যবস্থায় দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক শ্রমিক ও সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করা হবে। যদিও বাধা অনেক, সমস্যার শেষ নেই, তবুও লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।
আমার সংগ্রামী দেশবাসী
আপনারা জানেন, আমাদের বর্তমান জাতীয় উৎপাদন সাড়ে সাত কোটি দারিদ্র-পীড়িত মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। শত শত বছর ধরে আমরা একটা নিকুষ্ট উপনিবেশ এবং বিদেশীদের বাজার হিসেবে লুষ্ঠিত হয়েছি। বিদেশীরা দেশের অর্থনীতিকে জনগণের প্রয়োজনের উপযোগী করে গড়ে তোলেনি। এরপরে ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যরা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এ দেশের অর্থনীতিকে পুনঃর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছে। আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তন, করেছি। পাশাপাশি দুঃখী জনগণের অভাবমোচন ও দূর্দশা লাঘবের জন্য আমাদের সাধ্যমত আশু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা ও পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ করা হয়েছে। লবণ উৎপাদনকে আর আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। সরকার প্রায় ষোল কোটি টাকার টেস্ট রিলিফ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছে। দরিদ্র চাষীদের দশ কোটি টাকার ডাকাতি ঋণ, এক লাখ নব্বই হাজার টন সার, দু’লাখ মন বীজ ধান দেওয়া হয়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে চার কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও স্কুল ঘর পুনঃনির্মাণ ও ছাত্র-শিক্ষকদের সাহায্যের জন্য প্রায় দশ কোটি টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৭টি রেল সেতুর মধ্যে ২৬২ টির এবং ২৭৪টি সড়ক সেতুর মধ্যে ১৭০টির মেরামতের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ করা হয়েছে। বাকীগুলির কাজ বর্ষার আগে শেষ করার জন্য আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্যাংক, বীমা থেমে গিয়েছিল। দক্ষ পরিচালকের অভাব, খুচরা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের টানাটানি শিল্পজীবনে নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। শূন্য হাতে সরকার ব্যাংক, বীমা পূঁজিবিনিয়োগ সংস্থা এবং শিল্প কারখানাভিত্তিক সক্রিয় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতীতে কতিপয় সুবিধাভোগী দেশের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করতো। বর্তমান ব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকেরা উপকৃত হবেন। এ জন্যই সরকারের উপর অত্যন্ত গুরুতর সত্ত্বেও আমরা চলতি বৎসরের ছাব্বিশে মার্চ আমাদের অর্থনীতির কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেমন- ব্যাংক, বীমা, সমগ্র পাট, বস্ত্র ও চিনি শিল্প, আভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন ও বৈদেশিক বাণিজ্যসহ শিল্প কারখানার একটা বিরাট অংশ জাতীয়করণ করেছি। পুরাতন পুজিবাদী পদ্ধতির ফলে সমাজতান্ত্রি পদ্ধতি কায়েমের পথে এটা একটা সুস্পষ্ট দুঃসাহসীক পদক্ষেপ। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। সমাজতান্ত্রি অর্থনীতি পুরাপুরিভাবে গড়ে তোলার কাজ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে। এখানেই শ্রমজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হলে, তাঁদের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে হবে, আমরা এখন আর পুঁজিপতি প্রভূদের ভোগের জন্য সম্পদ উৎপাদন করতে যাচ্ছি না। এখন যা উৎপাদন হবে তা শ্রমিক-কৃষক এবং বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণে লাগবে।
সমাজতন্ত্রের শত্রুরা এই লক্ষ্য অর্জনে বাঁধা এবং জাতীয়করণ কর্মসূচির সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চায়। শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু এটা করতে হলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, সে দৃষ্টিভঙ্গীর ও আচরণের আমল পরিবর্তন আনতে হবে। তাঁদের অবশ্যই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে শিল্পোৎপাদনের সুফল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষী ভাইদের ভোগ করতে দিতে হবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল দাবী দাওয়া পেশের মনোভাব ত্যাগ করা দরকার। এক কথায় সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করা সম্ভব নয়।
ভায়েরা আমার,
শ্রমিকরা যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন সেজন্য আমি ইতিমধ্যেই শ্রমিক নেতাদের সাথে শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে একটি তীব্র প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেছি। নতুন ভূমিকা পালনের জন্য শ্রমিকদের যেমন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হচ্ছে তেমনি সরকারি প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য সরকারি কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের উচ্চ ও নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের বেতনের ক্ষেত্রে যে বিরাট ব্যবধান ছিল তা কমিয়ে আনার জন্য বেতন কাঠামোর পুনঃর্বিন্যাস করার উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারী চাকরির এই নয়া কাঠামোতে কর্মচারীরার জাতীয় পুনঃর্গঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে জনসাধারণ যে সাহস ও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। বেকারত্ব ও অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দূর্মুল্য আমাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি? আমরা জনসাধারণের দুঃখ দূর্দশা সম্পর্কে সজাগ রয়েছি এবং পরিকল্পিত উপায়ে এ সমস্যার মোকাবিলার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি।
জনগণের জানা আছে, আমদানী কমে যাওয়ায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের অভাব হয়েছে। যুদ্ধে বন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কারখানাগুলি ক্ষতিগ্রস্থ ও বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা বিশেষ অসুবিধার সম্মুখিন হয়েছিলাম। কিছু সংখ্যক এজেন্ট, অসৎ ব্যবসায়ী ও কালোবাজারীরা পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে বেশ খানিকটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সামগ্রিক চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে খাদ্যশষ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এপ্রিল মাসে প্রায় দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার টন খাদ্য শস্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। মে মাস নাগাদ আরো তিন লক্ষ পচাশি টন খাদ্যশস্য আসছে। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সাড়ে সাত লক্ষ টন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য ও বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ আমাদের প্রায় সাত লক্ষ টন খাদ্যশস্য দেবার আশ্বাস দিয়েছেন। এর ফলে খাদ্য শস্যের দাম ক্রমান্বয়ে কমে যাবে আমার বিশ্বাস। খাবার তেল, কেরোসিন প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই জিনিসপত্রের দাম আরো কমে যাবে।
আমার ভাই ও বোনেরা,
আমাদের সমগ্র পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে রয়েছে বন্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পূনঃবির্ন্যাস করা। ইতিমধ্যেই বেসরকারী ডিলার, এজেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্তক করে দেয়া হয়েছে যে, যদি তারা অসাধু ও সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করে তাহলে তাদের সকল লাইসেন্স, পারমিট বাতিল করে দেয়া হবে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রতি ইউনিয়নে সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমবায় ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে বেসরকারী ব্যক্তিদের বন্টনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সামরিক স্বল্পতার সুযোগে যুক্তিহীন মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ হবে। এই পরিকল্পনা কার্যকরী করার সাথে সাথে বেতনের লোকদের জন্য আমরা কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করেছি। আপনারা জানেন, জিনিসপত্রের দাম না কমিয়ে কেবল বেতন বাড়িয়ে দিলেই জনসাধারণের অসুবিধা দূর হয় না। কাজেই মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা ইতিপূর্বে বর্ণিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছি। সেই সাথে আমরা মনে করি এই দূর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া দরকার। আপনাদের সরকার স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে দেশের গরীব সরকারী কর্মচারীদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। স্বায়ত্তশাসিত ও অর্ধ-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পুলিশ, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, দেশরক্ষা বাহিনী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকার পরিচালিত শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও শ্রমিকরা এই বাড়তি সাহায্য পাবেন। আজ থেকে এটা কার্যকরী হবে এবং আগামী পহেলা জুনের বেতনের সাথে আপনারা এই বাড়তি টাকা পেয়ে যাবেন। যে সকল সরকারী কর্মচারী প্রতি মাসে ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান তাঁদের সাময়িক ভিত্তিতে সরকার এই হারে পর্যন্ত মাসিক ২৫ টাকা।
১। মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক টাকা ২৫ টাকা।
২। মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা। এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক ১৫০ টাকা পাবেন।
৩। মাসিক বেতন ২২৬ টাকা থেকে ৩৩৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা।
ক) এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন।
খ) যে সকল কর্মচারীরা মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত বেতন পান তাঁদের জন্য মার্জিনাল এডজাস্টমেন্ট করা হবে।
যেসকল বেসামরিক কর্মচারী প্রতিরক্ষা বরাদ্দ হতে বেতন পান বা যাঁরা ওয়ার্ক চার্জড, এবং কনটিনজেন্ট কর্মচারী, তাঁদের বেলায়ও এই আদেশ প্রযোজ্য হবে। এই সাময়িক সুবিধার কোন অংশই বেতন হিসেবে গণ্য হবে না।
যেসকল শ্রমিক সরকারি মালিকানাধীন কর্পোরেশন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি তত্ত্বাবধানের অধিন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে নিযুক্ত আছেন ও মাসিক ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন তাঁদের সাময়িক ভিত্তিতে এই হারে সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছেঃ
১। মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক টাকা ২৫ টাকা।
২। মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা। এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক ১৫০ টাকা পাবেন।
৩। মাসিক বেতন ২২৬ টাকা থেকে ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা।
ক) এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন।
খ) যে সকল কর্মচারীরা মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত বেতন পান তাঁদের জন্য মার্জিনাল এডজাস্টমেন্ট করা হবে।
এই সুবিধা স্থায়ী, অস্থায়ী, বদলী ও ওয়ার্কচার্জড, শ্রমিকরাও পাবেন।
সরকারের মালিকানাধীন বা তত্ত্বাবধানকারী চা বাগানের শ্রমিকরা এই হারে এসব সাময়িক সুবিধা ভোগ করবেন।
ক) দুই সদস্যবিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত ২০ টাকা পাবেন।
খ) এক সদস্যবিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত ১০ টাকা করে পাবেন।
আমার শোষিত ভাই ও বোনেরা,
আমি বিশ্বাস করি, এই পদক্ষেপগুলি আপনাদের বর্তমান দূর্দশার কিছুটা লাগব করবে। অবশ্য জনগণের ভবিষ্যত জীবনের প্রকৃত মান উন্নয়ন এই বেতন বৃদ্ধির উপর কোনক্রমেই নির্ভরশীল নয়। সেটা তখনি সম্ভব হয়ে উঠবে যখন আমাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পূনঃর্গঠিত এবং কারখানাগুলি পুরোমাত্রায় চালু হবে। আমরা এ পর্যন্ত কোন নতুন করে, খাজনা ধার্য করি নাই। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, আপনাদের এই বেতন বাড়াবার জন্য সরকারকে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কৃষক সর্বস্তরের জনসাধারণকে সুবিধা দেয়ার জন্য ইতিপূর্বে প্রায় ৭০ কোটি টাকার বকেয়া সুদ খাজনা ও কর মাফ করে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমরা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারি।
আমার গরীব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা,
আপনারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উপযোগী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছেন। আমাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করলে সফল হবে। আজকের এই মে দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাব। এ দেশের চাষী-তাঁতী কামার-কুমোর শ্রমিক ও মজলুম জনতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করব। আমার পার্টির সহকর্মীগণ এবং সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ যে, দুঃখের মধ্য দিয়ে আপনাদের দিন কাটছে। ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথা গুজবার জন্য নেই এতটুকু ঠাঁই। ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলা আপনাদের সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তবে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে, এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পূনঃর্গঠনের জন্য জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করব।
ইতিমধ্যে কিছু সংখ্যক বিদেশী এজেন্ট ও দুস্কৃতিকারী স্বার্থান্বেষী মহল মানুষের দুঃখ-দূর্দশার সুযোগ নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। এদের অতীতের কার্যকলাপ আপনারা জানেন। আমার অনুরোধ আপনারা এই সমরাজ্যবাদী দালালদের সম্পর্কে সর্তক থাকবেন। কিছু কিছু দুস্কৃতিকারী জায়গায় জায়গায় শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করছে। আপনারা তাদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখবেন। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভায়েরা আমার,
আমি আপনাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিব না। আপনারা জানেন আমি একবার কোন অঙ্গীকার করলে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সেটা পালন করতে চেষ্টা করি। আমি বিগতদিনে যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেগুলি পালনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদ্বীপ হাতে নিয়ে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করিনি যে রাতারাতি সবকিছু ঠিকঠাক করে দেব। সমৃদ্ধির পথে কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা আমার জানা নেই। শতাব্দীর শোষণের পূঞ্জীভূত সমস্যা আমাদের সামনে জড়ো হয়ে রয়েছে। এগুলোর সমাধানের উদ্দেশ্যে কঠোর পরিশ্রম ও আরও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ভিত্তি গড়ে যেতে পারব। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে সেখানে বসবাস করতে পারব। খোদা আমাদের সহায় আছেন।
জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা,
আমি জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমি জানি, রৌদ্রের মধ্যে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আপনারা শান্ত হোন। আপনারা জানেন, ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়েছে। আজ প্রথম আপনাদের কাছে জেল থেকে বেরোবার পর আমি রাজশাহীতে এসেছি। আমি বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনাদের অনুরোধ করবো, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করবেন। আসুন, প্রথমে বক্তৃতা শুরু করার আগে তাঁদের আত্মার জন্য দোয়া করি আমরা।
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আজ আমার স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু বড় ত্যাগের বিনিময়ে। এত রক্ত কোন দেশ কোনদিন কোন জাতি দেয়নি, যা আজ আমার বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জালেমরা রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। চালের গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার সরকারী কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পুলিশ ভাইদের, বিডিআর সামরিক বাহিনীর ছেলেদের গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার সাংবাদিকদের।
মানুষ যে এত বড় পাষন্ড হতে পারে, দুনিয়ার ইতিহাসে তা কোনদিন দেখা যায় নি-যা পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা করে গেছে।
আপনারা রাজশাহীর জনসাধারণ, আপনারা তা জানেন। আপনারা নিজেরা ভূক্তভোগী। এই রাজশাহীর ওপর দিয়ে তান্ডবলীলা চলেছে।
আমি জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। আমাকে ২৫ তারিখে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। আমার ভাইদের ওপর মেশিনগান চালানো হয়। আমি মরে গেলেও আমার দুঃখ হতো না, কেননা আমার বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে। আমার আত্মা দেখতো। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না যে, আপনাদের সাথে আমার আর জীবনে দেখা হবে। আমি জানতাম না যে, বাংলার মাটিতে আমি আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না যে, আপনাদের মুখ আমি আর দেখতে পাবো। আমি জানতাম না যে, জীবনে কোনদিন আর এই সোনার দেশে সোনার বাংলায় আমি ফিরে আসতে পারব। আপনারা দোয়া করেছেন, আপনারা রক্ত দিয়েছেন আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের ফল হিসেবে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ৪ মাস পূর্বে বাংলার মাটিতে এসেছি। এসে কি দেখলাম? দেখলাম চারদিকে হাহাকার। এসে দেখলাম গৃহহারার, সর্বহারার আর্তনাদ। এসে দেখলাম লাখ লাখ লোক বেকার। এসে দেখলাম আমার মা বোন কাঁদছে। হত্যা করা হয়েছে কারো স্বামীকে, কারো ছেলেকে, জ্বালিয়ে দিয়েছে তার ঘর, ধ্বংস করে দিয়েছে, বাজার, গ্রামকে গ্রাম। রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে, ষ্টিমার ভেঙ্গে দিয়েছে, অর্থ লুট করে নিয়ে গেছে। লুট করেছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিছু রেখে যায়নি, ভস্মীভূত একটা দেশ ছাড়া।
আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, আমি আপনাদের ভালোবাসি। আমি যাবার বেলায় বলেছিলাম, আমি যদি মরে যাই, আমি যে ডাক দিয়ে যাব আমার বাংলার মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে। আপনারা তা করেছেন। আপনারা বিনা অস্ত্রে জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার মাটি থেকে বর্বরের দল চলে গেছে। কিন্তু ধ্বংস করে দিয়েছে আমার সব কিছু। ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা একদিন হাসবে। ইনশাল্লাহ, সোনার বাংলার মানুষ একদিন পেটভরে ভাত খাবে। ইনশাল্লাহ, বাংলার মানুষ আবার সুখী হবে। শোষণ বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। ভাইয়েরা আমার আজ আপনাদের আমি কিছুই দিতে পারি না। আমি কিছুই দিতে পারব না। যারা আপনাদের ধোকা দেয়, তারা দিতে পারে। আমি ধোকা দিতে পারি না।
আপনারা জানেন, জীবনে আমি কোন দিন মিথ্যা ওয়াদা করিনা। আমি জীবনে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি। একদিকে ছিল আমার প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন আর একদিকে ছিল আমার ফাঁসীর ঘর। আমি বাংলার জনগণকে মাথা নত করতে দিতে পারি না বলেই ফাঁসীকাষ্ঠ বেঁছে নিয়েছিলাম।
আমি কি চাই?
আমি কি চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক। কিন্তু বড় দুঃখ ভাই, জালেমরা কিছুই রেখে যায় নি। সমস্ত নোটগুলি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বাস করুন, যেদিন আমি এসে সরকার নিলাম এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও পাইনি।
এক কোটি লোক, এক লাখ, দশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ নয়, এক কোটি লোক বাংলাদেশে তাদের ঘর বাড়ি ত্যাগ করে, মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে স্ত্রী-পুত্র কন্যার হাত ধরে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। মহিয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনসাধারণ আমার দেশের লোককে ভাত দিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল। আমার মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যে অস্ত্র নিয়ে পাষন্ড ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্য বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিল আমার মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা। কত ছেলে যে আজ মারা গেছে। ৩০ লাখ! এক লাক, দুই লাখ নয়। আজ যখন এখানে এলাম আমার বোনেরা আমার কাছে এলো, তাঁদের স্বামীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি যখন গ্রামে যাই, আমি দেখতে পাই, চারিদিকে শুধু চোখের পানি। মানুষ এত বড় নির্দয় হতে পারে, মানুষ এত বড় পাষন্ড হতে পারে, দুনয়ার ইতিহাসে দেখা যায় নি। শুনেছি নমরুদের নাম, শুনেছি ফেরাউনের নাম, শুনেছি হিটলারের নাম, শুনেছি চেঙ্গিস খাঁর নাম। কিন্তু সব খানদেরকে পরাজিত করেছে ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যবাহিনী। তাঁরা এসেছিল ইসলামের নামে, তারা এসেছিল মুসলমানদের নামে।
শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, দুই লাখ মা বোনকে আমি উদ্ধার করেছি, যাদের উপর ইয়াহিয়ার সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার করেছে। আপনারা কি বিনা অস্ত্রে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি? করেছেন? পারবেন না, এই গুন্ডাদেরকে শায়েস্তা করতে?
ওরা আমার শতকরা ৬০ ভাগ পুলিশকে হত্যা করেছে। শতকরা ৫০/৬০ ভাগ বি.ডি.আর হত্যা করেছে। অর্ধেকের মত বাঙ্গালী সৈন্য তাঁরা হত্যা করেছে।
পুলিশেরা আপনাদের ভাই। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এবারও তাঁরা অস্ত্র ধরবে। আমি চাই যে, জনগণ তাদের সাহায্য করবে। আমার অস্ত্র না থাকতে পারে, আমার বাঁশের লাঠি আছে, আমি বলেছিলাম যে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। আবারও আমি বলছি বাঁশের লাঠি তৈয়ার করো। দরকার যদি হয় তোমাদের কাছে আমি অস্ত্র দিয়ে দেবো। কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার দুশমনদের সঙ্গে আমার আপোষ নেই। ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সে স্বাধীনতা আমি নষ্ট করতে দিতে পারি না।
সকল বকেয়া খাজনা চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি,
ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। আমি ১৬ কোটি টাকা দিয়েছি টেস্ট রিলিফের কাজে। আপনারা গ্রামে গ্রামে টেস্ট রিলিফের কাজ করেন এবং কেউ যেন এই টাকা চুরি করতে না পারে। দু’লাখ মা বোন! বলুন এদের আমি কোথায় কি করবো? কি করে আমি বাঁচাবো? কি করে আমি বাঁচাবো। কি করে আমি খাবার দেবো। আমার গুদামে চাল নাই। আমার তহবিলে পয়সা নাই। কিন্তু আমি মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারি না। তাই প্রথমে আমি বলে দিলাম, টাকা নাই ঠিক, কিন্তু গরীবকে অত্যাচার করে খাজনা আদায় করা চলবে না। তাই যত বকেয়া খাজনা ছিল আমি চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি। লবণের ওপর কর থাকতে পারেনা। আমি তা তুলে নিয়েছি।
এই ময়দানে একবার আমি একটা কথা বলেছিলাম, আপনাদের তা মনে আছে কিনা জানি না। আমি যদি বেঁচে থাকি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ হয়ে যাবে। আমি মাফ করে দিয়েছি। প্রায় ৭০ কোটি টাকা আমি মাফ করে দিয়েছি। বলুন আমি টাকা পাবো কোথায়? আমার গুদামে চাল নেই। গত বছর মানুষ কৃষি কাজ করতে পারেনি। সাড়ে সাত কোটি টন ভারত সরকার এবং মিসেস গান্ধী দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন এবং পাঠাচ্ছেন। জাতিসংঘ থেকে আমরা খাবার পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশ থেকে খাবার আমি কিনছি। আনবো কি করে? জাহাজ কোথায়? বর্বরা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে, যাতে অন্য জাহাজ না আসতে পারে। রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে জাহাজগুলো তুলছি। জাতিসংঘ আমাকে ৬ লাখ টন চাল দেবে। এছাড়াও দুনিয়ার অন্যান্য দেশকে বলছি, আমার লোককে বাঁচাও, আমার লোককে খাবার দাও। আমার দেশের লোক মরে গেলো। খাবার দাও। দুঃখ হয় কি জানেন? আমি ভিক্ষা করে চাল নিয়ে আসি, আমি গ্রামে গ্রামে পাঠাই, আর চোরাকারবারীরা সে মাল চুরি করে খায়। ইচ্ছে হয়, ওদের পেটের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আমি কালোবাজারীর পয়সা বের করে আনি। বাংলার জনগণ বিনা অস্ত্রে মোকাবেলা করেছে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের। পারবেন না এদেরকে শেষ করতে? আমিতো অস্ত্র দিয়ে যাইনি। আমিতো পয়সা দিতে পারিনি। আমিতো দিয়েছিলাম শুধু আদর্শ, দিয়েছিলাম স্বাধীনতার ডাক।
বাংলা আজ স্বাধীন হয়েছে। আজ বাংলার পতাকা উড়ছে। দুনিয়ার প্রায় ৭০ টি দেশ আমার বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। আজ এই পতাকা দুনিয়ার দেশে দেশে উড়ে। আজ আমি মনে শান্তি পাই যে, আমি আপনাদেরকে দেখতে পাই। কিন্তু শান্তি আমার নাই। আমার পয়সা নাই। গরীব কর্মচারী না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি কি করবো? আমি বললাম, ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দাও। তাতে আমার ৪০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পাবো কোথায়? ট্যাক্স কোথায়? খাজনা কোথায়? কোথা থেকে আনবো। কার কাছ থেকে আনবো? কিভাবে দেবো? রাস্তা নেই। বাস ট্রাক নেই। ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। রাস্তাগুলোর পুল উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাক ছিলনা। আমি ট্রাক পাঠিয়েছি। ট্রাক আনছি দুনিয়ার কাছ থেকে। আনতে সময় লাগে না? আনতে সময় তো লাগে। স্কুল-কলেজ ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গেছে। কেমন করে ছেলেরা লেখাপড়া শিখবে? বই পর্যন্ত নেই। ল্যাবরেটরী নেই। টেবিল-চেয়ার নেই। কি করে ছেলেরা লেখাপড়া করবে? দশ কোটি টাকা দিয়েছিল আমি তাদের জন্য। আমি কোথায় পাব? কি করে দেবো? আমার তো নেই কিছু। আমি তো গরীব মানুষের উপর ট্যাক্স বসাতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমি তা এক পয়সা ট্যাক্স বাড়াইনি। তাহলে বলবে কি করে? আপনাদের কাজ করতে হবে। ছেলেদের কাজ করতে হবে। আপনারা মনে রাখবেন, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। দুশমনরা বসে নেই। দুশমনরা খেলছে। দুশমনরা পয়সা লুটছে।
বাংলাদেশে দালাল ছিল, রাজাকার ছিল। ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে ওরা আমার লোককে হত্যা করেছে। কিছু ধরেছি। আরো কিছু ধরার চেষ্টায় আছি। আপনারা খবর দেবেন তাদের ধরা হবে।
আমি বলেছি, ওমুক তারিখের মধ্যে অস্ত্র জমা দাও। আমার বাংলার মানুষ, যারা আমাকে ভালবাসে, তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে। এখনও দু’চার জন যারা অনেকে নিজেকে মুক্তিবাহিনী বলেন, অথচ তারা মুক্তি বাহিনীর লোক নন, তারা অস্ত্র জমা দেননি। তাঁরা ১৬ তারিখের পরে আচকানডা বদলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছেন। রাতে তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে, মানুষকে খুন করে।
আমি দিয়েছি ১০ কোটি টাকার ঋণ যাতে মানুষ গরু কিনতে পারে এবং হাল চাষ করতে পারে। আমরা তো আল্লাহর মর্জি কম নই, সাড়ে সাত কোটি। ঐ ১০ কোটি, ৫ কোটি টাকা, কিছুই না। কিন্তু দেবো কোত্থেকে আমি? পাবো কোথায়? কার কাছ থেকে আনবো? টাকা আমি পেতে পারি। টাকা আমি আনতে পারি। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ বংশধরকে গোলাম করে সেই পয়সা আমি মানুষের কাছ থেকে আনতে চাই না। আমি চাই না যে আমার ভবিষ্যৎ বংশধর গোলাম হয়ে থাক। যে যা বলুক না কেন, আমি পরিস্কার জানিয়ে দিতে চাই, আমি আপনাদের ধোকা দিতে পারব না। কারণ আমি গদির জন্য রাজনীতি করিনি। আমি মরবার জন্যে রাজনীতি করেছিলাম। আমি আপনাদের ১০০ কোটি টাকার মত রিলিফ দিয়েছি। তবুও আমি বলছি তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না। আপনারা যদি রাজী থাকেন, তবে হাত তুলে দেখিয়ে দেন। হাত তুলুন, দু’হাত তুলুন। (উপস্থিত জনসাধারণ দু’হাত তুলে সায় দিলো) আমি বলছি ইনশাল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনাদের আমি এনে দেব মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু কষ্ট করতে হবে। কষ্টে থাকতে হবে। এই ধ্বংস্তুপকে যদি একবার খাড়া করতে পারি, ইন্শাল্লাহ বাংলাদেশের মানুষ কষ্টে থাকবে না। কিন্তু সময় লাগবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল হয় না।
সবাইকে আজ শুধু কাজ করতে হবে,
শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, কাজ করতে হবে। আর ছাত্র ভাইদেরকে বলি, একটু লেখাপড়া করো। বাবার হোটেলে আর কত কাল খাবে? পয়সা-কড়ি নেই। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে জানি। কিন্তু লেখাপড়া একটু করো। আন্দোলন করো আমার আপত্তি নেই। আমার জন্ম আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তোমাদের একটু মানুষ হতে হবে। মানুষ না হলে দেশ গড়তে আমি পারব না। ভবিষ্যতে তোমাদের এ দেশের শাসনভার হাতে নিতে হবে। চুঙ্গা ফুঁকাও, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মেহেরবানি করে একটু কাজ কর।
কৃষক ভাইয়েরা, চেষ্টা করবো, দুনিয়া থেকে বীজ ও পাম্প এনেছি আপনাদের দেবার জন্য। কিন্তু আপনাদেরকে কাজ করতে হবে। কাজ করে ফসল উৎপাদন করতে হবে। জানেন কত লাখ টন, বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব? আমি কোথা থেকে দেবো? কি করে দেবো? কেমন করে বাঁচাব? আমার ঘুম হয় না। ৪ মাস হলো আমি জেল থেকে এসেছি কিন্তু একা দিন কেমন করে বিশ্রাম করতে হয় আমি তা জানি না। কিন্তু করবো কি? কি করে চালাবো? এই রাজশাহী আসলাম। রাস্তাঘাট নেই। মানুষের খাবার নেই। পানি নেই। বন্যায় সব নষ্ট হয়ে যায়। কি করে আমি চালাবো? আমি তো বুঝতে পারি না। আমি তো পাগল হয়ে যাই। আমি কি করে কি করবো? আমার তো চিন্তায় ঘুম হয় না। ভাইয়েরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ না করলে কিছুই হবে না।
একটা কথা আমি বলে দেবার চাই। একদল লোক এখন বেরিয়েছে, যারা মাঝে মাঝে এটা বলে, ওটা বলে। যখন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছিল তাদের চেহারা দেখা যায় নি। তারা পালিয়ে ইয়াহিয়ার দালালী করেছে। এরা মনে করেছে শেখ মুজিবুর রহমান কিছু বলে না, বড় দয়ালূ লোক। আমি সত্যিই দয়ালু লোক। কিন্তু গরীবকে যদি কেহ শোষণ করে তখন আমি দয়ালু নই।
আর একদল লোক বের হয়েছে। তারাও এটা ওটা বলছে। কোথায় ছিলেন? ঘুমিয়ে ছিলেন আরামে। এখন এ কথা সে কথা বলেন। জীবনে কোন কাজ করতে পারে নি। মরবার আগেও করতে পারবে না। খারী মাঝে মাঝে মানুষের দুঃখ দূর্দশা দেখে হা হা এটা হলো না, এটা হলো না। এসো কাজ কর। তোমাকে মানা করেছে কে? একটা গ্রামে যাও। গ্রামের লোককে পেট ভরে খাবার দাও। আমি তো মানা করছি না। তবু কেন বলো কিছু হলো না। এ কারণেই বলতে হয় মার পোড়ে না, পোড়ে ডাইনীর।
ভাইয়েরা আমার, আমার এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা আর থাকতে পারবে না। আপনারা আমাকে ভালবাসেন আমি জানি। আমি জানি আপনারা আমার কথা রাখবেন। আমার বাঙ্গালী। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙ্গালী। আমরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙ্গালী আমার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা আর পাকিস্তানী নই। আমরা আর কোন দেশের মানুষ নই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আমরা বাঙ্গালী।
সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার মানুষ বাঁচতে পারে না। সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বড় বড় ব্যাংক ছিল। ভূড়ীওয়ালাদের ব্যাংক। আল্লাহ মর্জি ঐ ব্যাংক আমি কেড়ে নিয়েছি। ঐ ব্যাংক এখন আর ভূঁড়ীওয়ালাদের ব্যাংক নয়। ঐ ব্যাংক এখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বীমা কোম্পানি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের। সেই আইন আমি পেশ করে দিয়েছি।
বড় বড় কাপড়ের কল। বড় বড় চট কল। বড় চিনির কল। আমি জাতীয়করণ করে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পত্তি করে দিয়েছি। আপনাদের এর সূফল ভোগ করতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ সম্পত্তি আর ২/৫ জনের নয়। এই সম্পত্তি আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। কোন লোক একশ বিঘার ওপর জমি রাখতে পারবে না। এতে যে জমি উদ্বৃত্ত হবে তা ভূমিহীন গরীবদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। খাসমহলের জমি গরীবকে ছাড়া কাকেও দেওয়া যাবে না।
আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাঁধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামিক টেবলেট দেখিয়ে আমাদেরকে লুটেছে। আপনারা জানেন? খবর রাখেন? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।
বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না
আজ ৪ লাখ লোক পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রয়েছে। আমি বললাম, ওদের ছেড়ে দাও। ভূট্টো সাহেব ছাড়ছেন না। ভূট্টো সাহেব! ছাড়তে হবে। ওদের আমি ইন্শাল্লাহ আনবো বাংলার মাটিতে। ওরা ফিরে আসবে এই মাটিতে। আপনি ত মুজিবুর রহমানকে ছাড়তেন না। আপনি মনে করেছেন আপনার সৈন্যরা আমার মা-বোনের উপর অত্যাচার করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার ছেলেদের হত্যা করেছে, পশুর মত গ্রাম-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আমি তাদের মাফ করে দেবো? আমি যদি বেঁচে থাকি, ভুট্টো সাহেব, এই বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে। কেউ রুখতে পারবে না। আমি কারো কথা শুনবো না। তুমি যতই দুনিয়া ভরে চিৎকার করে বেড়াওনা কেন, যারা আমার মা-বোনের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার দুধের বাচ্চাকে গুলি করে হত্যা করেছে, যারা আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার সেপাই পুলিশকে হত্যা করেছে-এই বাংলার মাটিতে ওদের বিচার হবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকে। মনে করেছো তোমার কথায় ভয় পাই। আমার সাথে খেলবার চেষ্টা করো না। দরকার যদি হয়, আমি আমার বাংলার মানুষকে ডাক দিয়ে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করবো। কিন্তু বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না।
ভাইয়েরা আমার, আমি কিছুই দিতে পারবো না। ধোকা আমি দিই না। ধোকা আমি দিবো না। মিথ্যা ওয়াদা আমি করি না। আমার হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমা হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমার চেয়ে বেশি কোন দেশে কোন নেতা কোনদিন পাননি। সেটা হলো আপনাদের ভালবাসা। যে ভালবাসা আপনারা আমাকে দিয়েছেন। আপনারা আমাকে দোয়া করুন, আমি যেন সেই ভালবাসা নিয়ে মরতে পারি। আমার পাবার মত আর কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীত্ত্ব আমার কাছে কিছুই না। ওটা নিতে আমি বাধ্য হয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন করিনি। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলতে চাইনি। আমি আমার বাংলায় মানুষকে ভালবাসতাম। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমি বাংলার আকাশকে ভালবাসি। আমি বাংলার বাতাসকে ভালবাসি। আমি বাংলার নদ-নদীকে ভালবাসি। আমি বাংলার প্রত্যেক মানুষকে মনে করি আমার ভাই, মাকে মনে করি আমার মা, ছেলেকে মনে করি আমার ছেলে। কিন্তু আমার হাতে ত কিছু নেই। আমার হাতে ত আলাদীনের প্রদীপ নেই। আমি আপনাদেরকে কোথা থেকে এনে দিবো। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। ধ্বংসপ্রায় একটা দেশের মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। একে গড়তে হবে। চাই ত্যাগ ও সাধনা। ত্যাগ এবং সাধনা ছাড়া এদেশকে গড়া যাবে না। সবুর করতে হবে। সহ্য করতে হবে। কাজ করতে হবে। যুবক ভাইয়েরা, তোমরা আমার গরীব ভাইদেরকে লুট করে খাবার চেষ্টা করো না। তোমরা চেষ্টা করো, যাতে ওর সুখ হয়। কিছু কিছু যুবক অস্ত্র নিয়ে রাতের অন্ধকারে ডাকাতি করে। মনে করোনা যে আমরা খবর রাখি না। খবর আমাদের কাছে আসবে ঠিকই। সময় মত আসবে। তোমাদেরকে আমরা ধরে ফেলবো। এমন ধরা ধরবো যেদিন দুনিয়ার আর মুখ দেখাতে পারবে না। তোমরা অনেকে ভদ্র লোকের ছেলে বলে দাবী করো। অনেকে শিক্ষিত বলে দাবী করো। কিন্তু আমি জানি ২/১ টা পিস্তল আছে। বের করে ফেলবো। আপনারা খবর দিবেন থানায় থানায়। খবর দিবেন? (জনতার হাঁ সূচক জবাব) আমিও পুলিশদের বলে দিচ্ছি এই গুন্ডা পান্ডা যদি বন্দুক নিয়ে কোন লোককে আক্রমণ করে, এক মিনিট দেরী করো না। জনগণের সহযোগিতায় এদের ধরবে। আমার হুকুম, গুলি করে এদের নিশ্চিহ্ন করবে। আমি দেশে শান্তি শৃঙ্খলা চাই। আমি চাই, মানুষ আরামে ঘুমাক। পেটে ভাত না থাকলেও আরামে ঘুমাতে হবে। ওরা বন্দুক নিয়ে গ্রামে যায়। একটা গরীবের ঘরে গিয়ে লুটপাট করে নিয়ে আসে। এটা ফ্যাশন হয়ে গেছে? না। ফ্যাশন! মনে করেছ বুঝি আমি খুব দয়ালূ? বেশিদিন দয়ালু থাকবো না ভাই। একবার যদি নেমে পড়ি পিছনে আর ফিরি না। তাই তোমাদের কাছে আবেদন করি, বন্দুকখানা আর ব্যবহার করো না। পানিতে ফেলে দিওনা, আমার কাছে ফেলে দাও। তা না হলে বিপদ আছে। আমার রাজশাহীর ভাইয়েরা, আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। আমার ভাই কামরুজ্জামানের বক্তৃতা করার কথা ছিল। তিনি বক্তৃতা করতে পারলেন না। আপনারা অনেক জায়গা থেকে কষ্ট করে এসেছেন। আর আমি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আগের মত আর বক্তৃতা করতে পারি না। আর যখন আপনাদের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে এক কোটি মানুষের কথা যাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া খাঁ, তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায়। গত চার মাসে এরা ফিরে এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। এই এক কোটি মানুষের ঘরবাড়ি নেই। আর ২ কোটি মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে পশুরা। বলুন তো, আমি কি করে এদের ঘরবাড়ি দেবো? কোথায় পয়সা পাবো? যার ঘর নেই, তার ঘর আপনারা চেষ্টা করে তৈরী করে দেবেন। যার খাবার নেই, নিজে একবেলা খেয়ে তাকে খাবার দেবেন। এটাই হলো মনুষ্যত্ব, এটা হলো মানবতা। এটা হলো ভ্রাতৃত্ব। আমি আশা করি, তাই আপনারা করবেন।
আপনারা গরমের মধ্যে অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় দিচ্ছি। ইন্শাল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। আপনারা শান্তি রক্ষা করুন। এই কামনা করি। আমার কর্তব্য আমি করবো। আপনাদের কর্তব্য আপনারা পালন করুন, জয় বাংলা।
১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার ভাই ও বোনেরা,
আজ ৭ই জুন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ ছয় দফা ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণায় সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানেরর শোষক গোষ্ঠী ক্ষেপে গিয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরাও তাদের বুঝতে পেরেছি। তারা জানতে পেরেছিল, বাঙ্গালীদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই আইয়ুব খান ও মোনেম খান তাঁদের সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমার লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন কারাগারে বন্দী হয়ে যাই।
আপনাদের নিশ্চয়ই আরও মনে আছে, আমাকে যশোরে গ্রেফতার করা হয়, তারপর যশোহর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা থেকে আমাকে সিলেট নেওয়া হয় এবং সেখানেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় এবং ময়মনসিংহেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এমনি করে গ্রেফতারের পালা চলে। সংগে সংগে ৭ই মে তারিখে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, খোন্দকার মুশতাক আহমদ প্রমুখ নেতাও গ্রেফতার হন। পরে আমার সহকর্মী বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, মোল্লা জালাউদ্দীন, মনসুর আলী, মরহুম আব্দুল আজিজ (চট্টগ্রাম) মরহুম আমজাদ হোসেন (যিনি পাবনায় মৃত্যুবরণ করেছেন) এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ পন্থী ছাত্র ও শ্রমিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়।
শুধু তাই নয়। ৭ই জুন তারিখে তেজগাঁ, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়নগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরো অনেক জায়গাতে গুলি করে আমার শত শত ভাই বোনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙ্গালীদের দাবিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই। সেই দিনই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। অনেকে হয়ত বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা জানতাম, এ ব্যাপারে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই জন্যে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হয়।
এরপরে আমি যখন গ্রেফতার হয়ে চলে যাই, আমার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী সভাপতি হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গ্রহণ করেন। তারপর তিনিই আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাঁকেই গ্রেফতার করে জেলে দেওয়া হয়েছে।
তারপরেও ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে তার মধ্য থেকে একদলকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সরিয়ে নিয়ে যান। তাতেও আমাদের দাবাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। আপনাদের সব ইতিহাসই মনে আছে। সেদিনও আপনারা শুনেছেন, অনেক দল আইয়ুব খানের টাকা খেয়ে ছয় দফা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আপনাদের একথাও জানা আছে যে, ৭ই জুন তারিখে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল।
তারপর আসুন ১৯৬৮-৬৯ সালের ঘটনাগুলির কথায়। সে সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনে যোগদান করে এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়। তারপর আইয়ুব খান আগরতলা মামলা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। সেদিনও আমার দেশের বহু লোককে জীবন দিতে হয়েছে। রক্ত আমাদের অনেক দিতে হয়েছে। বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যত রক্ত দিতে হয়েছে, কোন দেশ, কোন জাতি তা দেয় নাই।
আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। লোকে বলে, মানুষের স্মৃতিশক্তি নাকি দূর্বল। সে নাকি অল্প দিনেই সব ভূলে যায়। কিন্তু কেমন করে ভূলবে? ২৩-২৪ বছর আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস সোহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বক্ষণই উজানে আমাদের নৌকা বাইতে হয়েছে এবং বার বার গ্রেফতার হতে হয়েছে; রক্ত দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আজও অম্লান রয়েছে।
নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা
তারপর যখন নির্বাচনে আপনারা আমাকে ভোট দিলেন, তখনও একদল লোক নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করেছিল। আমি বলেছিলাম, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে, যে বাংলার মানুষ এক, বাংলার মানুষ স্বাধীনতা দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রমাণও হয়ে গেল কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। ইয়াহিয়া খান সাহেব এসে গদিতে বসলেন। অর্থাৎ এক খান গেলেন আর এক খান এলেন। ইয়াহিয়া খান এসে শুরু করলেন নির্বাচনের কথা। মিষ্টি কথা, ফিসফিস করা, ছোট ছোট কথা, বড় বড় কথা। আর সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাড়াতে লাগলেন বাংলার বুকে, আমার উপর আঘাত হানার জন্য। আমরা প্রস্তুত হলাম। আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম ৩রা জানুয়ারী তারিখে, যে আদর্শে বাংলার মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে তাতে আপোষ নাই।
আপনারা জানেন ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদ গদ হয়ে যাব আর আমার দাবী ছেড়ে আমি তাঁর সঙ্গে হাত মেলাব। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতে না। তাঁর এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করি নাই। আমি রাজনীতি করেছি বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য, বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা দেবার জন্য, বাংলার মানুষকে শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানেরহাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য। বাংলার মানুষ যাতে মানুষের মত দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে না পারে তারই জন্য আমি সংগ্রাম করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য সংগ্রাম করি নাই।
ভায়েরা আমার,
এরপর অসযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এবং তার পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলবার চেষ্টা করবো। সে সবের আলোচনায় আপনাদের বেশি সময় আজ আমি নেবো না। কারণ, আরও নেক কথা আপনাদের বলতে হবে। জেল থেকে বের হয়ে এখনে এসে আমি সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সেদিন আমি বেশি কিছু বলতে পারি নাই। কারণ, মাঝে মাঝে আমার চোখে পানি এসে গেছে। তারপরে ভারতের মহিয়ষী নারী মিসেস গান্ধী যখন এখানে আসেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আপনাদের সামনে এসেছিলাম এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম। তিনি অতিথি। তাঁর সামনে অন্য কথা বেশি বলা যায় না।
মুক্তি সংগ্রামের সূচনা
আজ দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের জানা দরকার। ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে। ২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া বর্বর বাহিনী আমার উপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাত্রে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো।
রাত্রে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ই,পি,আর বলা হতো,তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়ারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সেনাবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক, যে যেখানে আছে, পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। বাংলাদেশ স্বাধীন। তারা আমার কথা মত খবর পৌঁছিয়েছিল।
সে রাত্রে কেবল আমার বাড়িতে নয়, রাজার বাগ, পিলখানা, আওয়ামী লীগের অফিস আর ছাত্রাবাসেও আক্রমণ চলে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাজারবাগের পুলিশরা ৬ ঘন্টা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন চারটে ব্যাটেলিয়ন ছিল। হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের অর্ধেককে মেরে ফেলা হয়।
এমনি করে সমস্ত বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক কৃষকদের মেরে ফেলা হয়। আমার সহকর্মীরা পালিয়ে মুজিবনগরে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সরকার কায়েম করেন। নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন আর তাজউদ্দীন হন প্রধানমন্ত্রী। মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খোন্দকার মুশতাক আহমদকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়।
দালালদের সমালোচনা
এখন যাঁরা সমালোচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাঁদের কাউকে এসব কাজে দেখা যায় নাই। তাঁদের কেউ যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তাঁরা কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে আবা সকলকে একতাবদ্ধ করে তাঁরা যুদ্ধ শুরু করেন। সারা দুনিয়ায় লোক পাঠিয়ে বাংলাদেশের কথা সবাইকে জানিয়ে দেন। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক পালিয়ে গিয়ে পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তারা স্ত্রী-পুরুষ কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। সারা বাংলায় রাস্তায় রাস্তায় হাজার লাশ। নদীতে লাশ, ঘরে ঘরে লাশ। মানুষের মা-বোনের আর্তনাদ। চারদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ। তবু সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই। তারা বরং ইয়াহিয়া খানের দালালী করেছে।
তারপরের যুদ্ধের ইতিহাস আপনারা জানেন। পাক বাহিনী ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। এক কোটি লোক দেশ ত্যাগ করলো। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল। শ্রমিক আর ছাত্রদের গুলি করে মারা হল। আজ অনেকেই সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন আর এমসিএদের এবং আওয়ামী লীগকে গালি দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ত্যাগের কথা কারও মুখেই শোনা যায় না। আওয়ামী লীগের এমসিএ আমার সহকর্মী মশিহুর রহমনাকে দুই মাস পর্যন্ত মারতে মারতে হত্যা করা হয়েছে। আমার আর একজন এম.সিএ আমীন উদ্দীনকে আধামরা করে জীপের পিছনে বেঁধে দিল, গুরিয়ে গুরিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমার এক চাচাকে ছয় টুকরো করে রাস্তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। সৈয়দপুরের এম,সি,এ নজমুল হুদা সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুই ভাগ করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন যাঁরা বড় বড় কথা বলেন, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন? সবাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। কিন্তু এ কি চোরাকারবারীর স্বাধীনতা, মুনাফাখোরের আর মজুতদারের স্বাধীনতা? রাজাকারের আর আলদবরের স্বাধীনতা? আমি কিছু বলি না। এজন্য তারা ভেবেছে আমি নরম মানুষ। আমি নরম মানুষ নই। আমি তাদের খেলতে দিয়েছিলাম।
আমাকে আপনারা জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য আসি নাই। আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভালবাসি। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী আমাকে ভালবাসে। জীবনে কখনও আমি তাদের সাথে বেঈমানী করি নাই। চার বার আমাকে ফাঁসী দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবু আমি মাথা নত করি নাই। তা সত্ত্বেও কেন এত কথা বলা হয়?
যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি
জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে উড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙ্গালী। আজ আমি বলতে পারি, বাঙ্গালী একটি জাতি। আমি আজ বলতে পারি, বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই। আপনারা আমাকে সব দিয়েছেন। আপনারাতো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ত্বতো আমার জন্য বড় জিনিস নয়। যা কোনদিন কোন মানুষ পায় নি, তা আমি পেয়েছি। আপনারা যা দিয়েছেন, সে হল আপনাদের ভালবাসা। আমাকে আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন আপনাদের ভালবাসা দিয়ে মরতে পারি। এর বেশি কিছুই আমি চাই না।
জেল থেকে বের হয়ে এসে আমি দেখেছিলাম রেলওয়ে ভেঙ্গে গেছে, চালের গুদাম নাই, দোকানে মাল নাই। ব্যাংকের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। আমি আরও দেখেছিলাম মানুষের কাছের বন্ধুকে। আমার দেশের লোক আমাকে ভালবাসে। তাই আমার সহকর্মীরা বললেন, তোমাকেই তো, সবকিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমার বাংলার স্বীকৃতি দরকার। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবেদন জানালাম, তোমাদের অস্ত্র ফেরত দাও। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে আমার বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা দুই লক্ষ অস্ত্র আমার হাতে দিয়েছে। অস্ত্র সমর্পণের এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর দেখা যায় না।
আমাদের গুদামে চাল নাই। পকেটে পয়সা নাই। পোর্ট ভেঙ্গে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ী চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পোর্টের মুখে সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাবো কি করে? দস্যুর দল মানুস হত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ আজ একদল লোক এসবের জন্য ভারতকে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এক কোটি লোককে মিসেস গান্ধী খাবার দিয়েছিলেন, কাপড় দিয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। এসব কি তারা দেখে আসে নাই?
খাদ্য ও ত্রাণ
আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট বৃটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ আমার দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রকে বন্ধু বলতে লজ্জা করা উচিত নয়। যেদিন আমার সরকার ক্ষমতায় আসে, সেদিন এক ছটাক চাল ছিল না। আমি তাই ভারতের কাছে চাল চাই। ভারত তখন আমাদের সাড়ে সাত লক্ষ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে আমি এক কোটি বাষট্টি লক্ষ মন চাল পেয়েছি। এই চাল গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনলোডও চাল দিয়েছে। রাশিয়াও আমাকে সাহায্য করেছে। রাশিয়া আমার বন্দর সাফ করে না দিলে আমি খাবার আনতে পারতাম না। আমার বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু এ বন্ধুত্ব নষ্ট করার ক্ষমতা কারও নাই।
বাংলার মানুষকে আমি জানি। আমাকেও বাংলার মানুষ চেনে। বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি। বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমি তাদের জন্য কোন কাজে হাত দিয়ে কখনও হাল ছাড়ি না। আপনাদের কাছে আমি প্রথম দিন বলেছি, তিন বছর আপনাদের কিছুই দিতে পারবো না। পরে সারা বাংলাদেশেই আমি এই কথা বলেছি। কিন্তু পারবো না বললেও আমি দিয়েছি। রিলিফের জন্য, ঘর-বাড়ি তৈরির করার জন্য এই ছয় মাসে উনত্রিশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টেস্ট রিলিফের জন্য গ্রাম অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। স্কুল-কলেজের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিলিফ ক্যাম্পের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মোট ৭৫ কোটি টাকা এই ছয় মাসে দেওয়া হয়েছে। রিলিফ, কৃষি ঋণ এবং সমবায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এছাড়া যত বকেয়া খাজনা ছিল সব মাফ করে দিয়েছি। একদিন এই ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেব। তা আমি দিয়েছি। আমাদের বন্দর ঠিক হয়ে গেছে। এখন বিদেশ থেকে মাল আসতে পারবে, আমার তেল ছিল না, ভারতে তেল দিয়েছে। আমাকে সব জিনিসই অন্যের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তো কলোনী ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার ছিল। পশ্চিমমারা সেখানে মাল তৈরী করতো আর বাংলাদেশ সেই মাল বেঁচে পকেটে টাকা নিয়ে উড়ে চলে যেত। আজ জিনিসপত্রের ঘাটতি পড়েছে। সব জিনিসই আমাকে বাইরে থেকে আনতে হবে।
শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি
আমার শ্রমিক ভায়েরা, কৃষক ভাইদের জন্য আমি টেস্ট রিলিফ দিচ্ছি, বিনাশর্তে ঋণ দিচ্ছি, খাজনা মাফ করেছি। এই সঙ্গে আমি ব্যাংক জাতীয়করণ করেছি। বড় বড় শিল্প কারখানা আর ইন্সিওরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণ করেছি। এসব জাতীয়করণের অর্থ আমাদের বুঝে দেখতে হবে। এগুলি সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পদ। শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবী জানিয়েছেন। এগুলি জাতীয়করণের অর্থ হল শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সমস্ত কল-কারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কারখানা চালাতে ও গর্ভনমেন্টের একশ আটান্ন কোটি টাকা দিতে হয়েছে।
যদি কারখানা চালিয়ে উৎপাদন না করতে পারেন, আমি বেতন বাড়াবো কোথা থেকে? আপনারা আমার কাছে চান নাই, আমার কাছে দাবী করার দরকারও নাই। আমি আপনাদের জন্য জীবন ভর দাবী করেছি। আমার কাছে আপনারা কি দাবী করবেন? আপনারা না বললেও আমি ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। তাতেও ৩৫ কোটি টাকা বেতন বাড়াতে হয়েছে। আপনারা যদি উৎপাদন না করেন, আমি টাকা দেব কোথা থেকে? আমি কি তবে বাংলাদেশটা বিক্রি করে দেব? না বাংলাদেশকে বিক্রি করতে পারবো না। আমাকে সমালোচনা করে বলা হয়েছে, আমি ধর্মঘট কেন বন্ধ করলাম? কিন্তু আমি তো ধর্মঘট বন্ধ করতে চাই নাই। তবে, আমি যদি শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য টংগিতে টাকা পাঠাই বা রিলিফের টাকা দিই আর সেখানে সেই টাকা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারপর আবার যদি কেউ বেতন নিতে আসে তাহলে সেটা কি ভালো হয়? শ্রমিকদের কর্তব্য হলো উৎপাদন করা।
ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন
আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘোষনা করেছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়তকরণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলির প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুইজন করে সদস্য থাকবে এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এ ছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যাই আয় হোক না কেন, আমদজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না। কোথায় যাবে, তা আপনারা জানতে পারবেন। আপনারা হলেন শতকরা একজন বা দেড়জন আর বাংলার কৃষক হলো শতকরা ৮৫ জন। আয়ের একটা অংশ আপনারা নেবেন। আর বাকী অংশ দেশের কৃষকদের। তাদের টাকা দিয়ে শিল্প-কারখানা চালানো হয়। তাদেরও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। শ্রমিক ভায়েরা, দুধ খান, গরু জবাই করে খেয়ে ফেলবেন না। তাতে দেশ চলবে না। আর লাল বাহিনীর ভায়েরা, আপনারা হবেন আদর্শ কর্মী। আপনাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। আর আপনাদের দেখাতে হবে যে, ৮ ঘন্টার জায়গায় লাল বাহিনীর ছেলেরা ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করে এবং এই কাজ দেখিয়ে অন্য শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হবে। আপনারা ১০ ঘন্টা না পারেন ৯ ঘন্টা কাজ করেন বা ৮ ঘন্টা করুন। উৎপাদন বাড়ান্ তাহলেই লাল বাহিনী আপনাদের ইজ্জত থাকবে। লাল টুপি মাথায় দিয়ে বেড়ালে লাল বাহিনীর ইজ্জত পাওয়া যাবে না।
সমাজবিরোধী কার্যকলাপ
ভায়েরা আমার, আজ আপনাদের বেতন বাড়ালেই সুবিধা হবে না। সেই জন্য বাংলাদেশে ৪২০০ দোকান খোলা হচ্ছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে ন্যায্য মূল্য জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য শ্রমিক এলাকায়ও এ ধরনের দোকান খোলা হবে। তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। তবে মজুতদার, চোরাকারবারী আর চোরাচালানীরা হুঁশিয়ার হয়ে যাও। তাদের আমি সোজা কথায় বলে দিচ্ছি, পাঁচ মাস আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করছি, বুঝিয়েছি, অনেক করে বলেছি, একাজ করো না। আমার বিশ্বাস ছিলো যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখছি চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। তাই তাদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ী দখলকরে আছ যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করছো, জিনিসপত্র বিক্রয় করছো না, জিনিষের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছো, তাদের রেহাই নাই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরীব দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই। আমি ১৫ দিন সময় দিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকারী বাড়ি না ছাড়ো, যদি মজুদ করে রাখো এক একটা এলাকায় আমি কারফিউ দেব আর সমস্ত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে তল্লাশী চালাবেন। এতদিন আমি কিছু বলি নাই। এখন বলে দিলাম, হুকুম দিয়ে দিলাম। এর পরেও বড় বড় বক্তৃতা করবে আর রাত্রি বেলায় চোরা গাড়ীতে চড়বে, এটা হবে না। আমার লাশ থাকতে নয়। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও। আর ঘুঘু খাওয়ার চেষ্টা করো না। আমি পেটের মধ্যে হতে ধান বের করব। চিন্তার কারণ নাই।
এম সি এ দের সমালোচনা
ভায়েরা আমার, আর একটা কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। আওয়ামী লীগ ২৩ বছর এই বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। এখন কিছু লোক আওয়ামী লীগের এমসিএ দের নিন্দা করে। কিন্তু ২৩ জন এমসিএ কে বহিস্কার করেছে কোন পার্টি? এমন বহিস্কারের নজির পৃথিবীর আর কোন দেশের ইতিহাসে আছে? যদি কোন এম.সি.এ বা পার্টি সে যে পার্টিরই হোক না কেন, কিংবা কোন শ্রমিক নেতা বা ছাত্র নেতা চুরি করে, তাহলে আমি মাফ করবো না।
এখন এম.সি.এ দের সমালোচনা করার অর্থ কি? যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরা ভাবেন, আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো। তাঁরা যদি এম.সি.এর দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাহলে নিজেরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করবেন। কিন্তু সব এম.সি.এ ই কি চোর? কোন এম.সিএ কি যুদ্ধ করেন নাই? তারা কি গুলি খেয়ে মরে নাই? এম.সি.এ দের মধ্যে ভাল মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে সব দলেই ভালমন্দ মানুষ আছে। যারা খারাপ, তারা সব সময়ই খারাপ। আমার দলের মধ্যে কেউ যদি চুরি করে, বিশ্বাস লাগতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়, আমি জানি। তার পরিষদ সদস্যপদ আমি কেড়ে নেব। কিন্তু এম,সি,এ দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা খারাপ। তাঁরা গণপরিষদের সদস্য। তাঁরা নির্র্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, তাঁরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। আমি বাংলাদেশে শাসনতন্ত্র দিতে চাই, ইয়াহিয়া খান বা আইয়ুব খানের মতো গভর্নমেন্ট চালাতে চাই না। জনগণকে আমি ভয় করি না। জনগণকে আমি ভালবাসি। সে জন্য শাসনতন্ত্র যত শীঘ্র হয় আমি দেব।
জাতীয় আদর্শ
এখন আমাদের একটা শ্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪ টা স্তম্ভ। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙ্গালী, জাতি এ নিয়ে হল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ।
দ্বিতীয় স্তম্ভ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না। এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তাঁর অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বন্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলার কৃষক, মজুর, বাংলার বুদ্ধিজীবি, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।
কিন্তু সমাজতন্ত্রে যেখানে আছে সে দেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই না। দরকার হলে আবার ভোটে যাব। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।
চতুর্থত ঃ বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হল চার দফা, চার স্তম্ভ।
পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালী
আর একটা কথা বলি। ভুট্টো সাহেব নারাজ হয়ে গেছেন। তিনি আবোল তাবোল বকছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলি বিকুলি করছেন। আমি বলেছি, বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিন। তারপর এসব বিবেচনা করে দেখবো। তিনি এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন। তিনি একটু ভয় পেয়ে গেছেন নাকি? যারা আমার মা বোনের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা পশুর মত আমার জনসাধারণকে হত্যা করেছে, যারা নিরপরাধ কৃষক শ্রমিক ছাত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করলে নাকি তিনি বড় অসন্তষ্ট হবেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব, শুনে রাখুন। তাদের বিচার বাংলার বুকে অবশ্যই হবে।
ভুট্টো সাহেব আমার চার লক্ষ বাঙ্গালীকে আটক রেখেছেন। তারা নিরপরাধ, কিছুই করে নাই। তবু তিনি দরকষাকী করছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি আমার বাঙ্গালীদের ইন্শাল্লাহ বাংলার বুকে ফেরত আনবো। তিনি ঠিকাতে পারবেন না।
তবে, একটা অনুরোধ করবো আপনাদের কাছে। যে সমস্ত বাঙ্গালী এখানে আছে, যারা আলবদর, রাজাকার নয়, যারা বাংলার মাটিতে বাঙ্গালী হিসেবে বাস করতে চায়, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, তাদের বাংলায় থাকবার অধিকার রয়েছে। যারা যেতে চায়, ভূট্টো সাহেব যেন মেহেরবানী করে তাদের নিয়ে যান। আমার আপত্তি নাই। তিনি বলেছেন, তিনি তাদের নেবেন না। কেন নেবেন না? তাদের হাতে তো বন্দুক তাঁরাই দিয়েছিলেন। তাঁদেরতো ব্যবহার করেছিলেন। তাদের দিয়ে বাঙ্গালীদের হত্যা করিয়েছিলেন। এখন কেন নেবেন না? যারা যেতে চায়, তাদের নিয়ে যান। আমি ছেড়ে দেব। আমার চার লক্ষ লোক ফেরত দিন। ভুট্টো সাহেব যেন একথা মনে না করেন যে, বাংলাদেশে শুধু বিহারী আছে। পশ্চিম পাকিস্তানেরও অনেকে আমার কাছে। ভূট্টো সাহেব আমার লোক ফেরত দিন, আমিও তাদের লোক ফেরত দিচ্ছি। যুদ্ধবন্দীর সঙ্গে জনসাধারণ কোন দিন এক হতে পারে না। এমন নজীর দুনিয়ায় নাই, কোনদিন হয় নাই।
একদল লোক দুনিয়ায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিহারীরা বড় কষ্টে আছে। যখন আমার বোন না খেয়ে মরছিল তখন গুলি করে মারছিল, যখন এদেশের মানুষকে ধরে ধরে কুর্মিটোলায় গুলি করেছিল, যখন জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন কেন মেহেরবানী করে তাঁর প্রতিবাদ করেন নাই? এখন কেন তাঁরা কেঁদেকেটে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছেন।
ত্রাণ বিদেশী সাহায্য
আমার বাংলার এক কোটি লোক পশ্চিম বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ছ’মাসে ফিরে এসেছে। তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের খাবার দিতে হয়। আমার বাংলাদেশের দেড় কোটি লোক এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, ওগ্রাম থেকে এ গ্রামে পালিয়ে বেড়াত। তাদের জন্য কেউ মায়াকান্না কাঁদে নাই। গ্রামে যান। দেখে আসুন, আমার মানুষ না খেয়ে আছে। আমার মানুষের কাপড় নাই। আমার কৃষকের বীজ নাই। আমার মানুষের চাল নাই।
আমি ত পরিস্কার বলেছি, দুনিয়ার সমস্ত দেশ থেকে আমি সাহায্য নিতে রাজী আছি। কিন্তু সে সাহায্য হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কারো কাছ থেকে আমি ভিক্ষা আনতে পারবো না। শর্ত ছাড়া যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে চায়, দুনিয়ার যে কোন দেশ থেকে সাহায্য নিতে আমি রাজি আছি। তবে এমন কিছু আনতে চাই না, যা ভবিষ্যতে আমার অসুবিধা হতে পারে। সে জন্য আমি একটু আস্তে আস্তে চলি।
শিল্পের উৎপাদন
শ্রমিক ভায়েরা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা উৎপাদন করো। আল্লাহর ওয়াস্তে মিল খেয়ে ফেলো না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তোমাদের আমি দিয়েছি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবার জন্য। অনেক মিল বন্ধ তবু মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালবাসী, এই জন্যই তো আমি বিনা কথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বৎসর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইন্শাল্লাহ, একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায় তাহলে আর কোন কষ্ট হবে না। শ্রমিকরা সমস্ত মানুষের সংগে সমানভাবে দেশের সম্পদ ভাগ করে খেতে পারবে। কিন্তু চার সের দুধ হলে তার এক সের খাবে। বাকী তিন সের গ্রামের সমস্ত লোককে দেবে। চার সেরই যেন নিজেরা না খায়। তাহলে গ্রামের লোক বাঁচবে না। গ্রামে থাকে কারা? আপনারা আমার বাবা-মা। যারা গ্রামে বাস করে, তারাই কৃষক। তাদের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। তাদের আমি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত খাজনা মাফ করেছি। তাদের আমি ঋণ দিচ্ছি। দরকার হলে আরো দেব। আমি চাই, তারা খাদ্য উৎপাদন করুক। আমি বেশি দিন ভিক্ষা করতে পারবো না। আমার ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের দরকার। ১৭ লক্ষ টন আমি পেয়েছি। আরও ১০ লক্ষ টন ইন্শাল্লাহ আমি পাবো। খাদ্য সামগ্রীর অভাব হবে না।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার একটু কমের দিকে আসছে। আমাদের অনেক খবরের কাগজ যেগুলি দাম বাড়তে দেখলে লাফ দিয়ে কেবল বাড়ায়। যখন কমে তখন আর মেহেরবানী করে কিছু লেখে না। তারা যেন দাম কমলে একটু লেখে। আমার তো ছোট চাদরের অবস্থা। মাথায় দিলে পা খালি, পায়ে দিলে বুক খালি। চল আনতে ডাল আসে না, ডাল আনলে নুন আসে না। নুন আনলে তেল আসে না, তেল থাকলে লবণ থাকে না। আনতে হয় চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে, চালনা পোর্ট থেকে।
ভায়েরা আমার, আমি জানতে চাই, আপনাদের আমার উপর আস্থা আছে কি নাই? আওয়ামী লীগের উপর আস্থা আছে কি নাই? বাংলাদেশকে গড়বেন কি গড়বেন না? তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। দাবী দাওয়া আমার কাছে চলবে না। একদল লোক বলছে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে সুখী করতে চায়। বাংলাকে সোনার বাংলা করেত চায়। লোকে বলে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। মুজিবুর রহমান সব ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি কেন সব ছাড়বো?
আজ মুনাফাখোর, আড়ৎদার, চোরাকারবারী সাবধান হয়ে যাও। ভবিষ্যতে যদি জিনিসের দাম আর বাড়ে, আমি তোমাদের শেষ করে দেব কারফিউ করে। আর দরকার যদি হয়, আইন পাশ করবো। যদি চোরা কারবারী বা আড়ৎদার আমার কথা না শোনে, তাদের ছাড়বো না। আর যারা অস্ত্র নিয়ে চলে, তারা সোজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাশ করবো তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোররা নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গুন্ডা, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও।
কর্মী ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে তোমরা পাহারা দাও, যাতে চোর, গুন্ডা, বদমাইশ মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে।
আর যারা শুধু সমালোচনা করে বক্তৃতা করে, তাদের কাছে অনুরোধ করি, গ্রামে গিয়ে একটু কাজ করুন, একটু রিলিফের কাজ করুন। তাতে ফল হবে।
আমি এবার তাহেল চলি। খোদা হাফেজ।
সংগ্রহ-সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ২৬ জুন নোয়াখালীর মাইজদিতে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা,
আপনারা অনেক কষ্ট করে অনেক দূর থেকে এসেছেন। আপনাদের আমি কষ্ট দিতে চাইনা, বেশী সময় আমি বিরক্ত করতে চাইনা। জেলের থেকে বের হয়ে আসার পরে ভেরেছিলাম আপনাদের কাছে তাড়াতাড়ি আসব কিন্তু আসতে পারি নাই, আমি জানি, আমি যখন জেলের মধ্যে বন্দু ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানে, আমি জানি যখন আমি দিন গুনছিলাম কবে আমার ফাঁসি হবে। আমি জানতাম, আপনারা আমার মা-বোনেরা-ভাইয়েরা বাংলার গ্রামে গ্রামে রোজা রাখতেন, দোয়া করতেন এবং এই পিচাশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছিলেন। আপনারা যে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনি আমার দেশের কি সর্বনাশ করেছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথের ভিখারী করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার কোটি ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমার জমির ক্ষেতের ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আমার রেলরাইন ভেঙ্গে দিয়েছে। আমার ফ্যাক্টরী কারখানা নষ্ট করেছে। আমার ছেলেদের কাপুরুষের মতো ঘরের থেকে ধরে নিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটেছে। তারা বলে মুসলমান, তারা বলে মানুষ। তারা বলতেন আমরা মুসলমান। এত বড় নরপশু দুনিয়ার কোথাও পয়দা হয় নাই। আপনাদের মনে আছে যেদিন আমাকে গ্রেপতার করে নিয়ে যায় সেইদিন আমি বলে গিয়েছিলাম- বাংলাদেশের মানুষ, আমি জানিনা তোমাদের কাছে আর কথা বলতে পারব কিনা? হতে পারে এই আমার শেষ। হতে পারে ওরা আমাকে হত্যা কবরবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ কর। আমার পুলিশ, আমার ইপিআর, আমার সৈন্য বাহিনী, আমার সরকারী কর্মচারী, আমার শ্রমিক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার ছাত্র....। লক্ষ লক্ষ মায়ের বুক খালি হয়ে গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ ছেলে আজ হাত পা কাটা, লক্ষ লক্ষ সংসার আজ ছাড়খার হয়ে গেছে।
কি পেয়েছি? আমি যেদিন জেলের থেকে বের হয়ে আসলাম। আমি যখন রেসকোর্স ময়দানে খাড়া হলাম, আমি যখন বাংলার মাটি পাড়া দিলাম। আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। অনেক রাত আমি ঘুমাই নাই। অনেক দিন আমি বসে বসে কাটিয়েছি। যে দিন থেকে এসে আমি বাংলায় নেমেছি। তার পরের থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই। কি করব? আমার পোর্ট নাই। পোর্ট ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। আমার গুদামের চাউল লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার কাগজ পত্র পর্যন্ত অফিসের জ্বালিয়ে দিয়েছে এমনকি নোটগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। বাংলার সোনা লুট করে নিয়ে গেছে। বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে।
ভাইয়েরা আমার, ইনশাল্লাহ ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? আজ বাংলার মানুষ না খাওয়া, আমি জানি। আমি জানি আজ বাংলার মানুষ দুঃখী, আমি জানি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খায়না, আমি জানি বাংলার মানুষের ঘর নাই। এক কোটি লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে স্থান নিয়েছিল। দেশ ত্যাগ করে গিয়েছিল। এক কোটি লোক এসেছে। কোথায় আমি খাবা পাব? কোথায় আমি টিন পাব? কোথায় আমি পয়সা পাব? কোথায় বাংলার মানুষকে পেটভরে খাবার দিব। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন চিন্তা করেছি কি করব? কিন্তু জানি আমার বাংলার মানুষ দুঃখী। আমি দেখলাম যে সব গেছে কিন্তু বাংলার মানুষ, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, বাংলার নিঃস্বার্থ কর্মীকে হত্যা করতে পারে নাই। ইন্শাল্লাহ সোনার বাংলা একদিন সোনার বাংলা হবে। এ দেশের মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে।
জালেম আমার সম্পদ নিতে পারে। জালেম আমার টাকা নিতে পারে, জালেম আমার ঈমান নিতে পারে নাই, জালেম আমার মাটি নিতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ যদি বাংলার মানুষ সৎ পথে থাকে, ভালভাবে কাজ করে। ইমানদারির সঙ্গে কাজ করে। আমি বিশ্বাস করি সোনার বাংলার মানুষ আবার সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবে এই বিশ্বাস আমার আছে।
ভাইয়েরা আমার, আমি দেখলাম কি শতকরা ৬০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে। নোয়াখালীর ভাইয়েরা আমার এখনও আমার পাষন্ডের দল ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেও শান্তি পায় নাই। আমার চার লক্ষ বাঙ্গালীকে পশ্চিম পাকিস্তানে আটিকিয়ে রেখেছে। ভুট্টো সাহেব তাদেরকে দিবেন না। ভুট্টো সাহেব তাদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। ভুট্টো সাহেব তাদের ছাড়বেন না। ভুট্টো সাহেব মনে করেছেন যে বাংলার মানুষকে আটকিয়ে রেখে তিনি আমাদের মাথা নত করাবেন। যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, সে জাতি কারো কাচে মাথা নত করতে জানেনা। ভূট্টো সাহেব, আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচায়া রাখে ভুট্টো সাহেব, বাংলার মানুষকে আমি বাংলায় ফিরিয়ে আনব- আপনি রাখতে পারবেন না। আপনি মনে করেছেন তাদের আটকিয়ে রাখলে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের আমি বিচার করব না। যারা আমার দুই লক্ষ মা বোনের উপর পাষবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার ছেলেদের নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। যারা আমার গরীবের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। যারা আমার মা বোনকে পথের ভিখারী করেছে তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে যদি আমি বেঁচে থাকি।
ভুট্টো সাহেব, আপনি জানেন মৃত্যুকে আমি ভয় করিনা। মেশিন গানের সামনে আমি বুক পেতে দাঁড়াতে পারি। আপনি জানেন ফাঁসির জন্য আমার কবর খুঁড়ে ছিলেন কিন্তু আমি মাথা নত করি নাই। এই জন্য আমার বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে।
ভুট্টো সাহেব, অবশ্য এখনও বাংলাদেশকে তিনি মানেন না। বাংলাদেশ বলে স্বাধীন না। দুনিয়ার ৭৫টা দেশ মেনেছে। দুনিয়ার জাতিসংঘের অনেক কমিটির আমি সদস্য হয়েছি। উনি বাংলাদেশকে মানেন না। আমি তোমাদের মানি কিনা সেইটাই বড় কথা, তুমি আমারে মানা না মানার কথা পরে।
আমার দেশ বাংলাদেশ, আমার স্বাধীনতা থাকবে, আমার পতাকা থাকবে। আমার বাংলাদেশের মানুষ, তোমাদের গোলামী আর কোনদিন আমরা করতে পারব না। সুখে থাক, সুখে, আরামে থাক আর্শিবাদ করি। পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর, আল্লাহর কাছে মাপ চাও, যা করেছ আর যা নিয়েছ ভদ্রলোকের মতো হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে গেছ। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ আমার বাংলা থেকে লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়া গেছ। এখন বড় বড় কথা বলে, ওনারা বলে মুসলমান, ওনারা বলে ইসলামের কথা বলেন। ঘরে ঘরে মদ খাইয়া পইড়া থাকেন আর ইসলাম ইসলাম করেন। বাংলাদেশে আমি মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি বন্ধ করতে পার নাই। তুমি পারবা না।
আমার নাই কিছু। আপনাদের আমি কিছু দিবার পারব না। দেব কোত্থেকে। হ্যাঁ একথা সত্যি, আপনাদের যত বকেয়া খাজনা ছিল সব আমি মাফ করে দিয়েছি-দেই নাই? আপনাদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাপ হইয়া গেছে। আমি কইরা দিয়েছি। আপনাদের গ্রামে গ্রামে টাকা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের লবণের খাজনা মাপ কইরা দেয়া হয়েছে। আমি পাব কোথায়? আমি দেব কোত্থেকে? আমি তো মাইনষের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে পয়সা আনতে পারি না। কোটি কোটি মন খাবার আমার আনতে হচ্ছে। আরেকটা অসুবিধা হয়ে গেছে, আমি ভিক্ষা টিক্কা কইরে আনি, গ্রামে গ্রামে পাঠাই, ডাকাত দল এগুলো চাইটা চাইটা খায়। চুরি করে খায়। আমি সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার গরীবের হক কেউ মাইরা খাবানা। আমি গরীবের জন্য, গরীব আমার জন্য। বাংলাদেশে গরীব কৃষকের রাজ্য কায়েম হবে। বাংলাদেশে গরীবের রাজ্য কায়েম হবে। শোষণের রাজ্য কায়েম হবে না। ভাইয়েরা আমার, ঘুষ দূর্নীতি খাওয়া বন্ধ কর। ঘুষ খাওয়া বন্ধ কর। গরীবের রক্ত চোষা বন্ধ কর। না হলে ভাল হবে না। তোমরা আমাকে চেন। আজকে ২২ তারিখ, বড় বড় গাড়ী দখল করেছে জায়গায়। আজ ২২ তারিখ ৪টা বাজে। এই চারটার পর থেকে বড় বড় শহরে এ্যাকশন নেয়া হবে। যাদের বাড়ী ঘর লুট হবে। তাদের বাড়ী ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে। যাদের গুদামে চাল রেখে চালের দাম বাড়ায়ে গরীবকে লুট করে খাবার চায়, সাবধান হয়ে যাও। আইন আমি পাশ করছি। আইন আমার প্রক্রিয়ায় আছে। দরকার হয় এমন আইন করব যে প্রকাশ্য জায়গায় গুলি করে মারা হবে-কেউ খবর পাবে না। কিন্তু গরীবকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না।
ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, একদল লোক আছে, রাস্তায় বের হইছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে নাই। ইয়াহিয়া খানের দালালী করেছে, আইয়ুব খানের দালালী করেছেন, এখন আমি গণতন্ত্র দিয়েছি ওনারা কথা বলতে শুরু করেছেন। খুট খাট, পুসপাস,ফুসফাস করেন। একটু আস্তে আস্তে কর, ছিলা কোথায় চাঁনরা, করেছিলা কি চাঁনরা-দালালী করেছ? ইয়াহিয়া খানের? ঈয়সা খেয়েছ আইয়ুব খানের, পয়সা খেয়েছ ইস্কান্দার মির্জার। যখন জীবনের দশটি এগারটি বৎসর আমি জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি, আমার সহকর্মীদের জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে তখন তোমরা বসে বসে কোরমা পোলাও খেয়েছ। এখন সুযোগ পাইয়া এটা করল না, ওটা করল না। কোত্থেকে আসবে? করব কোত্থেকে? কাজ করতে হবে। ফসল উৎপাদন করতে হবে। কারখানায় কাজ করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলেইতো পয়সা আসবে। তাহলেইতো মানুষকে কাজ দিতে মিথ্যা পারব। তা না হলে পারব কোত্থেকে? বাজে কথা বললে চলবে না, আমি মিথ্যা কথা বলিনা। রেসকোর্স ময়দানে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আমি তোমাদের কি দিয়েছি? প্রায় ১০০ কোটি টাকার মত রিলিফ এই বাংলাদেশে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ২৬ কোটি টাকার ট্যাক্স ফ্রি দেয়া হয়েছে। খাজনা, ট্যাক্স মাফ করা হয়েছে।
আপনারা জানেন কোটি কোটি মন চাল আনতে হচ্ছে আমাকে গ্রামে গ্রামে পৌছানোর জন্য। কোটি কোটি মন চাউল-ট্রাক নাই, বাস নাই, রেলওয়ে নাই, পুল ভাঙ্গা ছিল। দুনিয়া থেকে চাল কিনব, চিটাগাং পোর্টে আনব। সেখান থেকে গ্রামে পৌঁছাইয়া দিব। অন্ততপক্ষে প্রত্যেকটা গ্রামে গ্রামে কিছু কিছু খাবার আপনাদের জন্য আমি পৌঁছায়াছি এই ভাঙ্গা হাতে। কিন্তু নাই কিছু। আমি কিছু দেবার পারব না, আমি মিথ্যা ধোকা আপনাদের দেইনা। কোনদিন দেইনি, কোনদিন দেব না। তিন বৎসর আমি আপনাদের কিছুই দেবার পারব না, আপনারা রাজী আছেন কিনা আমি জানতে চাই? তার মানে আমি দেবনা এটা ঠিক না। আমি যেখান থেকে পারি, ভিক্ষা কইরা আইনা বাংলার গরীবের সামনে আমি হাজির করার চেষ্টা করব। কিন্তু গরীবের খেয়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু একটা কথা নাকে খৎ দিয়া দুনিয়ার কাছ থেকে আমি আনতে পারব না। সত্য কথা ভারতবর্ষ আমারে দুই তিন কোটি মন খাবার দিয়েছে। আনলোড ইউনাইটেড ন্যাশন থেকে আমি ছয় লক্ষ টন খাবার পাচ্ছি। তার মধ্যে ইউএসএ চার লক্ষ টন দিয়েছে। রাশিয়া আমার বন্ধু, তারা আমাকে দিচ্ছে। অষ্ট্রেলিয়া ক্যানাডা সেখান থেকে আমি আনছি। বার্মা থেকে চাল আমি কিনছি, জাভা থেকে চাল আমি কিনতেছি। কিন্তু জাহাজ নাই। জাহাজ ভাড়া কইরা আনতে হবে। চট্টগ্রামে পৌঁছবে, ট্রাক লাগবে, রেল লাইন ইঞ্জিন নাই, পাঠাতে হবে নোয়াখালী, পাঠাতে হবে গ্রামে, সময় লাগবে ভাই, সময় লাগবে। মিথ্যা ধোকা দেবার পারবনা। আমি কাউকে ধোকা দেইনা।
তবে বাংলার যে সম্পদ, এই সম্পদ আপনাদের। যেখান থেকে আয় করি না কেন, যেখান থেকে আনি না কেন, সে সম্পদ বাংলার গরীবের জন্য আনা হবে। স্কুল-কলেজ হয়ে গেছে। তার জন্যে টাকা দিতে হবে। এছাড়াও গরীব কর্মচারী যারা না খেয়ে কষ্ট পেত, তাদের আমি মাসে ২৫ টাকা, ২০ টাকা, ১৫ টাকা বেতন বাড়ায়া দিছি। তাতে আমার দিতে হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। কোথায় পাব? কোন জায়গা থেকে আসবে? কিভাবে দেব? বিশ্বাস করেন ভাইয়েরা আমার, আমি রাত্রে ঘুমাতে পারিনা, আমি চিন্তা করতে পারি না জেল থেকে যেদিন আমি পশ্চিম পাকিস্তানথেকে আসছি, তারপরের থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই। আমার পক্ষে দিনের আরাম, রাতের বিশ্রাম হারাম হয়ে গেছে। আমি আপনাদের দিতে চাইতে পারি না। আমি দেখলে আমার বুক ফেটে যায়। আমি আসতেছিলাম। প্লেন আসেনা। আমি রাস্তার উপর প্লেন থামাইছি। প্লেন থামছে, আসতে পারে না। গ্রামের লোক দাঁড়াইয়া রইছে বাবা তোমারে একটু দেখব ও তোমার কাছে কিছু চাই না, তোমারে দেখব। আপনারা আমারে দোয়া কইরেন, আপনারা যেভাবে আমাকে ভালবাসেন, আমি যেন আপনাদের এই ভালবাসা নিয়া মরতে পারি। এর বেশি কিছু আমি আপনাদের কাছে চাই না। আপনারা আমাকে ভালবাসেন, আমিও আপনাদের ভালোবাসি। মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। আমার দেবার মত যা আছে-একটা জান, তা বাংলার মানুষের জন্য আমি মর্গেজ করে দিয়েছি।
ভাইয়েরা আমার, একটা কথা বলে যাবার চাই। লাইটেল ফাইটেল আর চলবে না। ১০০ বিঘার বেশী জমি কেউ রাখতে পারবে না এবং বাকী জমি, যাদের জমি নাই তাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। আমি ডিসি সাহেবকে অর্ডার দিয়ে রাখছি-দেখেন কোন কোন লাঠিয়াল জমি দখল করে রাখছে, সোজা জেলখানায় দিয়ে দেন আর গরীবের মধ্যে সে জমি ভাগ করে দেন। কোন ভয় নেই আপনার, ছাড়বা না। ১০০ বিঘার বেশী কেউ রাখতে পারবে না। বাকী যা আছে তা গরীবের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে-এটাই গভঃর্ণমেন্টের আইন এবং এই আইনই কাজ হবে এবং আমি সরকারী কর্মচারীদের হুকুম দিয়ে যাচ্ছি-যত তাড়াতাড়ি হয় এর যেন ব্যবস্থা করা হয়। আর আইন শৃঙ্খলা রাখেন। চোর ডাকাত, গুন্ডা মানুষের শান্তি যেন নষ্ট করতে না পারে। চোর ডাকাত গুন্ডাদের আপনারা গ্রামের লোক তাদের পুলিশের কাছে দিয়া দিবেন, তাদের শাস্তি দেয়া হবে। আর কিছু কিছু রাজাকার, আলবদর যারা আমার লোকরে মারছে। তারা পলাইয়া পলাইয়া বেড়াচ্ছে এবং জায়গায় জায়গায় সুযোগ পাইয়া কাছিমের মতো মাথা বাহির করতাছে। তোমাদের যে এখন পর্যন্ত কিছু করা হয় নাই, তার অর্থ দূর্বলতা নয়- তোমরা সাবধান হয়ে যাও। তোমাদের লিষ্ট আমাদের কাছে আছে। যদি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে মনে রেখ যুদ্ধাপরাধী আইনে তোমাদের জেলে যেতে হবে। তোমাদের বিচার হবে। এ সম্বন্ধে তোমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পার।
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, বহু কষ্ট করছেন। লক্ষ লক্ষ লোক। বৃষ্টি কাঁদার মধ্যে আপনারা রয়েছেন। আমার দুঃখ হচ্ছে ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার। আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। তবে একটি কথা বলে যাই, আওয়ামী লীগের নেতারা, আওয়ামী লীগ এই দেশের গরীবের প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ, গরীবের প্রতিষ্ঠান থাকবে। আওয়ামী লীগ গরীবের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী লীগ গরীবের জন্য সংগ্রাম করবে। যদি কোন আওয়ামী লীগের নেতা দূর্ণীতি করে তাদের পার্টি থেকে বাহির কইরা দেও। কিন্তু আওয়ামী লীগের যেন বদনাম হয় না। আপনারা ইউনিয়নে ইউনিয়নে নিঃস্বার্থ কর্মীরা আওয়ামী লীগ সুপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং সরকারী কর্মচারীর সঙ্গে এবং পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেশন কইরা দূর্ণীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। না হলে আমার মুখ কালি করবেন না, আমার মুখে কালি দেবেন না। সাত কোটি, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুখে কালি দেবেন না। আমার কর্মীদের কাছে এই আমার আবেদন। বাংলা, বাংলাদেশ প্রত্যেক বাঙ্গালী এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে কাজ করে খাবার অধিকার রয়েছে। কেউ বন্ধ করতে পারবে না।
একটা কথা বলে যাই, বাংলাদেশ চারটি নীতির উপর চলবে। জাতীয়তাবাদ, এটা হলো কি? আমরা বাঙ্গালী। আমাদের জয় বাংলা আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। এই বাঙ্গালী আমরা। আমরা বাঙ্গালী না?
দুই নম্বর, আমি গণতন্ত্র বিশ্বাস করি। কিন্তু গণতন্ত্র মানি। যা ইচ্ছা তাই লিখবেন। যা ইচ্ছা তাই বলবেন তাকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের একটা নীতি আছে। এই গণতন্ত্র আমি বিশ্বাস করি। আপনারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করেন না?
আমরা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করি। যাকে বলা যায় শোষণহীন সমাজ। শোষণহীন সমাজ মানে কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না। আপনারা চান না?
আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। তার অর্থ ধর্ম বিরোধী নই। মুসলমান, মুসলমান ধর্ম পালন করবে। হিন্দু, হিন্দু ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান, খ্রিস্টান ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম পালন করবে। এক ধর্ম অন্য ধর্মের উপর অত্যাচার করবে না। আর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের টাকা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না, ধর্মের নামে লুটতরাজ চলবে না। তবে আমি মুসলমান। আমি মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম কর্ম পালন করব। হিন্দু, হিন্দু পারবে না। কি মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে, তোমার ধর্ম তোমার কাছে-কুলইয়া আইয়ুআল কাফেরুনা, লা আ বুদুনা মা আতা বুদুনা ওলা আনতুম আবেদুনা মাবুদ, লাকুম দিনউকুম ওলিয়াদিন।”
“তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে।” এইটাই হলো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তাই থাকবে। তাই আমি আশা করি। আপনাদের এতে বিশ্বাস আছে? বৃষ্টি কাঁদা চলে যাক, আমিও একটু কাজকর্ম গুছাইয়া লই, সব ঠিকঠাক করি, আবার নোয়াখালি এসে আপনাদের সাথে দেখা কইরা যাব। ঠিক আছে? আমি বাব লব আপনারাতো তা করবেন? আপনারা দিনভরে পরিশ্রম করে উৎপাদন করবেন? চোরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন এবং যাতে শোষণহীন সমাজ হয়, চেষ্টা করবেন? সকলে হাত তোলেন-জয় বাংলা।
সংগ্রহ-সিডি থেকে
১৯৭২ সালের ২৮ জুন সিলেটের বন্যাদূর্গত এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
ভাইয়েরা ও বোনেরা, জেল থেকে বের হয়ে আসার পরে আপনাদের কাছে আমি আসতে পারি নাই। কেন আসতে পারি নাই, তা আপনারা জানেন। এক মূহুর্তও সময় পাই নাই। দেশের অবস্থা আপনারা ভাল করে জানেন। পাকিস্তানের বর্বর সামরিক বাহিনী আমার বাংলাদেশকে খতম করে দিয়ে গেছে। ত্রিশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। লক্ষ বললে ভুল হবে, কোটি কোটি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এক কোটি লোক দেশের মায়া ত্যাগ করে জীবনের মায়ায় ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। আর যারা ছিলেন, তারা অনেক কষ্টে দিন যাপন করেছে। দুই লক্ষ মা-বোনের উপর অত্যাচা করা হয়েছে। রেল লাইন, রাস্তা, লঞ্চ, ট্রাক, বাস, পোর্ট শতকরা পঞ্চাশ ষাট ভাগ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এত বড় পাষন্ড দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় নাই, যা পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীরা করেছে আমার দেশে। সেদিন যদি ভারত বর্ষ এবং তার প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বাংলাদেশকে সহায়তা না করতো চিরদিনের মতো বাংলাদেশের মানুষের কি হতো সে কথা চিন্তা করলে শিহরীয় উঠতে হয়। আমার এক কোটি লোকরে খাবার দিয়েছে। আমার ছেলেকে সাহায্য করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর লোকরা, আমার পুলিশ, আমার বিডিআর, আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার কৃষক, আমার শ্রমিক ভাইয়েরা অস্ত্র তুলে ধরেছিল। আমি বলে গিয়েছিলাম-সাতই মার্চ তারিখে আমি বলে গিয়েছিলাম, “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”। আমি জানতাম জীবনেও মনে হয় আমি আর আপনাদের কাছে ফিরে আসতে পারব না, যখন আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু ফিরে এসেছি। আপনারা দোয়া করেছেন। আপনারা রক্ত দিয়েছেন। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ধ্বংসস্তুপের মতো একটা দেশ পেয়েছি। মানুষের ঘরে খাবার নাই। মানুষের গায়ে কাপড় নাই। স্কুল-কলেজ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। মালপত্র ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কি করে আমি এ দেশকে বাঁচাবো? আমি চিন্তা করলে শিহরীয়া উঠি। তারপরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। আজ আমরা কোন মতে দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে চাল এনেছি। একমাত্র ভারতবর্ষ আমাকে সাড়ে সাত লক্ষ টন খাদ্য দিয়েছেন। আর অন্যান্য দেশ রাশিয়া, আমার বহু রাষ্ট্র ইউএসএ, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া আমাকে খাবার দিয়েছেন, আমি আনছি। আমার পোর্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার জাহাজ নাই। আমাকে বিদেশ থেকে মাল আনতে হবে। এছাড়াও আপনারা জানেন যে, লোকের দুঃখ, আমি লোকের জন্য সংগ্রাম করেছি। এই ২৪ বৎসর এই দেশ পাকিস্তানীদের কলোনী হয়েছিল।
কি দিব আমি আপনাদের। বলেন? কি দেবার পারব? আছে কি? খাজনা? এাপ করে দিয়েছি। ২৫ বিঘা জমির খাজনা? মাপ হয়ে গেছে। গরীব কর্মচারীদের ২৫ টাকা হারে বেতন বাড়ায়া দেয়া হয়েছে। গ্রামে গ্রামে কিছু কিছু খাবার এবং রিলিফ এবং এতিমের টাকা আমি পৌঁছাইয়া দিয়েছি। আপনাদের কিছু দিবার পারি নাই। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি নাই। আমি ধোকা কারো দেই না। ওটা আমার অভ্যাস নাই। আর প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হবার জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। আমি রাজনীতি করেছিলাম আমি আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য। এখন আমার রাজনৈতিক মুক্তি হয়েছে, এখন আমার অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। এটা না হলে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। বাংলার মানুষ যদি পেটভরে ভাত না খায়, যদি বাংলার মানুষ সুখে বাস না করে। বাংলার মানুষ যদি অবিচার-অত্যাচারের হাত থেকে না বাঁচতে পারে-এই স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। সেজন্য আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, যে যেখানে আছেন, যে যে কাজে আত্মনিয়োগ করেন- আমি দেখে এলাম, সিলেটে গিয়েছিলাম, সুনামগঞ্জে আসলাম, আরো কয়েক জায়গায় যাব, বন্যায় সিলেটের সর্বনাশ হয়ে গেছে। একেতো আমাদের পাকিস্তানের বর্বরা শেষ করে দিয়ে গেছে। তারপরে আবার বন্যায় যা কিছু ছিল শেষ করে দিয়ে গেছে। কি করব বলেন? তবে এইটুকু আপনাদের বলতে পারি, বাংলাদেশে যা কিছু আছে শুধু গরীবের জন্য। ব্যয় হবে কোন শোষকের পেটে যাবে না-এতটুকু বলতে পারি এবং যা আছে রিলিফের জন্য আপনারা চিন্তা করবেন না। যেখান থেকে হয় ইন্শাল্লাহ পেটভরে দিবার পারব না, যতদূর পারি কিছু কিছু পৌঁছাবার চেষ্টা করা হবে। তবে কত পার-আমি তা বলতে পারি না। কারণ আমার ব্যাংকে সেই পয়সা নাই যে আপনাদের কাছে ওয়াদা করতে পারি। কারণ ওয়াদা করে আমি বরখেলাফ করি নাই। ওয়াদা আমি করতে পারি না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল আপনাদের একটা কাজ করতে হবে। আমি জানি আপনাদের বাড়ি ঘর নাই। আপানদের খাবার নাই। আপনারা কষ্ট করে এর মধ্যেও আসছেন। আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বড় সময় লাগবে। পয়সা নাই, টাকা নাই, এখন শুধু আমি মানুষকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাছি। যেন দু'বেলা ভাত কোন মতে খেতে পায় কিনা? খাজনা মাফ করে দিয়েছি, লবণ কর মাফ করে দিয়েছি, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনাসহ মাফ করে দিয়েছি। টাকা আমি কোথায় পাব? কোত্থেকে আসবে? হ্যাঁ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পয়সা প্রয়োজন হবে। আপনারা কার্ড....। আমি প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে টাকা দিয়েছি বিলাইয়া দিচ্ছি। বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্ল্যান করা হচ্ছে। আমার বন্ধু ওসমানী সাহেব, জেনারেল ওসমানী এখানে আছেন। আমার ফরেন মিনিষ্টার আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব আছেন। এরা জানে, এরা আমার সহকর্মী। ২৪ ঘন্টা আমার সঙ্গে আছে। একই হারে প্রত্যেকটা লোকের ১৬ ঘন্টা ১৮ ঘন্টা কার করতে হয়। কারণ কোথা থেকে জোগার করব চিন্তা করতে হয়। বন্যার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিশ্চয়ই। না করলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। সুষ্ঠ প্ল্যান করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে হাত দিতে হবে। সরকারী কর্মচারী, আওয়ামী কর্মচারী, ছাত্র ভাইয়েরা সবাইকে অনুরোধ করছি আপনারা গ্রামে গ্রামে দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ান। চিন্তা কইরেন না, খাবার কিছু পৌঁছাইয়া যেভাবেই হয় দেয়া হবে। সুষ্ঠুভাবে যেন বন্টন হয়-সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আমি ৪০ লাখ টাকা ঘোষণা করিয়া দিলাম। দরকার হয় আরো দেয়া হবে কিছু দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি ফুটে, তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। তাই আরো দরকার হয়, খাবার আপনাকে কম দিয়েছে, দরকার হয় আরো পৌঁছাইয়া দেয়া হবে। কিন্তু দেখেন যেন সুষ্ঠুভাবে বন্টন হয়। যাতে গরীব দুঃখী পায়। সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনো। বাবা মারে ইজ্জত করতে শিখো। শিক্ষকের ইজ্জত করতে শিখো। আমার মনে হয় তোমাদের মধ্য থেকে এ জিনিসটা দূর হয়ে গেছে, কোন দিন মানুষ হতে পারবানা। আমার নামের সাথে বিপ্লবী মুজিবুর রহমান বলা হতো কিন্তু আমি বেয়াদব ছিলাম না। যুবকদের ছাত্রদের অনুরোধ করি যে, মেহেরবানী করে স্লোগানটা একটু কম দিয়ে পড়ালেখা কর, আর বাবার পয়সা নষ্ট বেশী কইরনা। আর তোমাদের কাজ হচ্ছে দেশের মধ্যে কারা কারা দূর্ণীতি করে সেদিকে খেয়াল রাখা। দেশের কাজ কর। বড় বড় বক্তৃতা বাদ দাও। যখন কিছু করতে হবে আমি জান আগেও দিচ্ছি ভবিষ্যতের দিব-তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। আর মেহেরবানী করিয়া একটা কথা অনুরোধ করব সকলকে, ভিক্ষা করে দুনিয়া থেকে যা আনি, যাতে গরীব পায়। দূর্ণীতি যেন হয়ে টাকার কুমিড়ে যেন না খেয়ে ফেলে দেয়, সেদিকে আপনাদের খবর রাখতে হবে। গরীবের জন্য কষ্ট করে আনা হয়, মধ্য থেকে চুরি করে যেন না খাওয়া হয়। এবার বেশী সুবিধা হবে না কারণ একটু সময় লাগতাছে আমাদের-কেমন করে বদমাইশ, গুন্ডা, লুইচ্ছা, চোর দমন করতে হয়-বাংলার জনগণকে আমি অনুরোধ করছি যেমন তোমরা সামরিক বাহিনী পাকিস্তানীদের সেই দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলা, এখন তোমাদের করতে হবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং তা যদি করতে হয় তাহলে যাতে ঘুষখোর, বদমাইশ, গুন্ডা, লুইচ্ছা-তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে। দেশের জনগণকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। দেশের জনগণ সংঘবদ্ধ হলে পুলিশ, সরকারি কর্মচারী এবং সকলেই সাহায্য করবে।